Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয়১

নানা দৃষ্টিকোণে নন্দলাল চর্চা

বর্তমান ভারতের শিল্প আলোচনার ক্ষেত্রে দুটি সমস্যা চোখে পড়ার মতো। প্রথমত ভারতীয় শিল্পকলার বিপুল সম্ভার যে শুধুমাত্র দশ-বারোজন শিল্পীর কর্মকাণ্ডের ওপরে নির্ভর করে দাঁড়িয়ে নেই এ কথাটা মানতে আমাদের এখনও প্রচুর অসুবিধা।

শিল্পী: নিজের স্টুডিয়োতে ছবি আঁকছেন শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু

শিল্পী: নিজের স্টুডিয়োতে ছবি আঁকছেন শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু

দেবদত্ত গুপ্ত
শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০১৭ ০১:২৬
Share: Save:

মাস্টারমশাই নন্দলাল বসু

সম্পাদক: সুশোভন অধিকারী

৪০০.০০

লালমাটি

বর্তমান ভারতের শিল্প আলোচনার ক্ষেত্রে দুটি সমস্যা চোখে পড়ার মতো। প্রথমত ভারতীয় শিল্পকলার বিপুল সম্ভার যে শুধুমাত্র দশ-বারোজন শিল্পীর কর্মকাণ্ডের ওপরে নির্ভর করে দাঁড়িয়ে নেই এ কথাটা মানতে আমাদের এখনও প্রচুর অসুবিধা। আমরা অনুমান করতেও চাই না যে ভারতীয় শিল্পকলার বিশাল মানচিত্রে রয়েছেন এমন অনেক নক্ষত্র যাঁদের অবদান আর বিশিষ্টতাকে কোনও ভাবেই দূরে সরিয়ে রাখা যায় না। এই প্রসঙ্গে ইতিহাসের নীরবতাকেও আমরা দীর্ঘ দিন ধরেই মেনে নিয়েছি। আর দ্বিতীয় বিষয়টি হল আমরা আশ্চর্য ভাবে একজন সৃষ্টিশীল মানুষকে মাত্র দুয়েকটি দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখার অভ্যেস করে চলেছি। যেমন যামিনী রায় মানে পট শিল্পের অনুবর্তনের শিল্পী, অবনীন্দ্রনাথ মানে বেঙ্গল স্কুলের প্রবক্তা, নন্দলাল মানে শিব-সতী, হরিপুরা পোষ্টার, সহজ পাঠের শিল্পী ইত্যাদি, ইত্যাদি। কিন্তু এর বাইরেও যে এঁদের কিছু আলাদা কর্মকাণ্ড থাকতে পারে সে কথা নন্দলাল বসু, রামকিঙ্কর বেজ বা বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় প্রসঙ্গে আমরা কতটুকুই বা ভেবেছি? এ কথা না মেনে উপায় নেই যে, আরও নানা দৃষ্টিকোণ থেকে কোনও শিল্পীকে জানতে হলে শুধুমাত্র গবেষণা-নির্ভর দু-চারটে বইয়ের ওপর ভরসা করলে হবে না। তার জন্যে আমাদের দরকার আরও নিবিড় ভাবে আরও কাছ থেকে যে সব মানুষ তাঁদের জানেন-চেনেন বা দেখেছেন তাঁদের ডায়েরি, অপ্রকাশিত লেখা, কথোপকথন ইত্যাদির সন্ধান করা। এমনকি স্বয়ং শিল্পীরও যদি কোনও অপ্রকাশিত কথাবার্তা থেকে থাকে তবে ওরাল সোর্সের মাধ্যমে সেগুলিরও অনুসন্ধানের চেষ্টা করা। সেই কাজটাই নন্দলাল বসু-র প্রসঙ্গে অনেকখানি এগিয়ে দিলেন সুশোভন অধিকারী। তিনি খুব যত্ন করে নন্দলাল চর্চাকে ক্ষুদ্র পরিসরে আটকে থাকা থেকে বের করে নিয়ে এলেন। ফলে আমরা অনেকগুলি দৃষ্টিকোণ থেকে নন্দলাল বসুকে দেখার সুযোগ পেলাম।

যে সম্পাদিত বইয়ের দুই মলাটের মধ্যে সঞ্চিত লেখা ও ছবি সহযোগে সুশোভন নন্দলাল চর্চায় এই অভিনবত্ব আনলেন সেই বইটির নাম মাটি ছোঁয়া মানুষ আকাশ ছোঁয়া শিল্পী/ মাস্টারমশাই নন্দলাল বসু। বইটির লেখক তালিকায় রয়েছেন নন্দলাল বসুর খ্যাতিমান সব ছাত্রছাত্রী (যেমন একজন হলেন ইন্দিরা গাঁধী), রয়েছেন স্বয়ং নন্দলাল বসুর মাস্টার মশাই অবনীন্দ্রনাথ, তালিকায় আছেন রবীন্দ্রনাথ সহ এমন সব বিশিষ্ট ব্যক্তি যাঁরা নানা সূত্রে (পারিবারিক সূত্রও সেখানে লিপিবদ্ধ হয়েছে) নন্দলাল বসুকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। ফলে অনেকগুলি অচেনা দৃষ্টিকোণ থেকে শিল্পী নন্দলাল বসুকে আরও নতুন ভাবে ও টাটকা আঙ্গিকে আমাদের চেনার সুযোগ হল।

যেমন আমরা জানতে পারলাম নন্দলাল বসু আর্ট কলেজে ভর্তি হতে গিয়েছিলেন ‘ভাস্কর’ হওয়ার বাসনা নিয়ে। সেই বাসনা পূর্ণ হয়নি। একজন গুরু তাঁকে শিখিয়েছিলেন ‘তুলিকে ছেনি করে ছবিতে ভাস্কর্য রচনার সাধ মেটানোর কারিগরি’। নন্দলাল বসু নিজেই বলেছেন যে তাঁর প্রথম পর্বের ছবিতে তুলি রচনা করে গিয়েছে ভাস্কর্য রূপায়ণ। এই আলাপন আমরা পাচ্ছি চিন্তামণি করের লেখা থেকে। এটা শুধুমাত্র একটা তথ্য নয়, এর আড়ালে লুকিয়ে আছে নন্দলাল বসুর প্রথম পর্বের ছবিকে বুঝে নেওয়ার অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ এক সূত্রও। নন্দলালের ‘রূপাবলী’র প্রেরণা বা প্রথম পর্বের ছবির ভাস্কর্যসুলভ ডৌল নির্মাণ কেন— এর উত্তর আজ যেন নতুন ভাবে পাওয়া গেল। আবার ইন্দিরা গান্ধী যে ভাবে তাঁকে ছোট্ট ক’টি শব্দে ধরে দিয়েছেন তা এক কথায় অনবদ্য। লেখাটা এরকম— ‘নন্দলাল বসু ছিলেন একজন যথার্থ আচার্য। তিনি শুধু নিজে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেননি, আরও অনেককেই প্রতিষ্ঠা অর্জনে সাহায্য করেছেন। শিল্পী হিসাবে তিনি সকল বস্তুতেই তাদের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও সৌন্দর্যের সন্ধান করতেন, এবং জনসাধারণের জীবনে শিল্পের প্রভাব যাতে আরও গভীর হয় সেদিকে সব সময় তাঁর সজাগ দৃষ্টি ছিল।... অজন্তা ও বাগ-গুহার চিত্রাবলি থেকে শুরু করে সাঁওতালদের তৈরি মাটির পাত্র ও তালপাতার বাঁশি পর্যন্ত যে-বস্তুতেই তিনি যেরকম সৌন্দর্যের প্রকাশ দেখেছেন তাই ছিল তাঁর কাছে পরম আদরের।...’ এই যে একজন রাষ্ট্রনায়কের দৃষ্টিভঙ্গি এটাই আমাদের প্রাপ্তি। এরকম একটা কথোপকথন আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্দিরা গান্ধী একজন শিল্পীর মধ্যে এমন কয়েকটি দিকের অনুসন্ধান করেছেন যেখানে দেশের শিল্পের ও উৎপাদনের মধ্যে বন্ধনের দিকটি উঠে এসেছে। এই দেখাগুলো নতুন দিক উন্মোচন করে।

আছে আরও নানা প্রসঙ্গ। যেমন শিশুদের নিয়ে নন্দলালের ভাবনাটা কী রকম? তার একটা সূত্র মেলে কানাই সামন্তর লেখা থেকে। কানাইবাবু তাঁর শোনা অভিজ্ঞতা থেকে নন্দলালের জবানিতে বলছেন, ‘শিশু বিভাগ মাঝে মাঝে তুলে দেবার কথা হয়েছে। গুরুদেব একবার আমায় জিজ্ঞাসা করেছেন— নন্দলাল, তুমি কী বলো? আমি প্রবল আপত্তি করেছি— শিশুদের নিয়েই আমাদের আসল কাজ। আর শিশুদের সংস্পর্শ না হলে আমরা institution হিসাবেও বাঁচবো না। দিনান্তে একবার অন্তত দেবদর্শন করা চাই আমাদের’। শিশুদের সম্পর্কেও যে এমন ভাবে ভাবতেন নন্দলাল তা আমরা ক’জন জানি। শান্তিনিকেতনে শিশু বিভাগটাই হয়তো থাকত না এই মানুষটা না থাকলে। আজকে যদি ‘সহজপাঠ’ কোনও গবেষণার অঙ্গ হয় তবে এই প্রসঙ্গগুলি তুলে আনার সুযোগ হল এই লেখাটি প্রকাশ হওয়ার ফলে। এই যে একাধিক বক্তব্যকে নানা জায়গা থেকে তুলে এনে এক জায়গায় করা এটা সম্পূর্ণ ভাবে নন্দলাল বসুকে নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাকগ্রাউন্ড স্টাডি করতে সহযোগিতা করবে।

লেখালিখির পাশাপাশি গোটা বই জুড়ে অসংখ্য সাদা কালো ছবি। অধিকাংশই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সব পোস্টকার্ড। এর মধ্যেও হদিশ মিলে যায় শিল্প নির্মাণের নানা দিকে নন্দলালের যে সজাগ দৃষ্টি তাঁর পরিচয়ের। ৬২ নম্বর পাতায় একটি ছুতোরের ছবি। সেই ছবিতে ছুতোরের যন্ত্রপাতির সঙ্গে কোনটা ধনুক, কোনটা নারকেল মালা টিপ রাখার, কোনটা লোহার পাত, কোনটা চোঁচ বাঁশ সমস্ত কিছু লিখে রেখেছেন শিল্পী। এই জাতীয় পোস্টকার্ডগুলিতে আমরা দেখতে পাই নন্দলাল ‘রুরাল ইন্ডাস্ট্রি’ নিয়ে যে কতটা ভাবতেন তার নিবিড় পরিচয়।

সম্পাদক খুব সার্থক ভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছেন পোস্টকার্ডের চিত্রমালার আড়ালেই লুকিয়ে আছেন মানুষ নন্দলাল। যে মানুষটির পা আছে মাটিতে আর মস্তক ছুঁয়েছে আকাশ। সব মিলিয়ে একটি প্রয়োজনীয় সম্পাদনা। কিন্তু শেষে একটা কথা বলতেই হয় যে, সব কিছুর পরেও এটা চিত্রকলার বই। চিত্রকলা ছাপার ক্ষেত্রে একটু অন্য ভাবে ভাবার দরকার আছে। নইলে শিল্পীর প্রতি সুবিচার হয় না, এটা প্রকাশকের ভাবার মধ্যে পড়ে। তবে এমন উদ্যোগকে অসংখ্য সাধুবাদ। বড় মাপের একটা সম্পাদনা দুই মলাটে ধরা রইল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Nandalal Bose Painter
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE