E-Paper

চিকিৎসার সঙ্গে সমাজমন নির্মাণ

এশিয়া মহাদেশের প্রথম ইউরোপীয় আধুনিকতা-প্রসূত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজের প্রথম পঁচাত্তর বছর নিয়ে লেখা, দশ পরিচ্ছেদের বইটি কেবল এই কলেজ নিয়েই নয়।

কুমার রাণা

শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৯:০৩
—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাকে ঐতিহাসিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার ব্যাপারে যে কতিপয় লেখক কাজ করে চলেছেন, জয়ন্ত ভট্টাচার্য তাঁদের অন্যতম। চিকিৎসা তাঁর পেশা। সেই সুবাদে তিনি স্বাস্থ্যের জৈব সম্পর্কগুলোর পাশাপাশি তার সামাজিক সম্পর্কগুলো সম্পর্কে অবহিত। পাশাপাশি, স্বাস্থ্য পরিচর্যায় চিকিৎসার ভূমিকাটিও কী ভাবে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়, সেই অনুসন্ধানটিও তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এই অনুধাবন থেকেই তিনি শরণ নেন ইতিহাসের। অতীতের গতিপ্রকৃতির সঙ্গে পরিচিতি ছাড়া বর্তমানকে জানা ও তাকে মানবিক ভাবে পরিবর্তিত করার কথা ভাবাই যায় না। এই অনুধাবনই তাঁকে টেনে নিয়ে যায় স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সম্পর্কিত ইতিহাসের অধ্যয়নে। সেই অধ্যয়নের ফসল আলোচ্য বইটি।

দ্য ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ ১৮২২-১৮৯৭: মেডিসিন, সোশ্যাল সাইকি, অ্যান্ড দ্য মেকিং অব মডার্ন সিটিজ়েনরি

জয়ন্ত ভট্টাচার্য

১৭৫০.০০

প্রাইমাস

এশিয়া মহাদেশের প্রথম ইউরোপীয় আধুনিকতা-প্রসূত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজের প্রথম পঁচাত্তর বছর নিয়ে লেখা, দশ পরিচ্ছেদের বইটি কেবল এই কলেজ নিয়েই নয়। এর আলোচ্য, চিকিৎসা, সামাজিক মনোজগৎ এবং আধুনিক নাগরিকের নির্মাণের কাহিনি। ১৮২২-এ প্রতিষ্ঠিত নেটিভ মেডিক্যাল কলেজ থেকে ১৮৩৫-এ ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ হিসেবে আত্মপ্রকাশের বিবরণে লেখক তুলে ধরছেন চিকিৎসার সঙ্গে রাজনৈতিক দর্শনের নিবিড় সম্পর্কটিকে। মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার পিছনে, লেখক দেখাচ্ছেন, অন্যতম প্রধান ভূমিকা ছিল ভারতের প্রথম বড়লাট উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের। তিনি ছিলেন তৃপ্তিযোগবাদী রাজনৈতিক দর্শনের উদ্গাতা জেরেমি বেনথামের অনুগামী। তৃপ্তিযোগবাদী দার্শনিক উপলব্ধি তাঁকে জ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগের দিকে নিয়ে যায়, এবং তিনি তৎকালীন ইউরোপে সদ্য-আবির্ভূত আধুনিক চিকিৎসা-র প্রায়োগিক ক্ষেত্র হিসেবে মেডিক্যাল কলেজ গড়ে তোলার দিকে ঝোঁকেন। অবশ্যই অন্য অনেকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা এতে ছিল। বস্তুত, মেডিক্যাল কলেজের প্রতিষ্ঠা ছিল ইউরোপে প্রথাগত চিকিৎসাকে অপসৃত করে, প্যারিসে প্রথম গড়ে ওঠা আধুনিক ‘হসপিটাল মেডিসিন’-এর অগ্রগতির ধারাবাহিকতা। আগে যে চিকিৎসা ছিল লক্ষণ-নির্ভর, নানা লক্ষণ দেখে রোগীর চিকিৎসা, এবং যে চিকিৎসার মধ্যে ছিল জোঁক দিয়ে দেহ থেকে বদরক্ত বার করে দেওয়া-সহ নানাবিধ অনুমান-নির্ভর প্রক্রিয়া, শব-ব্যবচ্ছেদ ও স্টেথোস্কোপের ব্যবহারের মতো আধুনিক পদ্ধতি মানবদেহের স্থানিক নিরীক্ষণের মধ্য দিয়ে তৈরি চিকিৎসাকে করে তুলল অনেক বেশি কার্যকর। এই আধুনিকতার প্রতিষ্ঠায় ইউরোপের সময় লেগেছিল দু’শো বছর। বেন্টিঙ্ক প্রমুখের আগ্রহ সেই দু’শো বছর ধরে তৈরি হওয়া বিদ্যাকে সরাসরি ভারতের মাটিতে এনে বসিয়ে দিল।

