ইছামতীর ও-পারে চাঁদুড়িয়া গ্রামের বড়সড় আটচালা শিবমন্দির এ-পার থেকে স্পষ্ট দেখা যেত। এক সময় আস্ত অশ্বত্থগাছ ধীরে ধীরে গোটা মন্দিরটাকে গ্রাস করল। মন্দিরের গর্ভগৃহের ঝোপজঙ্গল থেকে ভেসে আসা তক্ষকের ডাকে, বসতিহীন নিরিবিলি নদীধার আরও নিস্তব্ধ মনে হত। এ-পার থেকে দেখলাম, পরিত্যক্ত সেই কাঠামো এক দিন মাটিতে মিশে গেল। সাবেক খুলনা জেলার এই বৃহত্তর এলাকায় ডেভিড ম্যাককাচ্চনও প্রত্নসন্ধানী হয়ে ঘুরেছেন। কোনও তথ্যেই এ মন্দিরের সূত্রসন্ধান নেই। শতবর্ষী কত মন্দির মসজিদ দোলমঞ্চ রাসমঞ্চ গির্জা সমাধিস্থল মাজার মূর্তিভাস্কর্য আটচালা ইমারতের পুরাকীর্তি নিদর্শন আমাদের অজানাই থেকে গেছে। কালখণ্ড তার হিসাবও রাখেনি!
ধ্বংসপ্রাপ্ত এই মন্দিরের কাছাকাছিই ইছামতীর এ-পারে তেঁতুলবেড়িয়াতে, ভগ্নপ্রায় হয়ে আজও টিকে আছে পোড়ামাটির ফলক ও পঙ্খের কাজে সমৃদ্ধ পঞ্চরত্ন শিবমন্দির। উত্তর চব্বিশ পরগনার গাইঘাটা থানার এই এলাকা আর ও-পার আজ আলাদা দেশ। ভূস্বামী প্রধান পরিবারের বসতি পরিত্যক্ত— তাঁদের দেবালয়ও দু’শো বছর পেরিয়ে অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। এই সময়কালে ইছামতী বরাবর যদি যাওয়া যায় আরও দক্ষিণে, যেখানে বসিরহাট শহরের শাহি মসজিদ জন-জমায়েতের নমাজে জমজমাট। পাঁচশো বছরের মসজিদ সংস্কারে আজও মজবুত। অতীতের নিদর্শন এক দিকে ধ্বংসপ্রাপ্ত, কোনওটি ধ্বংসোন্মুখ বা কোনওটি ইতিহাসের আকর হয়ে টিকে থাকা প্রত্নসাক্ষ্য।
এমনই ঐতিহ্য সন্ধানের ফল সাগর চট্টোপাধ্যায়ের বইটি। জেলার প্রত্ন-ঐতিহ্যের এমন বিস্তৃত খোঁজ যা উত্তরে বাগদা থেকে দক্ষিণে হিঙ্গলগঞ্জ; অন্য দিকে, গঙ্গার পুবকূলে নৈহাটি-ব্যারাকপুর-দক্ষিণেশ্বর-দমদম থেকে সীমান্তবর্তী হাকিমপুর-টাকি শুধু দূরত্বসূচকের নিরিখে নয়— তিন শতাধিক প্রত্নস্থল বর্ণনা নিবিষ্টতার স্বাক্ষর। তাতে প্রত্নবস্তু ও প্রত্নস্থলের তথ্য, মন্দির-মসজিদ-গির্জার কাঠামো, শৈলী, প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের নথিভুক্তিকরণ।
উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার পুরাকীর্তি
সাগর চট্টোপাধ্যায়
৮৫০.০০
প্রত্নতত্ত্ব ও সংগ্রহালয় অধিকার, তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার
লেখক সাম্প্রতিক উৎখনন ও গবেষণা-তথ্য সন্নিবেশ করেছেন; যা দেখেছেন তা পরিব্রাজনের নিরিখেও উল্লেখ্য। বর্তমান বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অঞ্চল, দক্ষিণে সুন্দরবন ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা সীমা, উত্তর-পশ্চিমে নদিয়া জেলা; অন্য দিকে মহানগর কলকাতার সঙ্গে এ জেলার পরিসীমা এক নজরে বিভাজনও সম্ভব নয়। তথ্য পরিবেশনার আয়োজনও জেলা পুরাকীর্তি গ্রন্থমালার অন্য বইয়ের থেকে স্বতন্ত্র। মন্দির-মসজিদ-গির্জার সমীক্ষালব্ধ তথ্য রঙিন বিন্যাসে উপস্থাপনার সার্বিক চিত্র; মন্দির আঙ্গিকের রত্ন, চালা, দালান রীতি এবং মসজিদের গম্বুজ সংখ্যার নিরিখে নির্দেশিকা; এমনকি মূর্তি বিগ্রহ তৈরির উপাদান ও বিভিন্ন জনপদভিত্তিক পুরাকীর্তি তালিকা সংযোজিত হয়েছে। প্রত্নলিপি বর্ণনা এ বইয়ে যেমন আছে তেমনই দমদমের প্রাচীন ইতিহাসের উপাদান, দক্ষিণেশ্বরের রানী রাসমণি ও শ্রীরামকৃষ্ণদেবের স্মৃতিভূমির দেবালয়, হাড়োয়ার পির গোরাচাঁদের মাজার, বাগদার বাজিতপুর গ্রামের সুসমঞ্জস মসজিদের মতো তথ্যে জেলার জানা-অজানা বৈচিত্র উদ্ঘাটন।
