Advertisement
E-Paper

গন্ডার যেন থেকেও নেই

প্রাকৃত ধারণায় গন্ডার নির্বোধ। তার চামড়া সংবেদনহীনতার প্রতীক, আজ কাতুকুতু দিলে সে পরের বছর হাসে! তা দিয়ে বর্ম বানানো চলে; এমনকী নির্লজ্জেরও নাকি ‘গন্ডারের চামড়া’।

যুধাজিৎ দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০০
শিল্পরূপ: মন্দির টেরাকোটায় সাহেবদের গন্ডার শিকারদৃশ্য। মুর্শিদাবাদের বড়নগরে রানি ভবানী প্রতিষ্ঠিত গঙ্গেশ্বর শিবমন্দিরে। বই থেকে

শিল্পরূপ: মন্দির টেরাকোটায় সাহেবদের গন্ডার শিকারদৃশ্য। মুর্শিদাবাদের বড়নগরে রানি ভবানী প্রতিষ্ঠিত গঙ্গেশ্বর শিবমন্দিরে। বই থেকে

গন্ডার নিয়ে একটা সমস্যা আছে। সে থেকেও নেই। শিল্প-ইতিহাসবিদ জোয়াখিম বট্জ় একটা প্রশ্ন তুলেছিলেন সেই ১৯৮৫তে, কেন, এক সময়ে গোটা উপমহাদেশে এমন বিস্তৃত উপস্থিতি সত্ত্বেও গন্ডার— ভারতীয় গন্ডার, রাইনোসেরস ইউনিকর্নিস, এ দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থলচর প্রাণী, আমাদের মনের কোণের এমন বাইরে পড়ে আছে? কেন সে এমনকী কোনও ভারতীয় দেবদেবীর বাহন নয় (বহির্ভারতে, খমের শিল্পে অবশ্য তা অগ্নির বাহন)? কেবল কুৎসিত বলে? তুলনায় ইঁদুর বা মোষ খুব উজ্জ্বলদর্শন কি? আলোচ্য বইতে শিবানী বসু লিখেছেন গুজরাতের এক আঞ্চলিক দেবী, ধাওড়ি মা-র বাহন হিসেবে গন্ডারকে পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু তাতেও সেই প্রান্তিকতার প্রশ্নটা বড় হয়েই উঠল। আমাদের সমৃদ্ধ পৌরাণিক সাহিত্যে সে গৌরবভাস্বর নয়। লৌকিক সাহিত্যেও না। অথচ কেলি এনরাইট (রাইনোসেরস, ২০০৮) দেখিয়েছেন ভারতীয় গন্ডারের কাহিনি ইউরোপে গিয়ে ইউনিকর্ন-এর মিথের জন্ম দিয়ে এবং পক্ষীরাজতুল্য চেহারা গ্রহণ করে ঘৃণার বদলে জনাদর পেয়ে গিয়েছিল। সংস্কৃত সাহিত্যে গন্ডারের একটা নাম খড়্গ— বট্‌জ় লিখেছিলেন, সেটি সম্ভবত ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর শব্দ নয়; বেদে এর আর-এক নাম পরস্বত। এমন প্রকাণ্ড একটা প্রাণী কেন এমন অবহেলার শিকার হল?

প্রাকৃত ধারণায় গন্ডার নির্বোধ। তার চামড়া সংবেদনহীনতার প্রতীক, আজ কাতুকুতু দিলে সে পরের বছর হাসে! তা দিয়ে বর্ম বানানো চলে; এমনকী নির্লজ্জেরও নাকি ‘গন্ডারের চামড়া’। তাকে খাওয়া চলে, সম্মান করা চলে না। প্রত্নযুগ থেকে গন্ডারের মাংস খাওয়ার প্রমাণ আছে। তাকে মেরে পরাক্রম প্রকাশ করা চলে, গুহাচিত্রে মুদ্রায় ভাস্কর্যে তার স্থায়ী ছাপ আছে অনেক। প্রথম কুমারগুপ্তের স্বর্ণমুদ্রায় তাঁকে দেখি অশ্বারূঢ় অবস্থায় একটি ভ্যাবাচ্যাকা-খাওয়া গন্ডার নিধনে রত, সম্ভবত এর আগে চন্দ্রগুপ্ত-সমুদ্রগুপ্ত তাঁদের মুদ্রায় আগেই সিংহ এবং বাঘ মেরে এ ছাড়া তাঁর জন্য আর কোনও পথ খোলা রাখেননি। প্রায় হাল আমলের নেপালেও গন্ডার মেরে তার শরীর চিরে তখনও স্পন্দমান হৃৎপিণ্ড বার করে এনে সেই রক্তে তর্পণ করা ওখানকার রাজপরিবারের এক প্রাচীন আচার ছিল (কেলি এনরাইট লিখেছেন, রাজা নিহত গন্ডারটির উন্মুক্ত করে দেওয়া বক্ষপিঞ্জরের মধ্যে গিয়ে বসতেন)। নেপালে গন্ডার সংরক্ষণের পিছনে এই আচারের ভূমিকাও গৌণ নয়। তবুও, গন্ডার যেন বাইরের কেউ। হতে পারে, গন্ডারের ভেতর এমন একটা প্রাগৈতিহাসিক-পনা আছে, ডাইনোসরের মতো, যা একটা আড়াল তৈরি করে। বিলুপ্তিসূচক যবনিকা পড়ে যাওয়ার পরেও মঞ্চে থেকে যাওয়া একটা চরিত্র যেন, যাকে আমাদের সচেতন মনন অগ্রাহ্য করে চলেছে। দ্য স্টোরি অব ইন্ডিয়াজ় ইউনিকর্নস আমাদের সেই সামূহিক নির্বেদে একটা ঝাঁকুনি দিতে পারে।

গ্রন্থের লেখক-নির্বাচন থেকে বিষয়বিন্যাস ও বিভিন্ন প্যারাটেক্সট, অজস্র মুদ্রিত চিত্রাবলি সঙ্গত ভাবনাচিন্তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। দিব্যভানুসিন বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ ও গবেষণায় লব্ধপ্রতিষ্ঠ মানুষ, শিবানী বসু ইতিহাসের গবেষক, অশোককুমার দাস একজন সুখ্যাত শিল্প-ইতিহাসবিদ ও প্রাবন্ধিক। প্রায় চল্লিশ হাজার বছর জুড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে প্রাচীন সাহিত্য-চিত্র-ভাস্কর্যে এই উপমহাদেশে গন্ডারের প্রামাণ্য উপস্থিতি, প্রকৃতিতে গন্ডারের অবস্থান, তাদের আজকের দশা ও বিপন্ন এই প্রাণীটিকে সংরক্ষণের আঞ্চলিক তথা আন্তর্জাতিক উদ্যোগের বর্ণনা যথাযথ ভাবে, কোথাও এতটুকু খেই না হারিয়ে ও বাহুল্য না রেখে এখানে পরিবেশিত।

দ্য স্টোরি অব ইন্ডিয়াজ় ইউনিকর্নস দিব্যভানুসিন, অশোককুমার দাস ও শিবানী বসু ২০০০.০০ মার্গ পাবলিকেশনস, মুম্বই

পৃথিবীর পাঁচ রকম গন্ডার প্রজাতির মধ্যে— আফ্রিকায় দু’রকমের দ্বিশৃঙ্গ গন্ডার, এশিয়ায় জাভার গন্ডার, সুমাত্রার দ্বিশৃঙ্গ গন্ডার ও ভারতীয় গন্ডার— শেষ তিনটিকেই একদিন ভারতে পাওয়া যেত, বাংলাতেও। এটা জানার পর নিজেদেরই প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, কোথায় হারিয়ে ফেললাম আমরা তাদের? এমনকী উনিশ শতকের শেষেও বাংলায়— সুন্দরবনে, মেদিনীপুরের একাংশে, জাভার গন্ডারের উপস্থিতির উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। সুমাত্রা গন্ডার উত্তর অসমে এমনকী চট্টগ্রামে টিকে ছিল কাছাকাছি সময় অবধি।

এক সময়ে ভারতীয় গন্ডারের বাসভূমি ছিল গোটা উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ নদী-অববাহিকাগুলির জলা ও বাদা অঞ্চলে, পঞ্জাবে, এমনকী আজকের পাকিস্তানেও। সিন্ধু সভ্যতা থেকে পাওয়া ৬ শতাংশেরও বেশি সিলমোহরে গন্ডারের উপস্থিতি, বিখ্যাত ‘পশুপতি’ ফলকেও। এখানকার যে সব সিলমোহর সুদূর সুমেরীয় প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চল থেকে মিলেছে, সেখানকার একটি ফলকে দেখা যাচ্ছে ঘড়িয়ালের সঙ্গে গন্ডারের সহাবস্থান। বাদাবনে গন্ডার থাকবে সেটা স্বাভাবিক, কিন্তু কালিবঙ্গান নগর থেকে বেরোচ্ছে গন্ডারের দেহাবশেষ। সিন্ধু সভ্যতায় গন্ডার পোষা হত কি না তা স্পষ্ট হয়নি আজও, হতে পারে খাওয়া হত। বট্জ় দেখিয়েছিলেন, প্রাগৈতিহাসিক গুহাচিত্রে, হরপ্পা সভ্যতার সিলমোহরে এই যে গন্ডারের প্রাচুর্য, তার পর হঠাৎই তা যেন স্তিমিত হয়ে গেল। অনেক পরে, মুঘল যুগের চিত্রকলায় শিকারদৃশ্যগুলিতে আবার তার প্রত্যাবর্তন। যদিও, প্রথম কুমারগুপ্তের (পঞ্চম শতক) মুদ্রায়, বা তারও আগে চন্দ্রকেতুগড়ের (প্রথম খ্রিস্ট পূর্বাব্দ থেকে প্রথম খ্রিস্টাব্দের মধ্যে) টেরাকোটায় সে তার অসুন্দর সারল্য নিয়ে উপস্থিত।

অশোককুমার দাস ও শিবানী বসু প্রত্ননমুনায় এবং বিভিন্ন মাধ্যমে রূপায়িত শিল্পকৃতিতে গন্ডারের রূপ ও দেহাবশেষ খুঁজেছেন, বিভিন্ন পর্যটকের বর্ণনায়, প্রাচীন বিবৃতিতে এর উল্লেখ থেকে টুকরো টুকরো ছবি গড়ে উপহার দিয়েছেন আমাদের। কেবল বর্ণনা নয়, সংশ্লিষ্ট চিত্র-ভাস্কর্য-মুদ্রা-প্রত্নতাত্ত্বিক নমুনাগুলির প্রতিরূপ এ বইয়ের মূল্য বাড়িয়েছে। মুঘল ও অন্যান্য ধারার শিল্পে গন্ডার নিয়ে অশোককুমার দাসের চিত্তাকর্ষক আলোচনায় কিছু চিত্ররহস্য উঠে আসে— যুবরাজ সেলিমের শিকারদৃশ্যে যেমন সিংহ আর গন্ডারের সহাবস্থান, যা বাস্তবে অসম্ভব ছিল।

এই উপমহাদেশে আজ ভারতীয় গন্ডারের বিচরণক্ষেত্র কেবল ভারত ও নেপাল মিলিয়ে দশটি বিচ্ছিন্ন সংরক্ষিত এলাকায় গিয়ে ঠেকেছে। হরিণের মাংস যদি তার বৈরী হয়, গন্ডারের বৈরী তার খড়্গ। এর নানা ‘ধন্বন্তরী’ গুণ সংক্রান্ত প্রবাদের বয়স বেশি নয়, কিন্তু আজ সেটাই এদের প্রাণের প্রতিবন্ধক।

রাজন্যবর্গের হাতে নির্বিচার শিকারের ফলে বিশ শতকের গোড়ায় ভারতে এদের সংখ্যা নেমে এসেছিল মাত্র দুশোয়! প্রাণপণ সংরক্ষণ চেষ্টায় আজ নেপাল ও ভারত মিলিয়ে এদের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজারের বেশি। অসমের কাজিরাঙা থেকে (সব থেকে বেশি গন্ডার এখন এখানেই আছে, ২৪০০) অন্যত্র, যেমন উত্তরপ্রদেশের দুধওয়ায়, এদের পুনর্বাসনের চেষ্টা চলেছে আংশিক সাফল্যের সঙ্গে, কিন্তু এ দিকে প্রাদেশিক গরিমার ভাগ ছাড়তে নারাজ অসম এখন আর বাইরে কোথাও তাদের পাঠাতে চায় না। মাত্র একটি-দু’টি এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকা কোনও বন্যপ্রাণীর পক্ষেই কল্যাণকর নয়। ‘‘কোনও প্রজাতির সংখ্যা যদি এমন মাত্রায় নেমে আসে যে একটা-দুটো করে তাদের আলাদা ভাবে গুনে ফেলা যায় তো সেটাই একটা স্পষ্ট আর জোরালো বিপদসঙ্কেত, আমরা সকলে তা শুনতে পাচ্ছি’’, লিখেছেন দিব্যভানুসিন। এই সুদর্শন ও একই সঙ্গে জরুরি গ্রন্থটি সেই ঘণ্টাধ্বনি ছড়িয়ে দেওয়া এবং লৌকিক মননে গন্ডারকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার কাজে সফল হবে আশা করি।

Book Review Rhinoceros
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy