প্রতীকী ছবি।
হোমারের ওডিসি-তে রয়েছে, সুবর্ণভেড়ার লোমের সন্ধানে যাচ্ছে জেসন। এই আখ্যানে গ্রিকদের ভ্রমণ বা পর্যটনের ঐতিহ্যই ফুটে ওঠে, জানাচ্ছে নিউ ক্যাথলিক এনসাইক্লোপিডিয়া। কিংবদন্তির বেড়া ডিঙিয়ে ক্রমে ধর্মীয় আকাঙ্ক্ষা, তীর্থযাত্রা, নান্দনিক ভ্রমণ ইত্যাদি ধাপ পেরিয়ে উনিশ শতকে বদল এল জনতার অর্থনীতি, সমাজ ও মননে। এই সূত্রেই গণপর্যটনের ধারণার বিস্তার; ‘চেঞ্জ’-এ যাওয়া বা হাওয়াবদলের ধারণারও। আনন্দ, স্বাস্থ্য উদ্ধার বা অবকাশ যাপন, না কি অন্য কিছুর জন্য বাঙালির হাওয়াবদলের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে গেল ‘পশ্চিম’? কী ভাবেই বা হাওয়াবদল থেকে তৈরি হল বাঙালির উপনিবেশ? ১৮৮০-১৯৬০ পর্বে তার সন্ধান করে বইটি। এই সন্ধান মূল চারটি অধ্যায়ে চারটি প্রশ্ন সামনে রেখে: এক, বাঙালির পশ্চিম-যাত্রার সঙ্গে উনিশ শতকের ইংল্যান্ডে সৈকতাবাসে যাওয়ার মিল-অমিল কোথায়। দুই, শিল্পায়নের প্রভাবে ইংল্যান্ডে গণপর্যটনের বিস্তারের সঙ্গে ঔপনিবেশিক বাংলার আর্থ-সামাজিক বদল ও সেই সূত্রে হাওয়াবদলের মধ্যে সাদৃশ্য আছে কি না। তিন, ভ্রমণের তাত্ত্বিক সংজ্ঞার সঙ্গে বাঙালির এই পশ্চিম-ভাবনা মিলছে কি না; চার, পশ্চিম-প্রীতির নেপথ্য তাৎপর্য আছে কি?
বাঙালির ‘পশ্চিম’: হাওয়াবদল থেকে উপনিবেশ (১৮৮০-১৯৬০)
দীপাঞ্জন বাগ
৩৫০.০০
পঞ্চালিকা প্রকাশনী
উত্তর সন্ধানে লেখকের মূল উপাদান স্মৃতিকথা, সরকারি নথি, সমকালীন পত্রপত্রিকা, চিঠি, সাহিত্য, সাক্ষাৎকার; পূর্ব ঝাড়খণ্ডে, গিরিডিতে করা ক্ষেত্রসমীক্ষাও। এখানে বাঙালির পশ্চিমের ভৌগোলিক সীমাটি বর্তমান বিহার-ঝাড়খণ্ডের কিছু এলাকা। এই ভূখণ্ড চয়নের কারণ? সাধারণত কোথাও যাওয়ার সঙ্গে ‘পুশ ফ্যাক্টর’ ও ‘পুল ফ্যাক্টর’-এর ধারণাটি লগ্ন। ‘পুশ ফ্যাক্টর’-এর সঙ্গে জড়িত বাধ্যবাধকতার বিষয়, বাঙালির ক্ষেত্রে তা কী? চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির উৎপত্তি, পাশ্চাত্য শিক্ষা ও রেলপথের বিস্তার বাঙালির আর্থ-সামাজিক কাঠামো বদলে দেয়। বিলিতি সংস্কৃতির সঙ্গে চলার আকাঙ্ক্ষাও তৈরি হয়। বাঙালির হাওয়াবদল অনিবার্য করে তোলে বাংলায় কলেরা, কালাজ্বর, বসন্ত, প্লেগ, ম্যালেরিয়ার প্রকোপও। অর্থাৎ বাঙালির ক্ষেত্রে হাওয়াবদলের বাধ্যবাধকতাটি সামাজিক, আবার স্বাস্থ্য সংক্রান্তও। আর ‘পুল ফ্যাক্টর’-এর মূল কারণ মানুষের মনোবাঞ্ছা পূরণ, জীবিকাগত প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথের ঘাটশিলা যাওয়া, রাজনারায়ণ বসুর দেওঘরে অবসর যাপনের উদাহরণ দেন লেখক। এই যাওয়া-আসা কী ভাবে ‘আবাস’ হচ্ছে, লেখক তা-ও দেখান নীলমণি মিত্র, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, গঙ্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখের মধুপুর-যাপনের প্রসঙ্গে; গিরিডি, হাজারিবাগ, দেওঘর, কর্মাটাঁড়, ঘাটশিলা প্রভৃতি স্থান এবং উল্লিখিত সময়পর্বের বিখ্যাত বাঙালিদের প্রসঙ্গেও। পশ্চিমে বাঙালি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে এলাকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাস্তাঘাট, প্রশাসনে। পাশাপাশি, যে ‘পুল ফ্যাক্টর’-এর কথা বলা হয়েছিল, লেখক তা স্পষ্ট করেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল কর, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের লেখালিখির আলোয়।
যা ছিল নিছক হাওয়াবদল, তা-ই হল বাঙালির এক টুকরো উপনিবেশ। এই উপনিবেশ পশ্চিমি ঔপনিবেশিকতার ছাঁচে ঢালা নয়, বরং এর সঙ্গে মিল আছে প্রাচীন গ্রিক উপনিবেশের, যা ছিল একটি জনগোষ্ঠীর মননশীলতার প্রতিবিম্ব। সেই প্রতিবিম্বেই বইটি বাঙালির বৌদ্ধিক ও কর্মজগতের একটি স্বল্পালোচিত বিষয়কে দেখতে চায়। এই উপনিবেশ ভেঙে গেল কেন, তার কারণ সন্ধানেরও চেষ্টা করে।
নজরে
ক্রিস্টোফার মিমস আমেরিকান সাংবাদিক। বিজ্ঞানের ছাত্র, সাংবাদিকতাও প্রযুক্তির পরিসরেই। ২০২০-র গোড়ায় তিনি একটি ইউএসবি চার্জার-এর পিছু নিয়েছিলেন। তাঁর দেশের এক প্রান্তে বসে কোনও ক্রেতা সেটির অর্ডার দিয়েছেন ডিজিটাল কারবারির কাছে। অতঃপর চোদ্দো হাজার মাইল পথ পেরিয়ে মাস দুয়েক পরে ক্রেতার মোবাইলে এল সেই ইচ্ছাপূরণের বার্তা: অ্যারাইভিং টুডে— আজ আপনার জিনিসটি আপনার কাছে পৌঁছচ্ছে। অতঃপর, দরজায় কলিং বেল। সাংবাদিকের অভিযান সমাপ্ত।
ইউএসবি চার্জার উপলক্ষমাত্র। দুনিয়া জুড়ে অহোরাত্র দৌড়চ্ছে কোটি কোটি পণ্য, বছরে অন্তত দশ হাজার কোটি পার্সেল। শ’তিনেক পৃষ্ঠায় এই দৌড়ের দিনলিপি লিখেছেন ক্রিস্টোফার। অতিকায় কন্টেনার জাহাজ থেকে বন্দরে খালাস হয়ে অতিকায় ট্রাকে চেপে অতিকায় মালখানায় পৌঁছনো, তার পরে রকমারি ট্রাকযোগে বিভিন্ন অঞ্চলে মালখানায় যাওয়া, একাধিক স্তর পেরিয়ে ক্রেতার দরজায় হাজির হওয়া— এই সমগ্র প্রক্রিয়াটির খুঁটিনাটি অনুপুঙ্খ ভাবে দেখেছেন এবং সে ভাবেই লিখেছেন ক্রিস। স্তম্ভিত করে দেয় সরবরাহ-প্রযুক্তির আশ্চর্য মহিমা, যার দৌলতে আমরা আজ যা চাই তা-ই নিমেষে হাতে পেয়ে যাই।
অ্যারাইভিং টুডেক্রিস্টোফার মিমস
৫৯৯.০০
হার্পার কলিন্স
তার চেয়েও বেশি স্তম্ভিত করে দেয় এই আশ্চর্য কারবারের দুরন্ত ঘূর্ণিপাকে নিরন্তর ঘুরতে থাকা জাহাজ, বন্দর, পরিবহণ ও মালখানার কর্মীদের দৈনন্দিন জীবনের বিবরণী। তাঁরা প্রতি মুহূর্তে প্রযুক্তির নির্দেশে চালিত, যন্ত্রের পাকে বাঁধা। সেই প্রযুক্তি উত্তরোত্তর উন্নত হচ্ছে, যন্ত্র ক্রমাগত কুশলী হচ্ছে, কর্মীর উপর চাপ বাড়ছে। যুগপৎ কাজের চাপ ও ছাঁটাইয়ের চাপ। বইয়ের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে দুনিয়ার এক নম্বর ডিজিটাল বাণিজ্য সংস্থাটির ভিতরের খবর, যা একই সঙ্গে রোমাঞ্চ ও বিবমিষা জাগায়। যেমন, একটি ছোট্ট সংবাদ: দু’টি ওষুধ তার কর্মীদের খুব কাজে লাগে, একটি ব্যথা কমানোর, অন্যটি শৌচাগারে যাওয়ার প্রয়োজন নিয়ন্ত্রণের। ক্রিস ভূমিকায় লিখেছেন, এ বই পড়ার পরে দরজা খুলে ডেলিভারি পার্সেলটি হাতে নেওয়ার সময় আপনাকে এক বার মনে মনে শিউরে উঠতেই হবে। ভুল লেখেননি। মনের বালাই ঘুচিয়ে দিতে পারলে অবশ্য আর সমস্যা থাকে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy