জনপ্রিয় সংস্কৃতি— যা অধিকাংশ মানুষকে মাতিয়ে রাখে বা তাদের বিনোদন জোগায়— তা নিয়ে তাত্ত্বিক মাথাব্যথার মেয়াদ পাশ্চাত্যেও খুব পুরনো নয়। তার সূত্রপাত গত শতকের ষাটের দশকে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুল, রেমন্ড উইলিয়ামস, স্টুয়ার্ট হল-এর হাত ধরে। আশির দশকে উত্তর-আধুনিকতার প্রভাব উচ্চ আর নিম্নমানের শিল্প-সঙ্গীত-সাহিত্যের মধ্যে স্থাপিত মূল্যায়নের ব্যবধান ভেঙে দিতে চেয়েছিল। জনপ্রিয় সংস্কৃতি-তত্ত্ব বারংবার প্রমাণ করার প্রয়াস করেছে: নিম্নবর্গের বা অতীব জনপ্রিয় কলাকৃষ্টির আনাচে-কানাচেও বহু গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক তথ্য লুকিয়ে। তার পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে উন্মোচিত হতে পারে নানা সামাজিক বৈষম্য, ব্যবধান ও পক্ষপাত। মানুষ যে শিল্প, সঙ্গীত, সাহিত্য, নৃত্য, চলচ্চিত্র, পোশাক, উৎসব ইত্যাদি বরণ করেছে বা তার মধ্যে অন্তর্নিহিত অর্থ খুঁজে পেয়েছে— তাকে ধাওয়া করা। যা এতশত মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে জড়িত, তার মধ্যে নিহিত অর্থ, আনন্দ, প্রতিরোধ ও তত্ত্বের অনুসন্ধান করার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা আছে।
কিন্তু সমস্যা হল, বিগত পাঁচ দশকে এ দেশে, জনপ্রিয় সংস্কৃতি-কেন্দ্রিক চিন্তনের ধারা আটকা পড়ে রইল একটি নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে। রিকশা-চিত্র, ক্যালেন্ডার-চিত্র, ট্রাক-চিত্র; দেওয়ালচিত্র, দেশলাই-চিত্র, বি বা সি-গ্রেড চলচ্চিত্রের গণ্ডি অতিক্রম করতে পারলাম না আমরা। অধ্যাপককে বার বার ছুটতে হল প্রান্তিক ও নিম্নবর্গের ‘অপর’ সংস্কৃতির সন্ধানে— পাশ্চাত্যের স্বীকৃতি পেতে। তাঁদের নিজেদের দেহ, সাজ, গৃহসজ্জা, আনুষঙ্গিক বস্তু, ক্রয়-প্রবৃত্তি— থেকে গেল ব্রাত্য হয়ে। প্রান্তিক মানুষের নীতি, নৈতিকতা, কণ্ঠের দায়িত্ব নিতে হবে, নিজের অস্তিত্ব-সম্বন্ধীয় সঙ্কটগুলি উপেক্ষা করে— তবে না অ্যাকাডেমিক মাহাত্ম্য!
এই দীর্ঘ প্রস্তাবনার প্রয়োজন ছিল অবিন চক্রবর্তী, রামানুজ কোনার এবং সায়ন আইচ ভৌমিক সম্পাদিত আলোচ্য বইটির পর্যালোচনায় আসার আগে। কারণ বইটি এ যুগের এবং মধ্যবিত্তের নিকটের এমন অনেক বিষয়বস্তু তুলে ধরেছে, যা নিয়ে অ্যাকাডেমিক চিন্তাভাবনার তালিকা এ দেশে এখনও তেমন সুদীর্ঘ নয়। এই যেমন: গ্রাফিক নভেল, সুপারহিরো, চিক-লিট, ইনস্টা-কাব্য, গেমিং, মিম, ভিএফএক্স, ওয়েব সিরিজ়, জনপ্রিয় ছবিতে নির্বাচিত নারীচরিত্র, জনপ্রিয় ছবিতে জাতীয়তাবাদ, ২৪X৭ উগ্র খবরের কারখানা, ফুটবল ফ্যান ক্লাব ইত্যাদি। এই বিষয়গত বাছাই এক ধরনের অভিনবত্বের সাক্ষ্য দেয়। এই নির্বাচিত বিষয়বস্তু সকলই আপনার-আমার জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত। আমাদের চাওয়া না-চাওয়াকে উপেক্ষা করে, বিভিন্ন স্ক্রিন মারফত ‘কনটেন্ট’-এর ফোয়ারা আমাদের হাতের মুঠোয় ও মননে উপস্থিত।
পোস্টকলোনিয়াল পপুলার কালচার ইন ইন্ডিয়া
সম্পা: অবিন চক্রবর্তী, রামানুজ কোনার, সায়ন আইচ ভৌমিক
১১২০.০০
ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান
যদিও, সূচি দেখে মুগ্ধ হলেও পাতা উল্টে তেমন তাত্ত্বিক গভীরতার ছাপ পেলাম না। শাসকশ্রেণি ও পুঁজিবাদের স্বার্থকে তোল্লাই দিয়ে বোকা বাক্স বোকা বানাচ্ছে— এ তর্কটি বুঝতে এখন আর তাত্ত্বিক মধ্যস্থতা লাগে না। জনপ্রিয় সংস্কৃতির বহর সুপ্রসারিত ডিজিটাল জমানায়। অহরহ নির্মিত হচ্ছে নব্যধারা, যা ক্ষণস্থায়ী, খুব দ্রুত পরিবর্তনশীল। পর্যবেক্ষণ শেষ হওয়ার আগেই পাল্টে যাচ্ছে তার গতিপ্রকৃতি। এ-হেন অবস্থায় একবিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় সংস্কৃতির ব্যাখ্যা বিংশ শতাব্দীর তাত্ত্বিক ছায়ায় সম্ভব নয়।
অভিনব জনপ্রিয় সংস্কৃতির বিস্তার ভীষণ ভাবে দাবি করে পরস্পর-নির্মিত ও পরস্পর-নির্ভরশীল সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যা— যেগুলি এখানে উপস্থিত নয়। যা থাকলে এত বৈচিত্রময় অধ্যায়গুলি কেন একই বইতে সহ-বাস করছে তার উত্তর পেতে সুবিধে হত। কী সেই পরস্পর-নির্ভরশীল ব্যাখ্যা, যার অভাব? প্রথমত, জনপ্রিয় সংস্কৃতির নির্মাতা, পরিবেশক ও ক্রেতা— এই তিনের মধ্যে চিরাচরিত ব্যবধান এখন অনেক ক্ষেত্রেই বিলীন। সেলফি থেকে রিল, মিম থেকে জিম-ছবি— যে তুলছে, যে বানাচ্ছে, যে সম্পাদনা করেছে, যে বিলোচ্ছে, আর যে বা যারা স্ক্রিনে ডুবে তা গিলছে— এদের সকলের সমন্বয় ঘটেছে। রাষ্ট্র বা বাজার, পরিষেবা বা প্ল্যাটফর্ম প্রদান করেছে— বাকিটা মানুষ নিজগুণে, শৈলীতে, তাগিদে বুঝে নিচ্ছে, বেছে নিচ্ছে, মেতে থাকছে, মাতিয়ে দিচ্ছে। মৌলিক ডিজিটাল কনটেন্ট বলে কিছু হয় না। জনপ্রিয় গান থেকে সাক্ষাৎকার, নেতার ভাষণ থেকে সংবাদমাধ্যমের খবর, জনপ্রিয় দৃশ্য থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত যা কিছু— সকলকেই কেটে, ছেঁটে, তার অংশবিশেষ ব্যবহার করে, তাকে ভেঙেচুরে তৈরি হচ্ছে কনটেন্ট। তা নিয়ে ব্যঙ্গ করা সম্ভব; তাকে ভিন্নরূপে পরিবেশিত করা সম্ভব। তাকে বিকৃত বা আঞ্চলিক ভাবে আপন করে নিয়ে নিজের কৃতিত্ব ফলানো সম্ভব।
উত্তর-সত্য জমানায় সত্যের উত্তরণ ঘটেছে নকলের মাধ্যমে। সেখানে কোনও নৈতিক ছুতমার্গ নেই। সকল স্থির, অস্থির ও চলন্ত চিত্রই পরিবেশিত হতে পারে অতি-মধ্যস্থতায়। পুনর্মধ্যস্থতায় তা হয়ে উঠতে পারে অতি-বাস্তব, বিকট-বাস্তব। প্রযুক্তির এই অভূতপূর্ব স্বাধীনতা বা ছাড় আমাদের নিয়ে আসে দ্বিতীয় সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যার দোরগোড়ায়। নির্মাতা ও তার নির্মাণদর্শন এখন গৌণ। মানুষ মুঠোফোনে যা পাচ্ছে যদি সেটাকে দুমড়ে মুচড়ে নিতে পারে, তা হলে নির্মাতা কী ভেবে, কার কথা ভেবে কী বানিয়েছিল, সেটা অপ্রাসঙ্গিক। ক্রেতা-শিল্পী তা হাতে পেয়ে, সেটাকে নিয়ে সক্রিয় ভাবে তার কী মানে করছেন ও কেন— সেটাই আজ জনপ্রিয় সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণার মূল প্রশ্ন। যার বিশ্লেষণ এই বইয়ে পাওয়া গেল না। যে দুই অনুপস্থিত ব্যাখ্যা-ধারার কথা উল্লেখ করলাম, তাদের সম্মেলন এই বইতে পেলে, তা অধ্যায়গুলিকে আরও সমৃদ্ধ ও সংযুক্ত করতে পারত। কারণ— জনগণের অংশগ্রহণ, তাদের সক্রিয়তা ও অর্থপূর্ণ মধ্যস্থতার বিশ্লেষণ বাদ রেখে জনপ্রিয় সংস্কৃতির উপর গবেষণা ডিজিটাল যুগে অসম্ভব।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)