এতে কেবল যে চিকিৎসার দিকটাই আমূল বদলে গেল তা-ই নয়, পাশাপাশি বদলাতে লাগল জনমানসিকতা। স্বাভাবিক ভাবেই, সেই পরিবর্তনে প্রতিরোধ এসেছে। শব ব্যবচ্ছেদ নিয়ে, মেয়েদের চিকিৎসাশাস্ত্র পড়া নিয়ে, উচ্চতর চিকিৎসাবিদ্যা শেখার জন্য ভারতীয়দের বিলেত যাওয়া নিয়ে নানা বাধা এসেছে। বাধা এসেছে শাসকের তৈরি পাঠক্রম ও পরিচালন ব্যবস্থার কারণেও। সেগুলো অতিক্রম করে এগোতে এগোতে ক্যালকাটা মেডিক্যাল কলেজ ভূমিকা রেখেছে আধুনিক নাগরিক গড়ে তোলার কাজে। চিকিৎসার অগ্রগতির মধ্য দিয়ে এগিয়েছে দেশের সামাজিক স্বাস্থ্য, ও মননের গড়ন। স্বাস্থ্য বিষয়ে আগ্রহীরাই শুধু নন, সাধারণ ভাবে সমাজ নিয়ে যাঁরা ভাবেন, তাঁদের সকলের জন্য এই বই খুব কাজের।

নজরে

কলকাতা পুরসভার সাফাইকর্মীদের বেশির ভাগই কাজ করেন দৈনিক মজুরিতে— প্রতি দিন শ’দুয়েক টাকার বিনিময়ে ছয়-সাত কুইন্টাল বর্জ্য তাঁরা দুই থেকে তিন কিলোমিটার রাস্তা ঠেলে নিয়ে যান। পুরসভার আবাসনে ফিরে তাঁরাই আবার স্নান করার প্রয়োজনীয় জলটুকুও পান না। পুরসভার এই কর্মীরা প্রধানত বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা। যদিও পুরুষ ও মহিলা, সকলেই এই দুর্ভোগের সম্মুখীন, তবু এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, মেয়েদের সঙ্কট আরও তীব্র। পুরসভার কর্মী হিসেবে একই বেতন পেলেও কাজের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন তাঁরা। কাজের সময়ের বাইরেও তাঁদের কাজ করতে বাধ্য করা হয়, সুপারভাইজ়ার কদর্য ভাষায় অপমান করেন, দেরিতে কাজে আসা বা ভাল পরিষ্কার না করার অজুহাতে ওই সামান্য মজুরি থেকেও টাকা কেটে নেওয়া হয়।

কলকাতার ঝাড়ুদার এবং মেথর নারী: শ্রম শহর ও লিঙ্গ

সার্থক লাহা

৩০০.০০

ধান্যমঞ্জরি

তার পর তো রয়েইছে সংসারে হেনস্থা— প্রধান রোজগেরে সদস্য যখন মহিলা, তখনও বাড়িতে পুরুষেরই প্রাধান্য। যদিও সে পুরুষ মদ্যপ, জুয়াসক্ত। সার্থক লাহা তাঁর বইতে সাফাইকর্মী মেয়েদের যে বিপন্নতা দেখিয়েছেন, তা বহুমাত্রিক— শ্রেণি, লিঙ্গ, জাত, এই তিন দিক থেকেই এই মেয়েরা সমাজে প্রান্তিক। মহিলা ঝাড়ুদার ও মেথরদের আর্থিক ও সামাজিক স্থিতি কী, রাজনৈতিক বা সরকারি উদ্যোগে তাঁদের ক্ষমতায়ন কতটুকু হয়েছে, কী পরিস্থিতি তাঁদের স্বাস্থ্যের, লেখক এই প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজেছেন তাঁর গবেষণায়, যার ভিত্তিতে তৈরি এই বই।

বইটির ভূমিকায় অধ্যাপক দেবী চট্টোপাধ্যায় প্রশ্ন তুলেছেন, নারীবাদের মূল ধারাতেই বা এই দলিত মেয়েরা কতটুকু স্থান পান? কতটুকু অংশগ্রহণ করছেন তাঁরা নারী আন্দোলনে? ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের প্রতিও একই প্রশ্ন করা চলে। ১৯২৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা পুরসভা মেথর ইউনিয়ন। পরের বছর ৪ মে প্রথম ধর্মঘট করেন মেথররা, এবং ২১ মে টাউন হল সভা করে বারো দফা প্রস্তাব গ্রহণ করেন। তার মধ্যে ছিল কাজ স্থায়ী করা, বেতন বৃদ্ধি, মহিলাকর্মীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি, সব কর্মীর বছরে এক মাস সবেতন ছুটি। আজও এই দাবিগুলির কতটুকু পূর্ণ হয়েছে, কেনই বা হয়নি, এই প্রশ্নের কিছু কিছু উত্তর মিলবে এই বইটিতে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

calcutta medical college Review

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy