স্বামীর হাতে নির্যাতিত জেলা পুলিশের এক মহিলা কনস্টেবলের অগ্নিদগ্ধ দেহ মিলল এক দিন। আত্মীয়রা সাংবাদিকদের কাছে নালিশ করলেন, কিন্তু এফআইআর করলেন না। টাকা নিয়ে রফা করলেন। যে থানায় মেয়েটি কাজ করত, সেখানে তাঁর সহকর্মীরাও স্রেফ ‘দুর্ঘটনা’ লিখে দিলেন।
টুম্পা মুখোপাধ্যায়ের বইটি খুলে দেখা গেল, মেয়ে-পুলিশ ব্যাপারটাই সমাজের চোখে গোলমেলে। পুলিশ মানেই ক্ষমতা, কিন্তু মেয়েদের আবার ক্ষমতা কী? ভারতে মেয়ে-পুলিশদের ‘মেয়ে’ করে রাখার কিছু সহজ উপায় অবশ্য ‘সিস্টেম’ করেই রেখেছে। যেমন, খুব অল্প মেয়ে নেওয়া (পুলিশ-বাহিনীর ১০ শতাংশও নয়), নিচু পদে রাখা (৭০ শতাংশ মহিলা পুলিশ কনস্টেবল), প্রধানত মহিলা ও শিশু সংক্রান্ত অপরাধের মধ্যে তাদের আটকে রাখা; যথেষ্ট ট্রেনিং, অভিজ্ঞতা বা পদোন্নতির সুযোগ না দেওয়া। এই বঞ্চনার অনেকটাই আসে মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তার মোড়কে— আহা, মেয়েরা কি কঠিন কাজ পারে?
যৌন হয়রানি, অশ্লীল ইয়ার্কির পাইকারি অস্ত্রগুলো তো আছেই। টুম্পা সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে দেখেছেন, লালবাজারে পুলিশকর্তাদের বড় বড় এসি ঘর, কালার টিভি। সমান পদমর্যাদার মহিলা অফিসারের ঘর ছোট, এসি নেই, সাদা-কালো টিভি। কলকাতারই বহু থানায় সে দিন পর্যন্ত মেয়েদের আলাদা টয়লেট ছিল না।
উইমেন ইন পুলিস ইন ইন্ডিয়া: আ জার্নি ফ্রম পেরিফেরি টু কোর
টুম্পা মুখোপাধ্যায়
১০৯৫.০০, রাওয়ত পাবলিকেশনস
তবু যদি মেয়ে-পুলিশ নিজেকে ‘পুলিশ’ ভাবে, তখন ভারী ফ্যাসাদ! হায়দরাবাদের এক গুণ্ডা কলেজছাত্রীদের হয়রান করছিল। আইপিএস অফিসার তেজদীপ কউর মেনন তাকে লাঠিপেটা করে হাজতে ভরেছিলেন। একটা মেয়ের হাতে মার খেতে হল, সেই দুঃখে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল লোকটা!
বইটি সমাজবিদ্যার গবেষণাপত্র, তাই এর একটি তাত্ত্বিক কাঠামোও রয়েছে। মেয়েদের পুলিশে আসার দু’টি যুক্তি। একটি সাম্যের যুক্তি। যে কোনও কাজেই পুরুষ ও মহিলার সমান অধিকার, অতএব পুলিশের কাজেও তা-ই। মেয়ে কি না, সেটা বিচার্য নয়। অন্য যুক্তিটি হল, মেয়েদের ওপর অপরাধের কিনারা করতে অথবা মেয়ে অপরাধী ধরতে মেয়ে-পুলিশ চাই। অর্থাৎ মেয়ে বলেই তারা সুযোগ পাবে। টুম্পা দেখিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গ-সহ অধিকাংশ রাজ্যে দ্বিতীয় যুক্তি মানা হয়। মেয়ে-পুলিশদের আলাদা পরীক্ষা, আলাদা নিয়োগ ও পদোন্নতির প্রক্রিয়া চলে। সমান সুযোগের তত্ত্ব কিছুটা হলেও কাজে লাগান আইপিএস মেয়েরা। যদিও তাঁদের সংখ্যা কম (খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এই মুহূর্তে এ রাজ্যে ২৭৮ জন আইপিএস আছেন, তাঁদের মধ্যে ২৭ জন মেয়ে), তবু তাঁদের অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ পদের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন।
কিন্তু শেষ অবধি কত জন ‘গ্লাস সিলিং’ ভাঙতে পারবেন? অনেক মেয়ে-পুলিশ ঘুষ নিয়ে, বন্দি নির্যাতন করে পুরুষদের সমকক্ষ বলে প্রতিষ্ঠা করতে চান নিজেদের। অত্যাচারিত হও, না হলে অত্যাচার করো— পুরুষতন্ত্র আটকাতে চায় এই নিগড়ে।
এই বইয়ে শেষ অবধি জ্বলজ্বল করে সেই মেয়েরা, যারা উগ্রপন্থীদের ছক বানচাল করেছে, দাঙ্গা সামলেছে, উন্মত্ত ভিড়কে শান্ত করেছে। যারা কৌশলে, সাহসে, উপস্থিত বুদ্ধিতে কারও থেকে কম নয়। তবু সম্মান, স্বীকৃতির তালিকা থেকে মেয়ে-পুলিশরা হারিয়ে যায়। কেন তাদের কাজকে, এমনকি তাদের মৃত্যুকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয় না? এ বই সেই অভিযোগের সমাজতাত্ত্বিক তদন্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy