সাম্রাজ্যের ভাঙাগড়া বা অভিজাতদের জীবনচর্যা রচনায় বহু দিন থেকেই আর ইতিহাসবিদদের তেমন গরজ নেই। সাধারণ মানুষের সামাজিক রীতিনীতি, দৈনন্দিন অভ্যাস, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, কিংবা নিম্নবর্গের যে অনুচ্চ জীবন, তা-ই আজ ইতিহাসবিদদের সামাজিক অন্বেষার অন্যতম অনুষঙ্গ। আরও সাম্প্রতিক কালে, ইতিহাসবিদরা অনুসন্ধান করতে এগিয়ে এলেন, কী ভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চালিকাশক্তি গুরুত্বপূর্ণ সমাজ পরিবর্তনের অন্যতম নির্ণায়ক হয়ে উঠতে পারে। সেই পরম্পরা অনুসরণ করেই শুভব্রত সরকার ব্রতী হয়েছেন একটি নতুন ধরনের গবেষণা-কর্মে, যার বিষয়বস্তু হল ঔপনিবেশিক বাংলায় ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পোদ্যোগ ও বিদ্যুদয়নের সামাজিক অভিঘাত।
এই আলোচনার সূচনাবিন্দু ১৮৮০ সাল, কেননা ওই বছরই দুর্ভিক্ষ কমিশন প্রথম বার স্পষ্ট ভাষায় কবুল করে যে, এ দেশের বৈষয়িক উন্নতির অভাব আর শিল্পায়নের অনটনের জন্য দায়ী হল কারিগরি বিদ্যা আর প্রযুক্তির অপ্রতুলতা। কারিগরি বিদ্যা বলতে এ যাবৎ শুধু সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বোঝাত। ১৮৮০ সালের পর থেকেই, লেখকের মতে, এ দেশে ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার নানা শাখা— মেক্যানিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল, মাইনিং ইত্যাদি— খুলে যায়। আর এই সময় থেকেই ছোট আর মাঝারি মাপের বহু বাঙালি উদ্যোগপতি নিজেদের ব্যবসায়িক উন্নয়নে আধুনিক প্রয়োগশাস্ত্রের কৃৎকৌশল কাজে লাগালেন। এঁরা প্রমাণ করেছিলেন, ঔপনিবেশিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বাঙালি জাতির মধ্যে শিল্প-উদ্যোগের খামতি ছিল না।
বইটিতে মূল পাঁচটি অধ্যায়। প্রথম অধ্যায়ে বাংলার আধুনিক কারিগরি বিদ্যার প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে লেখক শিবপুরের বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও যাদবপুরের কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি-র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। বলেছেন ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার বিবর্তনে এক দিকে সরকারি আমলা ও প্রযুক্তিবিদদের ঔপনিবেশিক স্বার্থ, আর অন্য দিকে ভারতীয় বিজ্ঞানী ও কারিগরীবিদদের জাতীয় আকাঙ্ক্ষার টানাপড়েনের কথা। বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মামুলি বুনিয়াদি শিক্ষাক্রমে কলকাতার শহুরে বুদ্ধিজীবীরা সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাঁরা দাবি করেছিলেন আধুনিক উন্নততর প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ। ব্যর্থমনোরথ হয়ে তাঁরা শেষ পর্যন্ত দেশীয় উদ্যোগে ও দেশীয় পরিচালনায় উচ্চতর কারিগরি শিক্ষার সঙ্কল্প নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশন, যা পরে হয়ে ওঠে যাদবপুর কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি।