Advertisement
E-Paper

মূলে আছে মন, মনন আর মরমের টান

এই শক্তি-সংবাদ ছাব্বিশ-সাতাশ বছর আগেকার। এত দিন পরে কবির পূর্বাপর অনুবাদকর্মের সঙ্কলন অনুবাদিত পদ্য হাতে তুলতেই যেন ফের বেজে উঠল তাঁর সেই সম্মাননীয় শ্লাঘা!

রতন জানা

শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৮ ০০:০১

অনুবাদিত পদ্য
শক্তি চট্টোপাধ্যায়

৪০০.০০, সিগনেট প্রেস

‘মেঘদূত’-এর তন্নিষ্ঠ, মৌলিক অনুবাদ আছে বুদ্ধদেব বসুর। আবার তারই তর্জমা আপনারও না-করলেই নয়, মনে হল কেন?

গর্জে উঠলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়: ‘‘তন্নিষ্ঠ না-হয় বুঝলাম। অনুবাদ আবার মৌলিক হয় কী করে?’’

কবির প্রতিপ্রশ্ন যে সবিস্তার উত্তরেরই প্রস্তাবনা, সেটা বুঝে মনে হল, নীরব থাকাই শ্রেয়।

একটু পরেই গাঢ় খাদে নেমে এল কবির স্বর: ‘‘হ্যাঁ, বুঝলি, অনুবাদেরও মৌলিক হয়ে ওঠার দায় আছে। সেই জন্যই পূর্ববর্তীদের তর্জমা সত্ত্বেও মেঘদূত অনুবাদ করেছিলেন বুদ্ধদেব। আর সেই জন্যই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও মেঘদূত তর্জমা করলেন। বুঝলি!’’

এই শক্তি-সংবাদ ছাব্বিশ-সাতাশ বছর আগেকার। এত দিন পরে কবির পূর্বাপর অনুবাদকর্মের সঙ্কলন অনুবাদিত পদ্য হাতে তুলতেই যেন ফের বেজে উঠল তাঁর সেই সম্মাননীয় শ্লাঘা! এবং বিস্ময়ের সঙ্গে আবিষ্কার ও অনুভব করা গেল, ‘জনকতনয়াস্নানপুণ্যোদকেষু’ অংশের বুদ্ধদেব-কৃত চরণ ‘জলধারা জনকতনয়ার স্নানের স্মৃতি মেখে পুণ্য’ আর শক্তির তর্জমা ‘সেখানে ধারাজল পুণ্য হয়ে আছে জনকতনয়ার স্পর্শে’ দু’রকম অবগাহনের শান্তি দেয়।

আবার বেজে ওঠে আত্মগত শক্তি-স্বর: ‘‘আসলে আমার মনে হয়, প্রত্যেক কবিরই এক বার না এক বার মেঘদূত অনুবাদ করা দরকার।’’

অনুবাদিত পদ্য দেখাচ্ছে, গীতা থেকে ওমর খৈয়াম, মির্জা গালিব, রাইনার মারিয়া রিলকে, হাইনরিখ হাইনে, ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা, ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি, পাবলো নেরুদা পর্যন্ত শক্তির অনূদিত বিপুল সম্ভারে একক ভাবে কালিদাসই আছেন সব চেয়ে বড় জায়গা জুড়ে।

মৌলিক সৃষ্টির অনুর্বর প্রহরে অনুবাদ ছিল শক্তির মানসিক আশ্রয়, মেধার আহার্য আহরণের প্রক্রিয়া। শক্তিমান কবি বলেই অন্যের কবিতাকে নিজের ভাষার কাব্যসজ্জায় স্বচ্ছন্দে সাজাতেন শক্তি। আবার অনুবাদ যে তাঁর কাছে নিছক মেধার ভিতরকার শ্রান্তি অপনোদনের অবলম্বন নয়, মেঘদূতের পাশাপাশি ‘কুমারসম্ভব’ মহাকাব্যের তদ্গত তর্জমা তার সাক্ষ্য। কুমার তাঁকে এতটাই অভিভূত করে রেখেছিল যে, ওই মহাকাব্যের প্রথম অনুবাদটি জনৈক প্রকাশক বাক্সবন্দি করে রাখায় কবি ‘দ্বিতীয় বার এই দুর্লঙ্ঘ্য কাজে হাত’ দিয়েছিলেন। এবং সেই দ্বিতীয় কুমার-তর্জমা দেখিয়ে দেয়, শক্তির স্বঘোষিত স্বেচ্ছাচারী বিশৃঙ্খল কবিজনমের নিভৃত নোঙর কোন গহনে অবিচল ছিল। শক্তি কেন সমগ্র কালিদাস অনুবাদ করলেন না, সেই বিস্ময়ও রীতিমতো গবেষণাযোগ্য।

সেই অসমগ্রতার খেদ বাড়িয়ে দেয় গীতার খণ্ডিত শাক্ত তর্জমাও। চতুর্থ অধ্যায়ের ঊনবিংশ শ্লোক পর্যন্ত এগিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের গীতা-ব্যাখ্যান থেমে গিয়েছিল। সেই অসম্পূর্ণতা পদে পদে জানান দেয়, বাংলা সাহিত্য বঙ্কিমচন্দ্রের লেখনী থেকে অনেক মণিমাণিক্য পেলেও এক অতুল্য কোহিনুর থেকে বঞ্চিত হয়েছে। কোহিনুরের সেই অভাব পূরণের প্রতিশ্রুতি ছিল শক্তির গীতা-তর্জমার সূচনায়। আধ্যাত্মিক আবরণের অন্তরালে কাব্যময় যে-অনন্ত বিস্ময়বোধ গীতার প্রাণ, তার নন্দনতরঙ্গ এ-যুগের এই মেধাবী কবিকে ছুঁয়ে ছিল আজীবন। গীতা ধুরন্ধর কূটনীতিক কৃষ্ণের উদ্ভাবিত মস্তিষ্কপ্রক্ষালন মন্ত্র কি না, সেই আদিঅন্তহীন বিতর্ক সরিয়ে রেখে এর কাব্যরসের বিস্ময়ে আপ্লুত হওয়ার কথা বলেছিলেন বুদ্ধদেব বসু।

শক্তিও বলতেন, ‘‘ধর্মটর্ম নয়, গীতার কবিত্ব আমাকে খুব টানে।’’ কিন্তু আঠারো অধ্যায়ের গীতা থেকে প্রথম, নবম, দশম আর একাদশ অধ্যায়ের মাত্র ১১৬টি (চার অধ্যায়ে মোট শ্লোক ১৭৮টি) শ্লোকের ভাষান্তর পাওয়া যাচ্ছে শক্তির এই সঙ্কলনে। যেটুকু পাওয়া যাচ্ছে, তার ঐশ্বর্য সখেদ প্রশ্ন তুলতেই পারে, জীবনানন্দ-পরবর্তী শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি গীতার কবিতা সম্পূর্ণ ভাষান্তরের দায়িত্ব মাঝপথে ছেড়ে গেলেন কেন?

অসম্পূর্ণতার আফসোস নিয়ে ওমর খৈয়াম, মির্জা গালিবের দিকে এগোলে অঞ্জলি ভরে দেন শক্তি। কান্তি ঘোষ, নজরুল ইসলাম, নরেন্দ্র দেব-সহ পূর্বজ খৈয়াম-অনুবাদকদের গোত্রভুক্তির স্বপ্ন দেখতেন তিনি। চাইতেন পাঠকের ‘মনে অমোঘ ওমরের আবর্ত সৃষ্টি করতে’।

শুধু ওমর-আবর্ত নয়, তিনি সৃষ্টি করেছেন একেবারে ওমর-শক্তি আবর্ত। ‘অস্তি-নাস্তি যুগ্মে গড়া’ এই সৃষ্টি ওমরের দৃষ্টিতে যে-ভাবে ধরা পড়েছিল, অনেকাংশে তার শরিক শক্তিও। ‘এক জীবনের অশ্রুপাতে একটি বর্ণ মুছবে সখী?’ কার চরণ? কার উচ্চারণ? ওমর না শক্তির? এই ধন্দই ওমর-শক্তি জুটির প্রাণ! কিংবদন্তিসম পানাসক্তি থেকে অজ্ঞেয় আস্তিকতায় অন্তরের যোগ দু’যুগের দুই কবির। পারস্য পটভূমি থেকে ওমরকে এমন ভাবে বঙ্গজাত করেছেন শক্তি, গঙ্গা-ভাগীরথী থেকে দুষ্টু সরস্বতী, সন্ধ্যামণি থেকে নবান্ন ওতপ্রোত হয়ে গিয়েছে ওমরে। শক্তি একে বলতেন অনুসৃষ্টি, বলতেন ‘স্বেচ্ছাচারিতার চূড়ান্ত’। বলতেন, ‘শুধুমাত্র নিজেকে শোনাবার জন্য’ই এত অনুবাদ, এত আয়োজন।

‘ধ্বস্ত নষ্ট ভঙ্গুরের শোকগাথা’র কবি মির্জা গালিবের সঙ্গে ‘প্রভু, নষ্ট হয়ে যাই’-এর কবি শক্তির অন্তরঙ্গতা ওমরের তুলনায় কম নয়। নিজের জীবনের নিরন্তর ভাঙচুরের মধ্যে তীক্ষ্ণধী গালিব দেখেছেন, নবাগত ইংরেজ সভ্যতা-শাসনের সঙ্গে টানাপড়েনে কী ভাবে ভেঙে পড়ছিল মোগলাই দিল্লি। কলকাতারও ক্ষণপ্রেমে পড়েছেন গালিব। আর কলকাতার কবিয়াল শক্তির তর্জমায় উঠে আসছেন তিনি: ‘‘সুরের পর্দা নই কিছুতেই, নই তো গীতের সার/ আমি শুধুই শব্দ— নিজের ভেঙে যাবার।’’

খৈয়াম-তর্জমা প্রসঙ্গে শক্তি বলেছিলেন, ‘‘কবির মাধ্যমে অন্য কবির কাছে যেতে হলে পথ বদল হয়।’’ শক্তির বেলায় সেটা সব চেয়ে বেশি হয়েছে রিলকে অনুবাদে। বুদ্ধদেব বসুর বিদগ্ধ রিলকে-তর্জমার পরেও, জার্মান না-জানা সত্ত্বেও শক্তি যে ‘দুইনো এলিজি’ অনুবাদে ঝুঁকেছিলেন, তার মূলে আছে মন, মনন আর মরমের টান। বাংলায় রিলকে-কে তুলে ধরা ‘প্রায় অসম্ভব’ বুঝেও তাঁর একই কবিতা বারংবার তর্জমা করতে অক্লান্ত ছিলেন শক্তি। কেন? ‘‘যে-হেতু, ভালবাসি। যে-হেতু, ভয় করি।’’ তবে গীতার মতো অসম্পূর্ণ থেকে গিয়েছে তাঁর এই তর্জমাও। দুইনো দুর্গের দশটি এলিজির মধ্যে মাত্র চারটিকে বাংলায় এনেছেন শক্তি। বুদ্ধদেব একটি বেশি এলিজি অনুবাদ করেছিলেন।

অনুবাদে হাইনেরও প্রায় অভিন্নহৃদয় হয়ে উঠেছেন শক্তি। যাঁর ‘শোক দুঃখময় অথচ হাস্যকরোজ্জ্বল কবিতা’ একদা গোটা জার্মানিকে কাঁদিয়েছিল, বন শহরের বুকের উপর
দিয়ে বইয়ে দিয়েছিল ‘এক তালকানা অশ্রুনদী’, সেই হাইনের সঙ্গে শক্তির মিল নিখাদ রোমান্টিকতায়। প্রেমকবিতার অনন্য স্রষ্টা হাইনেকে তিনি বাংলায় তুলে এনেছেন তাঁর একান্ত নিজস্ব স্বরে: ‘‘কী সেই আগুন আমায় পুড়িয়ে মারে/ আত্মায় ওড়ে ছাই/ দুঃখিনী, তোর দুঃখের পারাবারে/ সুখ যেন খুঁজে পাই।’’

স্টিফেন স্পেন্ডারের রিলকে-তর্জমায় শক্তি দেখেছিলেন, রিলকে অক্ষয় রয়েছেন, আবার কোথাও না কোথাও থেকে গিয়েছেন স্পেন্ডারও। শক্তিও যত মহান কবিকে ভাষান্তরিত করেছেন, সব ক্ষেত্রেই কোথাও না কোথাও থেকে গিয়েছেন নিজে। এটা যত না খেলার প্রতিভা, তার থেকে কিছু কম নয় প্রতিভার খেলা। এই খেলার বিকাশ সব থেকে বেশি নেরুদা-অনুবাদে। সেখানে এমনকি রবীন্দ্রনাথকেও ময়দানে নামিয়েছেন শক্তি। ‘ইন মাই স্কাই অ্যাট টোয়াইলাইট’ কবিতার বঙ্গীকরণে তাঁর অব্যর্থ আশ্রয় রবীন্দ্রনাথের ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’য়। শেষে তাঁর স্বীকৃতির টীকা: ‘রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার ছায়ায়’। নেরুদার সংগ্রামী কবিতার সশ্রদ্ধ তর্জমা আর তাঁর সংরক্ত প্রেমকবিতার অনুবাদে শক্তির স্বাচ্ছন্দ্য সমান। ‘টোয়েন্টি লাভ পোয়েমস’-এর শাক্ত তর্জমা বাংলা অনুবাদ সাহিত্যে মাইলফলক। বিস্ময়কর এটাই যে, স্ত্রী মাতিলদে-কে নিয়ে নেরুদার যে-সনেট শতক দান্তে-শেক্সপিয়রের সনেটের সমতুল, ‘চতুর্দশপদী’র কবি শক্তি তার অনুবাদে আগ্রহী হলেন না!

আগ্রহী হয়েও লোরকা বা মায়াকোভস্কির অনুবাদে শক্তি যে বেশি দূর এগোননি, সেটা বাংলা সাহিত্যেরই অসামান্য ক্ষতি।

সমাজকল্যাণ কবির অবশ্যকৃত্য হয়তো নয়। তবে পাঠককল্যাণে কিছু কিছু অনুবাদের দায়িত্ব যে সব কবিরই নেওয়া উচিত, শক্তি সেটা অগ্রাহ্য করতেন না। তাঁর অনুবাদ গ্রন্থমালা প্রকাশের পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত আলো দেখেনি, এটা বাঙালি পাঠকেরই দুর্ভাগ্য। ভোপালের ভারত ভবনে কবিতা পাঠ এবং অনুবাদকর্মে সাহায্যের আমন্ত্রণ রাখতে গিয়ে বিভিন্ন ভারতীয় ভাষার কবিতার বঙ্গীকরণের সামাজিক প্রয়োজন তীব্র ভাবে অনুভব করেছিলেন তিনি। অমৃতা প্রীতম থেকে গীতাঞ্জলি বদরুদ্দিন পর্যন্ত আঞ্চলিক ভাষার প্রবীণ-নবীন কবিদের কমবেশি তর্জমা নিজেও করেছেন। শক্তির বন্ধুবাৎসল্যের স্বাক্ষরও আছে তাঁর প্রীতীশ নন্দীর তর্জমায়।

প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি মিলিয়েই অনুবাদিত পদ্য কবি শক্তির এক অনন্য আলো। প্রকাশনার সৌষ্ঠবেও সিগনেট প্রেসের সুনাম অটুট।

শুধু পদে পদে ভুল বানানের কীটদংশন যদি এড়ানো যেত!

Book Review Shakti chatterjee
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy