E-Paper

ধর্মান্তরণের বহুমাত্রিক ইতিহাস

উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে শুরু হয়েছিল আধুনিক হিন্দু ধর্ম ও সম্প্রদায় গঠনের ও একীকরণের সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা, হিন্দু সংস্কারের পুনর্নির্মাণ।

তনিকা সরকার

শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৮:৫৮

মৌ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই গবেষণা অত্যন্ত মূল্যবান— আজকের পরিপ্রেক্ষিতে খুব জরুরিও, কারণ স্বাধীন ইচ্ছা অনুযায়ী ধর্মমত পাল্টানোর পথ আজকাল বন্ধ হয়ে আসছে— বিশেষ করে হিন্দুদের, আরও বিশেষ ভাবে দলিতদের জন্য। ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানদের অভিজ্ঞতা নিয়ে অনেকেই উৎকৃষ্ট কাজ করেছেন, যেমন নন্দিনী চট্টোপাধ্যায়, গৌরী বিশ্বনাথন, চন্দ্র মাল্লাম্পাল্লি প্রমুখ। মৌ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নতুন গবেষণা এ বিষয়ে নিঃসন্দেহে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

কোম্পানি আমল থেকে শুরু করে বিশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত ধর্ম ও সম্প্রদায় বদলের কয়েকটি বিশিষ্ট কাহিনি তন্নতন্ন করে আলোচনা করে তিনি ক্ষুদ্রায়িত ইতিহাস অথবা মাইক্রোহিস্ট্রি রচনা করেছেন। এই ইতিহাস নানা শ্রেণির স্ত্রী-পুরুষের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার গল্প। বইয়ের বেশির ভাগটাই জুড়ে আছেহিন্দু সম্প্রদায় থেকে খ্রিস্টধর্মে চলে যাওয়ার কাহিনি। কিন্তু ধর্মান্তরণ ঠেকানোর জন্য গ্রামীণ মুসলমান প্রচারকদের প্রচেষ্টা নিয়েও একটি মূল্যবান ও বিরল অধ্যায় রয়েছে। আরও আছে একই মানুষের বার বার নানা ধর্মে বিচরণের প্রয়াস।

উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে শুরু হয়েছিল আধুনিক হিন্দু ধর্ম ও সম্প্রদায় গঠনের ও একীকরণের সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা, হিন্দু সংস্কারের পুনর্নির্মাণ। নিঃসন্দেহে ধর্মান্তরণ— বিশেষত হিন্দু থেকে খ্রিস্টান হওয়ার সম্ভাবনা— হিন্দুসমাজের উঁচু জাতের গণ্যমান্যদের যারপরনাই বিব্রত, উদ্বিগ্ন করেছিল, কারণ নামী-দামি বংশের ছেলেরাও কখনও কখনও এ দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। হিন্দুসমাজের আশু অবক্ষয় আশঙ্কা করে তাঁরা এ সময়ে খ্রিস্টধর্মের তীব্র সমালোচনা ও হিন্দুধর্মের মহিমাকীর্তন শুরু করেন। এর পিছনে অবশ্যই ছিল ঔপনিবেশিকতার প্রছন্ন সমালোচনা।

অল্প কিছু ব্রিটিশ রাজপুরুষের ধর্মপ্রচারের আত্যন্তিক আগ্রহকে লেখক হয়তো একটু বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। উপনিবেশিক রাষ্ট্র কিন্তু ভারতীয় ধর্ম সম্বন্ধে নিরপেক্ষতা নীতি অবলম্বন করেছিল। প্রোটেস্টান্ট মিশনারিদের সম্বন্ধে ব্রিটিশ রাজপুরুষদের ছিল শ্রেণিভিত্তিক অবজ্ঞা, আর তাঁদের কার্যপ্রণালী সম্বন্ধে উদ্বেগ— যে হেতু ভারত ‘নন-সেটলার কলোনি’, ও তার বিশাল জনগোষ্ঠী খ্রিস্টান নয়। ধর্মবিশ্বাসে আঘাত হেনে তাঁদের উত্তেজিত করা তাই রাষ্ট্রনীতি-বিরোধী। মিশনারিরা কৃষকদের ভূমি অধিকার বাড়ানোর জন্য আইন বদলানোর আবেদন করতেন— বিনয়ভূষণ চৌধুরীর গবেষণা এ ক্ষেত্রে বিশেষ উপযোগী হত। উইলিয়াম ওডি-র জেমস লং ও নীল বিদ্রোহ নিয়ে প্রামাণ্য বইটির ব্যবহার লেখাকে হয়তো আরও সমৃদ্ধ করত।