অর্ধশতাব্দ কাল আগে পশ্চিমবঙ্গের পুরাকীর্তি গ্রন্থমালা শুরুর পর্যায়ে, তৎকালীন মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় মুখবন্ধে লিখেছিলেন, “পুরাতত্ত্বের ছাত্র হিসাবে আমি, এই গ্রন্থমালার কৃতবিদ্য ও যশস্বী সম্পাদকমণ্ডলী এবং সরেজমিন অনুসন্ধানে কঠোর পরিশ্রমী তথ্য সংকলকগণ, শ্রদ্ধেয় ইতিহাস-তপস্বীর সে শুভ অভিলাষ পূরণে প্রতিশ্রুত।” গ্রন্থমালার প্রথম বাঁকুড়া জেলার পুরাকীর্তি রচনা করেন তৎকালীন বিভাগীয় আধিকারিক অমিয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পর থেকে এগারোটি জেলা পুরাকীর্তি রচনা হয়েছে। কিন্তু সম্পাদনায় অভিভাবকহীন হয়ে এই বইয়ে সেই অভিলাষ বহুলাংশে বিঘ্নিত। ক্রাউন আকারের আটশো পৃষ্ঠারও বেশি আর্ট পেপারে ছাপা বই। ছবি স্বাভাবিক ভাবেই লেখার মধ্যেই জায়গা পেয়েছে। প্রত্নতত্ত্বের প্রকাশনায় ছবি সমধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাঢ়বঙ্গের মতো পোড়ামাটির ফলকসমৃদ্ধ মন্দির এ জেলায় বিরল হলেও, বেড়াচাঁপা বা চন্দ্রকেতুগড়ের প্রত্নস্থল খনা-মিহিরের ঢিবি বাংলার অন্যতম ইতিহাস উন্মোচনী নিদর্শন। অথবা, ধান্যকুড়িয়ার গাইন গার্ডেনের তোরণ-দ্বারের মতো বৈভবী স্থাপত্য বাংলায় দু’টি নেই। অথচ এমন অকিঞ্চিৎকর সব ছবির ফ্রেম, বইটির বর্ণনার সঙ্গে মিলিয়ে দেখার সুযোগ নেই। লেখক তো দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার পুরাকীর্তিও রচনা করেছেন— তুলনায় এ সব অসঙ্গতি স্পষ্ট বোঝা যাবে।
তা ছাড়া, লেখক জনপদভিত্তিক পুরাকীর্তির তথ্য-নিবন্ধীকরণের বাইরে গিয়ে অন্য প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। প্রাসঙ্গিকতা তাতে ক্ষুণ্ণ হয়েছে। ছোট জাগুলিয়ার তথ্যে চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব ছবি বিশ্বাসের সড়ক-দুর্ঘটনায় প্রয়াত হওয়ার বিস্তারিত ধারাবিবরণী খুব প্রাসঙ্গিক কি? এমনকি ইংরেজি সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রয়াণলেখও তিনি তুলে দিয়েছেন। গবেষণার অঞ্চলকথা নিয়ে স্বতন্ত্র বই হতেই পারে— তাতে বর্তমান কলেবর যে সীমিত থাকত শুধু তা-ই নয়, মূল্যও সহনীয় হত। আবার যেমন, শুধু দমদম, বরাহনগর, ব্যারাকপুর অংশ নিয়েই একশো পৃষ্ঠার একটা বই হতে পারে। এ ব্যাপারটিও বোধগম্য নয়— বইটির আখ্যাপত্রে প্রকাশকের নামোল্লেখ নেই; এমনকি সরকারি প্রকাশনায় অশোকস্তম্ভ বা অধুনা আরোপিত কোনও ‘লোগো’ থাকবে না? আর শুরুর কথা শেষে— যেখানে, প্রচ্ছদলিপিতে প্রথমে ‘উত্তর চব্বিশ’ লেখা, পরের লাইনে ‘পরগনা জেলার’— এমন বিন্যাস হবে কেন?
এ সব খুঁতখুঁতানি বা অসমন্বিত কার্যকলাপ এড়িয়ে, পুরাবৃত্তের নিবন্ধীকরণের পরিশ্রমী প্রয়াসের প্রশ্নে, লেখকের দৃষ্টির গভীরতায় কোনও খামতি নেই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)