দেবেশ রায়ের গল্পসমগ্র ছ’টি খণ্ডে তাঁর জীবনকালেই প্রকাশিত হয়েছিল। ষষ্ঠ খণ্ডের প্রকাশ লেখকের মৃত্যুর কুড়ি বছর আগে। সেই ছয় খণ্ডের গল্পকে তিনটি খণ্ডে বিন্যস্ত করে পরবর্তী অগ্রন্থিত গল্প নিয়ে বর্তমানে আলোচ্য এই চতুর্থ খণ্ড। সঙ্গে পরিশিষ্ট হিসেবে আছে আগেকার ছ’টি খণ্ডের ভূমিকা আর প্রতি খণ্ডে যুক্ত গল্পের কালানুক্রমিক তালিকা। অর্থাৎ গল্পসমগ্র তার প্রথম প্রকাশকালে আকারে-প্রকারে, গতি-প্রকৃতিতে কেমন ছিল, তার হদিস নব কলেবরের চতুর্থ খণ্ডে নতুন পাঠক পাবেন। আর আছে সম্পাদক সমরেশ রায়ের লেখা একটি জরুরি ‘নিবেদন’। সেই ‘নিবেদন’ থেকে জানা গেল, ১৯৯৮-পরবর্তী, পূর্বে অগ্রন্থিত এই গল্পগুলি ছাড়াও আরও কয়েকটি গল্প ছিল, যেগুলির পাণ্ডুলিপি বা পত্রিকায় প্রকাশিত কপি এখনও পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এই খণ্ডে যুক্ত কয়েকটি কাহিনিরও প্রথম প্রকাশকালের বা রচনাকালের উল্লেখ নেই, যদিও সম্পাদক নিশ্চিত, গল্পগুলো ১৯৯৮-এর আগেকার নয়। ‘তালপাতার পুঁথি’ লেখকের বাইশ বছর বয়সে লেখা, এত দিন পরে তার হদিস মিলেছে, আর আছে রাজবংশী ভাষায় লেখা ‘সিঁড়ি ভুল’। ২০১৯ পর্যন্ত লেখা গল্পগুলোকে কালানুক্রমে সাজিয়ে, তার পর উপরের দু’টি গল্প দিয়ে, সব শেষে আছে তারিখবিহীন ছ’টি গল্প। কিন্তু এই খণ্ডের প্রথম গল্প ‘ফাজিল খাতা’ (১৯৯৮) (পৃ ১৩-১৮) আর এখনও যার রচনাকাল/প্রথম প্রকাশকাল অজ্ঞাত, সেই ‘স্বর আর স্বর’ (পৃ ৩৮৭-৯২) তো একই গল্প! ফারাক কেবল কাহিনির নামকরণে! তবে কি এই খণ্ডের গল্পসংখ্যা চুয়াল্লিশের বদলে তেতাল্লিশ ধরব?
দেবেশ রায়ের গল্পের লক্ষণ সবই আছে তাঁর জীবনের এই শেষ কুড়ি-বাইশ বছরের কাহিনিগুলোতে। গল্পহীনতার যে-বিন্যাসে ‘আহ্নিকগতি ও মাঝখানের দরজা’ (১৯৫৭) বা ‘দুপুর’-এর (১৯৫৮) মতো আখ্যানে মুগ্ধ হয়েছিলেন পাঠক, সেই ঘটনাবিহীনকে, গল্পবিহীনকে অনুপুঙ্খের আশ্চর্য বাহারে গল্প করে তোলা; এই আখ্যানধর্ম পোক্ত থেকে আরও পোক্ত হয়েছে সাহিত্যিকের যাত্রাপথ ব্যেপে। তার নিদর্শন হিসেবে যদি পড়া যায় ‘এত আলো জ্বালিয়েছ’-র মতো গল্প? প্রতি মুহূর্তেই মারাত্মক কিছু ঘটে যাওয়ার, আর সেই ঘটনা থেকে বেশ নিটোল এক কাহিনিবিন্যাস ছড়িয়ে যাওয়ার জন্য নতুন পাঠকের প্রতীক্ষা স্বাভাবিক। অথচ তেমন কোন ছকে ঢালা গল্প যে তৈরি হবে না, কিন্তু তেমন মর্মান্তিক সব গল্পের সম্ভাবনাতেই লেখক গড়ে দেবেন সমকালীন জীবনযাপনের রীতিবিধি প্রসঙ্গে তাঁর আপত্তি কিংবা বীতরাগ; দেবেশ রায়ের বয়ানে অভ্যস্ত পাঠক তা জানেন। ‘খিদের পোস্টমডার্ন’ আর ‘ভার্চুয়্যাল বাঁচা ও সত্যি-সত্যি মরা’-র নির্মম গল্পহীনতা এক দিকে, অন্য দিকে ‘অয়নের বড় হওয়া’-য় বা ‘বুবকার অনন্ত এক-মিনিট’-এ শিক্ষা-অশিক্ষার রকমফের, কৈশোরের নতুন নতুন বোধোদয় (না কি বোধহীনতা?)।
শিক্ষা আর তার প্রশাসন, রাষ্ট্র আর তার ব্যবস্থা, পারিবারিকতা আর সামাজিকতার ভয়ঙ্কর আধুনিক সব গড়ন-পেটন, প্রযুক্তি আর মানুষের নিত্যনতুন দেওয়া-নেওয়া— এই সব কিছুর বিরুদ্ধে সাহিত্যসম্মত প্রতিবাদ বানানোতেই যে এই লেখকের আখ্যানের চলন, সে কথা নতুন নয়। সময় অসময়ের বৃত্তান্ত লিখতে লিখতেই বলেছিলেন তিনি, সাহিত্যিকের এ এক বড় বালাই! যে গল্পই তিনি বানাতে চান, দেখেন, তার থেকেও বহুগুণ অভাবনীয় কোনও অসম্ভব ঘটে বসে আছে তাঁর সমকালীন বাস্তবে! তাই লেখক-নিরপেক্ষ বাস্তববাদী বিন্যাস যত লেখা হবে, ততই তা মিথ্যা হবে। ওই বালাইটার স্বীকারোক্তিই টুকরো টুকরো ছড়িয়ে আছে এই চতুর্থ খণ্ডের গল্পে গল্পে। বাস্তবটা তালগোল পাকিয়ে ক্রমশই কুৎসিত থেকে আরও কুৎসিত হয়ে উঠছে, তাই বদলে যাচ্ছে গল্পহীনতার ভাষা।
গল্পসমগ্র ৪
দেবেশ রায়,
সম্পা: সমরেশ রায়
৬০০.০০
দে’জ়
‘খাঁচাগাড়িতে’, ‘উই’ কিংবা ‘হেলমেট’-এর মতো গল্পে পাঠক দেখেন, রোজকার জীবনযাপনের জন্য রাষ্ট্র-নির্দিষ্ট ঘেরাটোপ কতখানি অসঙ্গত, অথচ সেই ঘেরই নাকি সভ্য স্বাভাবিক মানুষের দিনযাপনের নির্বিকল্প আশ্রয়! আবার ‘ঘুমের ভিতর হাইওয়ে’ আর ‘সিসি টিভিতে একা’ যে একই গল্পের যেন ভিন্ন দু’টি অবয়ব, এমন পাঠ একান্ত নিরাশ্রয় করে তোলে পাঠককে, নিজের জীবিকা-জীবন নিয়ে, নিজের চাওয়া-পাওয়ার অসঙ্গতি নিয়ে। নিত্যকার যাপনের অসঙ্গতিকে ভুলে থাকতেই যদি কোনও পাঠক সাহিত্য-সংস্কৃতির দুয়ারে দাঁড়ান, তবে তাঁর পড়বার জন্য দেবেশ রায়ের সৃজন আদৌ সঠিক নির্বাচন নয়। আজ বলে নয়, তাঁর লেখার প্রথম পর্ব থেকেই বড়ই বেমক্কা এই সাহিত্যিকের চিন্তন আর বয়ান। অথচ রসিকতার অন্ত নেই। সফল, আধুনিক বাঙালি যে তার ভাষা, তার শিকড়, তার অতীত ইতিহাস, সর্বস্ব হারিয়ে তবে স্বাভাবিক জীবনের শরিক হতে পারে, এই কথাটা বলবার জন্যই ‘মিঠির মেজমামা’-র মতো গল্প; যার সূচনার বাক্যটি হল, “লক্ষ্মীঠাকরুনকে ঘটিহাতা হাল্কা গোলাপি ফ্রক পরালে একেবারে মিঠির মতো দেখতে হত।” (পৃ ১৯)
আমার কখনওই মনে হয় না, দেবেশ রায়ের অমুক আখ্যানটি শহরের, আর তমুকটা গ্রামের। প্রায় পাঁচ দশক আগে পর পর পড়েছিলাম মানুষ খুন করে কেন আর মফস্বলি বৃত্তান্ত। বই দু’টির সৃজন নাকি পাশাপাশি চলেছিল লেখকের সাহিত্যিক যাত্রাপথে। ভেবেছিলাম, কেমন করে সম্ভব! যত সময় গেছে, ততই বুঝেছি, শুধু সম্ভব নয়, তারা যেন পরিপূরক! কথাটা মনে এল, কারণ, এই চতুর্থ খণ্ডে নাগরিক আরাম-ব্যারামকে নেড়েচেড়ে, ক্রমোন্নতিশীল প্রযুক্তি আর অঢেল ক্রয়ক্ষমতার আনুকূল্যে মানুষের একা থেকে আরও একা হওয়াকে ঘিরে-ঘিরে লেখা নিরালম্ব যাপনের বিচিত্র সব কাহিনির পাশে ‘দেহের আঠারো প্রকার’-এর মতো একটি গল্পও থাকে। যে গল্পে ভাগে-নেওয়া নামমাত্র জমিতে হাল দেওয়ার জন্য বলদ কিনবে বলে গাঁয়ের বাইরে এসেছে ধাপচন্দ্র-বাঁধেশ্বরী; সেই বাইরে নাকি মিস্তিরির জোগাড়ের কাজেও মেলে দৈনিক ৪০/৫০ টাকা। দু’জনে মিলে কাজ করলে, কত টাকা যে হবে তাদের, তা ওদের স্বপ্নে বা হিসাবে ধরে না।
কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর এই জীবিকা-যাত্রা কি শেষ পর্যন্ত নিরুদ্দেশ যাত্রাতেই উপমা পেল? নিশ্চিত উত্তর নেই গল্পের শেষে। আর এমন একটা ইঙ্গিতও যেন আছে যে, লেখকের অক্ষরজ্ঞান ধাপচন্দ্র আর বাঁধেশ্বরীর ওই যাত্রার তেমন কোনও নির্দিষ্ট পরিণাম বানাতে অক্ষম। শিক্ষিতের অক্ষরজ্ঞানের এই সীমা নিয়ে চৈতন্য আর বিষাদ দেবেশ রায়ের সাহিত্যধর্মে মিশে রইল জীবনের শেষ পর্বেও! আর নতুন কিছু যে লিখবেন না তিনি, তা তো নির্ধারিত হয়ে গেছে আজ পাঁচ বছর।
সম্ভবত আলোচ্য বইটিই হয়ে থাকবে দেবেশ রায়ের সর্বশেষ গল্পগ্রন্থ। বইয়ে মুদ্রণপ্রমাদের মাত্রা এত বেশি যে, হোঁচট খেতে হয়। যেমন, পৃ ৩৯৮-তে ‘টাপুরটুপুর’ হয়েছে ‘টাপুরটুকুর’, ‘এত’-র জায়গায় ‘এক’, ‘না’-এর বদলে ‘পা’ ইত্যাদি। ভুলে-ভরা এমন পৃষ্ঠার সংখ্যা কম নয়। ‘অনাগরিক তিতি’-র মতো জোরদার গল্পে কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘তিতি’-র নাম যে কত বার ‘তিনি’ ছাপা হয়েছে! পরের সংস্করণে সংশোধন হবে তো?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)