রামমোহন থেকে শুরু করে খ্রিস্টধর্ম বনাম হিন্দুধর্ম নিয়ে কয়েকটি প্রাথমিক বিতর্কের অবতারণা করে লেখক দ্বিতীয় অধ্যায়ে চলে এসেছেন আলেকজ়ান্ডার ডাফ-এর প্রভাবে কিছু সবর্ণ যুবকের খ্রিস্টান হওয়ার আখ্যানে। এ থেকে শুরু হল হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকক্ষয় নিয়ে সমাজে উত্তেজনা, উগ্র প্রতিক্রিয়া। পরবর্তী শতকে এ ধরনের উদ্বেগ দেখা দিয়েছিল মুসলমান সম্প্রদায় সম্বন্ধে— যারা নাকি ছলেবলে কৌশলে সর্বদাই হিন্দুদের, বিশেষত হিন্দু মহিলাদের কবলিত করে নিজেদের দল ভারী করছে। ধর্ম বদলকে এ ভাবে দেখার বিষাক্ত রীতি আজ আরও হিংস্র চেহারা নিয়েছে— সে ইতিহাসের প্রাথমিক পর্ব সম্বন্ধে এই গবেষণার তাই বিশেষ গুরুত্ব আছে।

আমার অবশ্য ধারণা যে, সে সময়ে গোঁড়া হিন্দুরা যত না খ্রিস্টানদের ভয় পেতেন, তার চেয়ে ঢের বেশি ভয় পেতেন একেশ্বরবাদী সমাজ সংস্কারক আন্দোলনগুলিকে— যেমন ব্রাহ্ম আন্দোলন। ব্রাহ্মদের তাঁরা মনে করতেন ঘরভেদী বিভীষণ— প্রকৃত হিন্দুধর্মের সংস্কারের নাম নিয়ে সনাতন হিন্দু আচার-বিচার খতম করতে উৎসুক। মজা হল, প্রথমপর্বের ব্রাহ্মরাও কিন্তু খ্রিস্টানদের প্রচারে উদ্বিগ্ন হয়ে হিন্দুসমাজের শোধনের চেষ্টা করতে শুরু করেছিলেন। পরে তাঁরা হয়ে দাঁড়ালেন সনাতনপন্থীদের চরম শত্রু। লেখক হয়তো এই তিনকোনা সংঘাতকে পুরোপুরি ধরতে পারেননি।

পরবর্তী চারটি অধ্যায় জুড়ে ধর্ম পাল্টানোর গল্প আসছে, আর সে নিয়ে বিতর্ক, মামলা, গণমাধ্যমে অজস্র লেখালিখির বৃত্তান্ত— যার অনেকটা এ যাবৎ অজানা ছিল। চতুর্থ অধ্যায় হয়তো আজকের দিনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক— বারপাখিয়া গ্রামের নিম্নজাতের হিন্দুদের খ্রিস্টান হওয়ার ঘটনা, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁদের সমাজে বিধবাবিবাহের কথা আর স্থানীয় গোঁড়া জমিদারদের লাঠিয়াল নিয়ে তার বিরোধিতার রক্তাক্ত ঘটনা। এখানে জাতিবিদ্বেষ, ধর্মীয় গোঁড়ামি আর ব্রিটিশদের জমিদার-তোষণ মিশে এক জটিল ইতিহাস।

দ্য ডিসইনহেরিটেড: দ্য পলিটিক্স অব ক্রিশ্চান কনভার্সন ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া মৌ বন্দ্যোপাধ্যায়

৪৯.৯৫ ডলার

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস

এই দুই শ্রেণির মানুষের ধর্ম বদলের অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ দু’রকম পরিণাম— সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের সন্তানরা যখন অন্য ধর্মে আশ্রয় নেন, তখন তাঁদের পরিবার, সম্পত্তি, সমাজ, জাতপাত খুইয়ে আসতে হয়, মর্মান্তিক একাকিত্ব বরণ করতে হয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে বিবাহিত স্ত্রীকে কাছে পাওয়া দুরূহ হয়ে ওঠে। সবচেয়ে কঠিন সমস্যা হল পরিবর্তিত সত্তার স্বরূপ নির্ধারণ করা, বৃহত্তর সমাজের শিকড় খোয়ানোর যন্ত্রণা।

অন্য দিকে, নিম্নবর্গের মানুষদের ধর্ম বদলের দাম অন্য ভাবে দিতে হয়— জমি বাড়ি তো হারাতেই হয়, তদুপরি স্ত্রীদের ধর্ষণের মুখোমুখি হতে হয়, পুরুষদের প্রচণ্ড অত্যাচারে প্রাণ হারাতে হয়। জমিদারদের পক্ষে সহায় থাকে ব্রিটিশ রাজপুরুষ, কোনও কোনও ক্ষেত্রে আবার অন্য রাজপুরুষেরা সুবিচারের চেষ্টা করেন। যেমন তাঁদের কেউ কেউ নীল বিদ্রোহে সাহায্য করেছেন। ব্রিটিশ রাজশক্তির এই অভ্যন্তরীণ ফাটলগুলোর ক্বচিৎ কখনও দেখা মেলে, কিন্তু এরও একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে যা এখানে খানিকটা প্রছন্ন।

পরবর্তী অধ্যায়ে দেখি মুনশি মেহেরুল্লার ইসলামি প্রচারপ্রণালী আর মিশনারিদের সঙ্গে প্রকাশ্য বাহাস। এ ধরনের ঘটনা উত্তর ভারতে ত্রিমাত্রিক চেহারা নিত— দেওবন্দি মুসলমান প্রচারক, প্রোটেস্টান্ট মিশনারি ও আর্যসমাজিদের বিতর্ক। শেষকালে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের বারে বারে ক্যাথলিক চার্চ, ব্রাহ্ম সমাজ আর বৈষ্ণব ভক্তিমার্গের মধ্যে আনাগোনা, এরই মধ্যে সশস্ত্র বিপ্লব প্রচেষ্টা।

শেষে একটা ছোট প্রশ্ন থাকে। হিন্দু পুনরুত্থানের যুগে ধর্ম ত্যাগ করলে হিন্দুদের খুব কঠিন দাম দিতে হত। তাঁরা এই বিষম বিপদে কেন পা বাড়াতেন? নিজ ধর্ম সম্বন্ধে তাঁদের কী ধরনের আধ্যাত্মিক সমস্যা দেখা দিত, পরধর্মের মধ্যে তার কী ধরনের সমাধান পেয়ে তাঁরা সব ঝুঁকি মেনে নিতেন— তার বিশেষ হদিস কিন্তু এখানে মেলে না। মূল বিষয় তো হল দু’ধরনের ধর্ম ও ঈশ্বরভাবনা, যার সঙ্গে হয়তো কোথাও জড়িয়ে থাকে দুই ভিন্ন সমাজব্যবস্থা সম্পর্কিত চিন্তা। যেখানে ধর্ম নিয়েই সমস্যা, সেখানে এটাই তো প্রাথমিক বিষয়। এ ক্ষেত্রে কিন্তু আধ্যাত্মিক চেতনার এই ব্যাপারটা খানিকটা ঊহ্য থেকে গেছে।

আবার বলি, এই কাজ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বহু ধরনের নথিপত্র তলিয়ে দেখে, এক-একটি ঘটনা তুলে নিয়ে, তার নানা দিক ধরে ধরে নিপুণ, ঠাসবুনন বর্ণনা ও বিশদ বিশ্লেষণ যেমন দেখতে পাই, তেমনই দেখি সমসাময়িক বিভিন্ন সমাজ ও ধর্মের পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সংঘাতের বৃহত্তর আলোচনা। আর বিশিষ্ট কিছু সমাজনেতার, চিন্তকের জীবনী। সব মিলিয়ে উনিশ শতকের একটি বহুমাত্রিক চিত্র।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Colonial Rule Review

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy