Advertisement
E-Paper

অস্তাচলেও পাহাড় ভেদ করে মানুষের ছায়া

সম্প্রতি গ্যালারি ৮৮-তে অনুষ্ঠিত হল চন্দ্র ভট্টাচার্যের একক প্রদর্শনী। দেখলেন মৃণাল ঘোষআকাশভরা শৃঙ্খল বা ‘এক আকাশ শেকল’। শিল্পী চন্দ্র ভট্টাচার্য। গ্যালারি ৮৮-তে তাঁর আঁকা ১৫-টি ক্যানভাস নিয়ে সম্প্রতি উপস্থাপিত করলেন একক প্রদর্শনী। প্রদর্শনীটিকে বলা যেতে পারে শৃঙ্খলিত স্বাধীনতার আলেখ্যমালা।

শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৫ ০০:০১

আকাশভরা শৃঙ্খল বা ‘এক আকাশ শেকল’। শিল্পী চন্দ্র ভট্টাচার্য। গ্যালারি ৮৮-তে তাঁর আঁকা ১৫-টি ক্যানভাস নিয়ে সম্প্রতি উপস্থাপিত করলেন একক প্রদর্শনী। প্রদর্শনীটিকে বলা যেতে পারে শৃঙ্খলিত স্বাধীনতার আলেখ্যমালা। মুখবন্ধ স্বরূপ একটি লেখা লিখেছেন চন্দ্র এই প্রদর্শনীর জন্য। তার শিরোনাম: ‘দ্য লিমিটেড ফ্রিডম’। সীমায়িত স্বাধীনতা। লেখাটির শুরুতে উদ্ধৃত করা হয়েছে প্রখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক জিগমাঁত ব্যুমান-এর দুটি লাইন: ‘নেভার হ্যাভ উই বিন সো ফ্রি’/ ‘নেভার হ্যাভ উই ফেল্ট সো পাওয়ার লেস।’ স্বাধীনতা ও স্বাধীনতাহীনতার অদ্ভূত দ্বন্দ্বে আকীর্ণ এই সময়। শক্তিহীনতা তো স্বাধীনতারই নামান্তর। এই দ্বন্দ্বাকীর্ণ সময়ের অন্তর্লীন শূন্যতার কিছু প্রতীকী ভাষ্য রচনা করেছেন চন্দ্র স্বাভাবিকতাবাদী রূপরীতির বিভিন্ন উপস্থাপনায়।

তেমনই একটি ছবিতে আমরা তমসালীন এক ধূসর নিসর্গ দেখতে পাই। সম্মুখপটে বিস্তীর্ণ শূন্য পরিসর। মাঝে মাঝে ছড়ানো পুঞ্জিত অন্ধকার। কিছু শৃঙ্খল প্রবাহিত হয়েছে সেই পরিসরে। কখনও প্রবেশ করেছে মৃত্তিকার অভ্যন্তরে। কখনও চিত্রক্ষেত্রের সম্মুখবর্তী প্রান্তরেখা অতিক্রম করে চলে গেছে দৃষ্টিসীমার বাইরে। মধ্যবর্তী অঞ্চলে ঘনকৃষ্ণ পাহাড়-প্রতিম উত্তুঙ্গ পিরামিড-সদৃশ একটি প্রতিমাকল্প, পশ্চাৎপটকে প্রায় সম্পূর্ণ আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে যা। এই পর্বতশৃঙ্গের উপরে দৃশ্যমান যে আকাশ, পরিচিত আকাশের ঔদাত্ততা নেই সেখানে। কালিমাময় মেঘাবৃত সেই পরিসরে মাঝে মাঝে পুঞ্জিত হয়ে আছে কৃষ্ণ-গহ্বরের মতো অঞ্চল। ধূসরিত মেঘমালার কিছু বিচ্ছুরণও রয়েছে সেই স্তব্ধ অন্ধকারকে ঘিরে। প্রবহমান সেই শৃঙ্গগুলি একপাশ দিয়ে সেই পাহাড় অতিক্রম করে চলে গেছে দৃষ্টিসীমার বাইরে। চিত্রক্ষেত্রের প্রায় মধ্যবর্তী সীমায় পাহাড়ের পাদদেশে দণ্ডায়মান বা চলমান দুটি মানুষের আভাস অনুভূত হচ্ছে। দূরত্বের জন্য এবং আলোর অভাবের জন্য খুবই অস্পষ্ট এই অবয়ব। পাহাড়ের উপরে পশ্চিম দিকে অস্তাচলগামী সূর্য দৃষ্টিসীমার মধ্যে নেই। তবু তার উপস্থিতি অনুভব করা যাচ্ছে চলমান ওই মানুষদুটির প্রলম্বিত দীর্ঘ ছায়ায়। পরিব্যাপ্ত তমসায় এই ধূসর নিসর্গে শনাক্তসীমার বাইরে উপস্থাপিত দুটি মানব-প্রতিমায় শিল্পী হয়তো দেখাতে চেয়েছেন অস্তিত্বের অপ্রাসঙ্গিকতা। ‘আকাশভরা সূর্যতারা’র ভাষ্যের এক বিপরীত অবস্থান।

সভ্যতা আজ এই শৃঙ্খলিত করুণ শূন্যতায় এসে পৌঁছেছে। স্বাভাবিকতাবাদী আঙ্গিকে অত্যন্ত দক্ষ এই শিল্পী স্বাভাবিকতাকে একেবারেই দ্রবীভূত করে অভিব্যক্তিবাদী কল্পরূপের আশ্রয় নিয়েছেন আকাশভরা শূন্যতার পরিব্যাপ্ত ট্র্যাজিক চেতনাকে উন্মীলিত করতে। এরকম শূন্যতাদীর্ণ নিসর্গ বা নিসর্গহীন শূন্যতার উপস্থিতি এই চিত্রমালার আয়ত্ত কয়েকটি ছবিতে আছে। তেমনই একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে বিস্তীর্ণ এক ধূসর শূন্য পরিসর। দিবালোকে উজ্জ্বল। চিত্রক্ষেত্রের প্রায়-মধ্যবর্তী অঞ্চলে নির্জন একটি বৃক্ষ দাঁড়িয়ে আছে। বাঁ-পাশে উপরের দিকে একটি পাহাড়ের আভাস। মধ্যবর্তী অঞ্চলে এক ঝলক আলো গহ্বরের আভাস আনে। দুই প্রান্তে ছড়ানো রয়েছে শৃঙ্খল-প্রতিম দুটি রজ্জু। একরম নিসর্গ-ভিত্তিক রচনা রয়েছে আরও কয়েকটি।

নিসর্গের ভিতর শূন্যতার এই অভিজ্ঞান থেকে শিল্পী ফিরে আসেন তাঁর নিজস্ব স্বাভাবিকতাবাদী উপস্থাপনায়। সেখানে তিনি আরও প্রত্যক্ষভাবে মেলে ধরতে পারেন শৃঙ্খলিত মানুষের আখ্যান। মানুষ তার অস্তিত্ব নিয়ে যেন এক বিপর্যয়ের প্রান্তসীমায় এসে দাঁড়িয়েছে। স্বাভাবিকতাবাদী-রীতির ছবিতে যন্ত্রণাক্ত এক গৈরিক মানুষ। বন্দুকের নল এসে স্পর্শ করেছে তাঁর শরীর। মাথার উপরে জটলা। আর একটি ছবিতে দুই নগ্ন মানব-মানবী দাঁড়িয়ে আছে। তাঁদের পশ্চাদ্দেশ শুধু দেখা যাচ্ছে কাঁধ থেকে হাঁটু পর্যন্ত। পশ্চাৎপটে নিপাট অন্ধকারের মধ্যে বিচ্ছুরিত হচ্ছে আলোকপুঞ্জ।

এরকম বিভিন্ন প্রতিমাকল্পে শিল্পী প্রতীকায়িত করেছেন এই সংঘাতদীর্ণ ভ্রষ্ট সময়ের দহন শূন্যতাকে। উন্নয়নের মহারথ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে চারদিকে। সেই উন্নয়নের শৃঙ্খলে কেমন করে বিপর্যস্ত হচ্ছে মানুষের একমাত্র নিজস্ব সম্পদ, তাঁর স্বাধীনতা, সেটাই শিল্পী মেলে ধরতে চেয়েছেন।

abp painting review mrinal ghosh sculpture criticism sculpture painting review
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy