E-Paper

লিঙ্গ, ধর্ম, রাজনীতির রূপান্তর

প্রাক্‌-আধুনিক থেকে ঔপনিবেশিক-পরবর্তী সময় পর্যন্ত ধর্ম, পিতৃতন্ত্র এবং বর্ণ ব্যবস্থা কী ভাবে প্রায় নিরবচ্ছিন্ন ভাবে তাদের প্রভাব সমাজে কায়েম রেখেছে, তা তুলে ধরেছে প্রথম অধ্যায়টি।

মেরুনা মুর্মু

শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৫ ০৮:৪৩
বীরাঙ্গনা: যুদ্ধরতা ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই, ভারতীয় শিল্পীর আঁকা ছবিতে।

বীরাঙ্গনা: যুদ্ধরতা ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই, ভারতীয় শিল্পীর আঁকা ছবিতে। উইকিমিডিয়া কমনস।

ইতিহাসবিদ তনিকা সরকারের বইটি দুই শতক জুড়ে ভারতীয় উপমহাদেশে লিঙ্গ, ধর্ম এবং রাজনীতির রূপান্তরের বিস্তৃত জরিপ। এই বইয়ের নয়টি অধ্যায় ঔপনিবেশিক ও স্বাধীন ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে অঞ্চলগত, শ্রেণিগত, জাতিগত প্রেক্ষাপট ভিন্নতা সত্ত্বেও পারস্পরিক সম্পর্কে জড়িত ধর্ম, সমাজ, বাজার সম্পর্ক, শ্রম ব্যবস্থা, রাজনৈতিক উত্থান-পতন এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়াগুলি কেমন করে নারীর ইতিহাস ও লিঙ্গের অনুশাসনকে পুনর্বিন্যস্ত করেছিল, তা তুলে ধরেছে।

প্রাক্‌-আধুনিক থেকে ঔপনিবেশিক-পরবর্তী সময় পর্যন্ত ধর্ম, পিতৃতন্ত্র এবং বর্ণ ব্যবস্থা কী ভাবে প্রায় নিরবচ্ছিন্ন ভাবে তাদের প্রভাব সমাজে কায়েম রেখেছে, তা তুলে ধরেছে প্রথম অধ্যায়টি। আইন প্রণয়নের মাধ্যমেই ঔপনিবেশিক শাসন বৈধতা পেতে পারে, সেটা ব্রিটিশ নীতিনির্ধারকরা করলেও ধর্মীয় রীতিনীতি বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপের বিরূপ ফল হতে পারে অনুমান করে তাঁরা রক্ষণশীল ও সংস্কারক, উভয়ের মতামতই নিয়েছিলেন। পার্সি, মুসলিম, খ্রিস্টান ও হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক বা ধর্মীয় নিয়মগুলি কী ভাবে ভারতের ‘ব্যক্তিগত আইন’ গঠনে প্রভাব ফেলেছিল, তা নিয়ে সংক্ষিপ্ত কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা করা হয়েছে দ্বিতীয় অধ্যায়ে। ফলে সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, বিধবাদের পুনর্বিবাহ, সহবাস সম্মতির বয়স, কন্যাশিশু হত্যা, সম্পত্তির অধিকার বিষয়ে সম্প্রদায়গুলির অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ শেষে যে পিতৃতান্ত্রিক কর্তৃত্বই আইনি মর্যাদা পেয়েছিল, তা স্পষ্ট অনুধাবন করা যাচ্ছে। আক্ষেপের বিষয় এই যে, সামাজিক আইন পুনর্বিন্যাসে ঔপনিবেশিক হস্তক্ষেপগুলি অনেক ক্ষেত্রেই অস্পষ্ট থাকায় অধুনা ভারতে তার সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া চোখে পড়ছে। সাম্প্রতিক ঘটনা, যেমন গুজরাত সরকারের প্রেম-বিবাহের জন্য অভিভাবকের বাধ্যতামূলক সম্মতির জন্য বিল, বা শবরীমালা বিতর্কের উল্লেখ পাঠককে ব্যক্তিগত আইনে সরকারি হস্তক্ষেপের প্রকৃতি বুঝতে সাহায্য করে।

তৃতীয় অধ্যায়ে তনিকা সরকার খ্রিস্টান, মুসলিম, শিখ, দলিত এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে রক্ষণশীলতার ইতিহাসকে সংবেদনশীলতার সঙ্গে মূল্যায়ন করার কথা বলেছেন। তৎকালীন সমাজসংস্কারকে আপাত-সীমিত মনে হলেও, অধ্যাপক সরকার মনে করেন যে, এই প্রচেষ্টার ফলেই নারীর শরীর সমাজের চোখে পাঠযোগ্য এবং লিখনযোগ্য দেহে পরিণত হয়েছিল। নারীর অবস্থার পরিবর্তন চাওয়া সমাজসংস্কারকেরা বিপুল সামাজিক ও ধর্মীয় বিরোধিতারও সম্মুখীন হয়েছিলেন। ফলস্বরূপ এঁদের অনেকেই উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত, সমাজ থেকে বহিষ্কৃত ও আত্মীয়দের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সমমনা বন্ধুদের ক্ষুদ্র সংসর্গে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। ঔপনিবেশিক অর্থনীতির রূপান্তরের ফলে মহিলাদের সবেতন শ্রমের অধিকার অর্জন, মহিলা ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীদের দ্বারা ধর্মঘট সংগঠিত করা, অন্যান্য লিঙ্গসমতার দৃষ্টান্ত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কর্মক্ষেত্রে নারী শ্রমের শোষণ, তাঁদের প্রতিরোধের আখ্যানের সারসংক্ষেপ উপস্থাপিত করেছে চতুর্থ অধ্যায়।

পরবর্তী অধ্যায় ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই এবং লখনউয়ের বেগম হজরত মহলের ব্রিটিশবিরোধী পদক্ষেপ থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে নারী সংগঠনগুলিতে, গান্ধীবাদী এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনে, সশস্ত্র বিপ্লবে, হিন্দু ও মুসলিম জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নকে গুরুত্ব সহকারে বর্ণনা করেছে। মহিলাদের সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও যে ভাবে পুরুষ রাজনৈতিক নেতাদের তত্ত্বাবধানে তাঁদের কাজ করতে হত তা যে অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের অধীনতার পুনরুদ্ভবের লক্ষণ, সে দিকেও আলোকপাত করা হয়েছে।

রেলিজিয়ন অ্যান্ড উইমেন ইন ইন্ডিয়া ১৭৮০জ়-১৯৮০জ়: জেন্ডার, ফেথ অ্যান্ড পলিটিক্স

তনিকা সরকার

১০৯৫.০০

পার্মানেন্ট ব্ল্যাক, অশোক ইউনিভার্সিটি

ষষ্ঠ অধ্যায় সমাজ ও রাষ্ট্রের চোখে ভিন্ন ধরনের পৌরুষ ও নারীত্বের ধারণা ও লিঙ্গ-সংস্কৃতির পুনর্নির্মাণ নিয়ে। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, স্বামী বিবেকানন্দ, গৌরী মা, আনন্দময়ী মায়ের মতো আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বের আচরণ যেমন সামাজিক ও পারিবারিক নিয়মকানুনের নিরিখে অস্বাভাবিক ছিল, তেমনই তৃতীয় লিঙ্গভুক্ত মানুষ, দেবদাসী, গণিকা, যৌনকর্মী, সমকামী প্রেমিক এবং কারাগার ও পাগলাগারদের বন্দিদের জীবনযাপন রাষ্ট্রের নজরে অনৈতিক হওয়ার দরুন গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

স্থানীয় মুদ্রণ, স্থানীয় ভাষায় লেখা কথাসাহিত্য, জনপ্রিয় থিয়েটার-জগতের উদ্ভবের ফলে সাংস্কৃতিক পরিসরে লেখিকা এবং অভিনেত্রীরা লিঙ্গসম্পর্কের রূপান্তর কী ভাবে আনতে সক্ষম হন, তা নিয়েই সপ্তম অধ্যায়। বাঙালি রাসসুন্দরী দেবী বা মরাঠি কাশীবাই কানিতকরের আত্মজীবনী যেমন নারীজীবনের জটিল জগৎকে তুলে ধরে, তেমনই নারী রচিত কবিতা, উপন্যাস, সাময়িকী সাহিত্য চ্যালেঞ্জ জানায় পুরুষতান্ত্রিক ধারণায় জারিত লিঙ্গসম্পর্কের চিত্রায়ন, প্রথাগত নৈতিকতা, নারীসুলভ আচরণের ছককে। লেখিকারা এক ইউটোপিয়া নির্মাণ করেন যা সাহিত্যজগতে তাঁদের মত প্রকাশে স্বাধীন ও আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। গোলাপসুন্দরী দাসী, নটী বিনোদিনীর মতো অভিনেত্রীদের থিয়েটারের শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত দর্শকদের মনে সসম্মানে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা আপাতদৃষ্টিতে দ্বিধাগ্রস্ত এবং ক্ষণস্থায়ী মনে হলেও, এই সম্ভাবনাময় মুহূর্তগুলিই ভবিষ্যতের নারীবাদের জন্ম দেয়।

অষ্টম অধ্যায়টি উপনিবেশ-পরবর্তী ভারতে লিঙ্গ-অনুপাতের অসঙ্গতি, কলকারখানায় নারী-শ্রমিকদের ক্রমাগত শোষণ, চিপকো আন্দোলনে নারী, দলিত নারী সংগঠন, অসম সম্পত্তির অধিকার, দমনমূলক লিঙ্গভিত্তিক পারিবারিক সম্পর্ক প্রসঙ্গে। আইনি সংস্কার সত্ত্বেও রূপ কানোয়ারের সতীদাহ, শাহ বানো মামলা, জনজাতিভুক্ত বালিকা মথুরার ধর্ষণকাণ্ডের রায় তুলে ধরার পর নির্ভয়া ধর্ষণ ও হত্যার প্রেক্ষিত, নারী আন্দোলনের ফলে নির্ভয়া আইন প্রণয়ন নিয়েও বিস্তারে আলোচনা করা হয়েছে। বাম আন্দোলনে নারী, নারীবাদী আন্দোলনের উত্থান, উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে আফস্পা-র নিয়োগ, শিখ-বিরোধী ও মুসলিম-বিরোধী দাঙ্গায় নারীদের পরিস্থিতি, সাহিত্য ও সিনেমায় নারী চিত্রায়নে পরিবর্তন সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা দিয়ে এই অধ্যায় শেষ করার আগে লেখক বর্তমানে বৈষম্যমূলক দক্ষিণপন্থী, রক্ষণশীল ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের আস্ফালনের যুগে নারী আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

বইটি শেষ হয়েছে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের রক্ষণশীল ধর্মীয় মূল্যবোধ ও লিঙ্গসম্পর্কের কাঠামোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে। দেখানো হয়েছে যে, পাকিস্তানে লিঙ্গসম্পর্কের পরিবর্তন যেমন ধর্মগ্রন্থের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে হয়েছিল, তেমনই গোঁড়া উলেমারা লিঙ্গ-বিধিবিধানের নির্ধারক হওয়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই পরিবর্তনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান। যেমন, বাংলাদেশে জেনারেল জ়িয়াউর রহমানের সামরিক শাসনকালে সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি বিলোপ করায় কী ভাবে রাষ্ট্রের ইসলামিকরণ শুরু হয়, তাতে আলোকপাত করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নারীর ক্ষমতায়নের কথা বললেও সাধারণ মহিলারা যে ধর্মভীরুতার আড়ালটুকু আশ্রয় করে যেটুকু নারীস্বাধীনতা ও সমতা অর্জন করতে পারেন, সে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, সে দিকেও ইঙ্গিত রয়েছে।

বইটি উপমহাদেশে অতিপৌরুষ জাতীয়তাবাদ, রাজনীতির ধর্মীয়করণ, সাম্প্রদায়িক হিংসার গোড়ার কথাই তুলে ধরেছে। সূক্ষ্ম যুক্তি দিয়ে লেখা বইটিতে অধ্যায়-শেষে কার্যকর পাঠ-তালিকা উৎসুক সাধারণ পাঠককে সমৃদ্ধ করবে। তবে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম এবং ব্যক্তিগত ধর্মীয় বিশ্বাসকে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রেক্ষিতে একই ভাবে উপস্থাপন করা যায় কি না, তা নিয়ে ধন্দ থেকেই যায়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Review

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy