E-Paper

খোঁজ ফুরোবে না, তাই সে অসম্পূর্ণ

চিঠির অভিঘাতই লেখককে ঠেলে দেয় এক যাত্রাপথে। যতটা বহির্মুখী খোঁজের এই যাত্রা, তারও চেয়ে বেশি অন্তর্মুখী আত্মানুসন্ধানের।

শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২৫ ০৫:২৯
—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

হরেকৃষ্ণ ডেকার অসমিয়া ভাষার এই উপন্যাসটি সম্প্রতি অনূদিত হয়েছে ইংরেজিতে। বইটি পড়ার সময় প্রথমেই পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে উপন্যাসের শিরোনামের শেষাংশ: ‘অ্যান আনফিনিশড নভেল’, এক অসমাপ্ত উপাখ্যান।

কেন অসমাপ্ত? লেখক স্বয়ং যেখানে স্বমহিমায় বিরাজমান, সেখানে ‘অসমাপ্ত’ একটি উপন্যাসকে পূর্ণতা না দিয়ে প্রকাশ করা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ল কেন? তবে, কাহিনির পরতে পরতে যে সব সত্য বা তার আভাস উন্মোচিত হতে থাকে, তাতে বোঝা যায়, বইটির ‘অসমাপ্ত’ অবস্থাটি যত না গঠনগত বা আঙ্গিক-নির্ভর, তারও চেয়ে বেশি দর্শনগত। একেবারে প্রথম পাতা থেকেই অনিশ্চয়তা, অজানার হাতছানি এবং একমুখী নৈর্ব্যক্তিক ভাষ্যের অভাব যেন পাঠকের পায়ের তলার জমি শক্ত হতে দেয় না। মূল উপন্যাসের প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে থাকা ‘আ টেল’ নামের প্রাক্‌কথনে দু’টি ভিন্ন স্বরের ভাষ্য পাঠকের চেতনায় বুনে চলে উপন্যাসটির ভবিষ্যৎ। একটি স্বর স্বয়ং লেখকের— তিনি কথা বলছেন আমাদের সঙ্গে, কিন্তু প্রচলিত ধারার সর্বজ্ঞ কাহিনিকারের নিরঙ্কুশ আত্মবিশ্বাস তাঁর যেন নেই। তিনি একটি চিঠির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন তাঁর পাঠকদের; পাঠকের সঙ্গে তিনি নিজেও পড়ছেন চিঠিটি— কিছুটা স্তম্ভিত, কিছুটা অবাক ও অধৈর্য।

চিঠির কণ্ঠস্বরটি দ্বিতীয়, এবং সে-ই মুখ্যত লেখকের অস্বস্তির কারণ। পত্রপ্রেরক লেখকের কাছে সম্পূর্ণ এক নামহীন আগন্তুক। বহু দূরের, সমুদ্রপারের কোনও দেশ থেকে তিনি এই চিঠি লিখছেন— প্রাচীন এক জনজাতির সঙ্গে আচম্বিতে পড়ে পাওয়া তাঁর কিছু যাপন-মুহূর্ত বর্ণনা করে। সে চিঠিতে সেই দেশের বা উপজাতির নামোল্লেখ পর্যন্ত নেই। আছে কেবল এক প্রচ্ছন্ন অনুনয়— আপনার সেই যে এক কাহিনিতে এক উপজাতির জনজীবন নিয়ে লিখেছিলেন, যাঁদের ঘরেদোরে ঝরে পড়ত স্বর্ণবৃষ্টি; সে তো কল্পনাপ্রসূত। “আই ডু বিলিভ দ্যাট ইন ইয়োর ন্যারেটিভ, দেয়ার শ্যাল শিয়োরলি বি আ ট্রু অ্যাকাউন্ট অব হোয়াট আই অ্যাম অ্যাবাউট টু রিলেট টু ইউ।”

চিঠির অভিঘাতই লেখককে ঠেলে দেয় এক যাত্রাপথে। যতটা বহির্মুখী খোঁজের এই যাত্রা, তারও চেয়ে বেশি অন্তর্মুখী আত্মানুসন্ধানের। বিশ্বসাহিত্যে বার বার ফিরে আসা ‘প্রকৃতি’ ও ‘সভ্যতা’র অম্লমধুর সম্পর্ক যেন এই উপন্যাসের ছত্রে ছত্রে। সভ্যতার দেওয়াল তুলে নিজেদের ‘পৃথক’ করে ফেলা মানুষ কি তাঁর সেই ‘ইনসুলেটেড’ জমি থেকে আর কখনও প্রকৃতিকে পূর্ণাঙ্গ দেখতে পায়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে উপন্যাসটির গভীরে ডুব দিলে উপলব্ধি হয়— সামাজিক-রাজনৈতিক বন্ধন ছিন্ন করে মানুষ যদি আবার প্রকৃতির কাছে নিঃশর্ত সমর্পণ না করতে পারে, তবে হয়তো প্রতি বারই নিজের রঙিন কাচের মধ্য দিয়ে সে প্রকৃতিকে, এমনকি প্রকৃতি-ঘনিষ্ঠ নিজপ্রজাতির যাপনকে বিচার করবে।

যে সম্পর্ক হওয়া উচিত ছিল ‘সিমবায়োটিক’ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ, রাষ্ট্রযন্ত্রের স্বার্থান্বেষী হস্তক্ষেপে ও মানুষের অপরিণামদর্শিতায় তা পরিণত হল প্রকৃতি ও সভ্যতা, অসভ্য ও সভ্যের বনাম ও ‘বাইনারি’র গল্পে। হরেকৃষ্ণ ডেকার এই আখ্যান বারংবার প্রশ্ন করতে থাকে প্রকৃতি ও মানবের মাঝে তৈরি হয়ে যাওয়া দেওয়ালকে। গ্রাম ও শহর পেরিয়ে, অসংখ্য মুখের আনাগোনা পেরিয়ে, ঋতুচক্র পেরিয়ে ‘যাত্রা’ হয়ে ওঠে মানবমনের চলিষ্ণু দলিল। এই চলা, আত্মানুসন্ধান ফুরোবে না কোনও দিন— তাই বুঝি সে ‘অসম্পূর্ণ’! দক্ষ অনুবাদশৈলী ও অন্তর্দৃষ্টি ইংরেজি অনুবাদটিকে সুগভীর ও সহজগম্য করে তুলেছে।

যাত্রা: অ্যান আনফিনিশড নভেলহরেকৃষ্ণ ডেকা

অনু: নবমালতী নেয়োগ চক্রবর্তী

৬৯৫.০০

নিয়োগী বুকস

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

book review Bengali Literature

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy