গৃহশ্রমে মজুরি হয় না বলে মেয়েগুলি শুধু ঘরে বসে বিপ্লবীদের ভাত রেঁধে দেবে, এ কথা যেন গণ-আন্দোলনের ডিএনএ-তে লগ্ন হয়ে আছে। বাঙালির বিপ্লবের শ্রেষ্ঠ নস্টালজিয়া নকশালবাড়ি আন্দোলনের পুরুষ-লিখিত স্মৃতিকথাগুলি পড়লে মনে হয়, মেয়েরা বুঝি নেহাত পার্শ্বচরিত্র, না থাকলেও ইতিহাসের এই মহানাট্যের আখ্যান পাল্টাত না তিলমাত্র। কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখার আনাচেকানাচে রয়েছে রাজনীতির নাট্যশালায় পুরুষতন্ত্রের সেই ‘হেজেমনিক’ দাপটের কথা। মেয়েরা ঘরে বসে পোস্টার লিখে দেবে, কিন্তু সেগুলো দেওয়ালে লাগাতে যাবে ছেলেরা; মেয়েরা নার্সিংয়ের ট্রেনিং নেবে, ছেলেরা নয়; মেয়েরা পার্টির অমতে নিজেরা ‘অ্যাকশন’ করলে তার নিন্দা হবে। লেখিকা তাঁর মায়ের কথা বলেছেন— তাঁর ভাইরা বিশ্বাস করতেন বামপন্থী রাজনীতিতে— তিনিও, কিন্তু সেই আন্দোলনে যোগ দেওয়ার অনুমতি ছিল না তাঁর।
আমার নকশালবাড়ি
কৃষ্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
৩০০.০০
অক্ষর
সকাল থেকে রাত অবধি যৌথ পরিবারের হেঁশেল ঠেলার পরও পার্টি করতে যাওয়া মেয়েকে সেই ছাড়টুকু দিতে পারার মধ্যেই ছিল তাঁর রাজনীতির সবটুকু। যে কোনও ঘটনার, যে কোনও আন্দোলনের ভাষ্য কথক-লেখকের লিঙ্গভেদে কতখানি ভিন্ন হয়ে যায়, বইটি তার প্রমাণ। জয়া মিত্রের হন্যমান বা সম্প্রতি প্রকাশিত সুধা ভরদ্বাজের ফ্রম ফাঁসি ইয়ার্ড-এর মতোই। শ্রমজীবী মেয়েরা— সে শ্রম বাইরের অর্থনৈতিক কাজেই হোক বা ঘরের পরিসরে চব্বিশ ঘণ্টার বিনা বেতনের কাজেই— কী ভাবে আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে যান, শ্রেণিপরিচয়ের গণ্ডি পেরিয়ে কী ভাবে মধ্যবিত্ত রাজনৈতিক মেয়ে তাঁদের আপন হয়ে ওঠেন, সেই গল্পও তো রাজনীতিরই। সব বিপ্লবের জন্যই কি বন্দুক-বোমা লাগে!
স্মৃতি সত্তায় মোহনবাগান
সম্পা: শান্তনু চক্রবর্তী, শুভ্রাংশু রায়
৫০০.০০
উর্বী প্রকাশন
“‘ডিসিপ্লিন’ ছিল দলের মূলমন্ত্র। অবশ্য মূলমন্ত্রটা বারে বারে উচ্চারণ হত না, মোটেই। নিয়ম মেনে চলাটাই ছিল স্বাভাবিক।” শৈলেন মান্না লিখে গিয়েছেন গত শতকে, কয়েক দশক আগে, অথচ তাঁর হাতে-নগদ প্রমাণ গত কয়েক বছর ধরে ভারতীয় ফুটবলে মোহনবাগানের অভূতপূর্ব সাফল্য। তাঁর আমার মোহনবাগান স্মৃতিকথন ফিরে পড়া গেল এই বইটির দৌলতে। গোষ্ঠ পাল আর উমাপতি কুমারেরও লেখা আছে এ বইতে। তবে নিছক স্মৃতিচারণে ভরপুর নয় গ্রন্থটি, বরং নানা রকমের রচনায় ঋদ্ধ। পরাধীন বাংলায় সাহেবদের হারিয়ে শতাব্দীপ্রাচীন মোহনবাগান যে শুধু জাতীয়তাবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছিল তা নয়, তার অস্তিত্বে বহন করে নিয়েছিল ভারতীয়তার নানা সামাজিক সাংস্কৃতিক চিহ্ন, সে সব কথাই ঘুরেফিরে লেখকদের কলমে, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে। ইতিহাসকে ভিত্তি করে সিরিয়াস রচনার পাশাপাশি ঠাঁই পেয়েছে ইতিহাসের উল্টো চশমায় লঘু চালে দেখা কিছু বিষয়ও। ইংরেজ শাসনের সময় থেকে ক্যালকাটা ক্লাব-সহ ব্রিটিশ সামরিক-অসামরিক ক্লাবগুলির পাশাপাশি শোভাবাজার, এরিয়ান, কুমোরটুলি, টাউন ইত্যাদি ক্লাবগুলিরও বৈরিতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল মোহনবাগানকে। পরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয় মহমেডান স্পোর্টিংয়ের সঙ্গে, আরও পরে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে, যা আজও অব্যাহত। মোহনবাগান মাঠের ভিতরের ও বাইরের বরণীয় ব্যক্তিত্ব বা ক্রীড়া-নক্ষত্রদের সঙ্গে ভিনদেশি তারাদের নিয়ে যেমন, তেমনই হকি ও ক্রিকেটে মোহনবাগানের গৌরবগাথা নিয়েও রচনাদি রয়েছে বইটিতে। কেবল মোহনবাগান সমর্থকদের নয়, যে কোনও খেলাপাগল লোকের কাছেই, বিশেষত নতুন প্রজন্মের অবশ্যপাঠ্য এই বইটি।
হিমালয় অমনিবাস
গৌরী রুদ্র,
সম্পা: কল্যাণ রুদ্র
৫৫০.০০
বিস্তার, রংরুট
নেহাত হিমালয়-ভ্রমণবৃত্তান্ত বলে সবটা বলা হয় না এই বই সম্পর্কে। ১৯৯৩ সাল থেকে মূলত পায়ে হেঁটে এবং কখনও ঘোড়া, গাড়ি ও হেলিকপ্টারে হিমালয়ের প্রান্তে ও প্রত্যন্তে গতায়াত লেখিকার, সঙ্গে তাঁরই মতো বন্ধু কয়েকজন, এবং চলার পথের সঙ্গী হিমালয়বাসী স্থানীয় মানুষজন— এই বারংবার যাত্রাকে তো শুধু ভ্রমণ বলা চলে না। শুধু প্রকৃতির সুধাপান নয়, শুধু ট্রেকের শিহরন নয়, সেই সঙ্গে হিমালয়ের ‘ভূতাত্ত্বিক ও বৈজ্ঞানিক গঠনবৈচিত্র, তার হিমবাহ ও নদীগঠিত ভূমিরূপ, নদীর বহমানতা ও বাঁধ-বন্ধনের অপকার’, এই সবই দেখা, জানা, বোঝার চেষ্টার সম্মিলিত যোগফল এই বই। গঙ্গোত্রী-গোমুখ কেদার-বদ্রী, গান্ধী সরোবর, তপোবন, পঞ্চকেদার, পিন্ডারি বা মিলাম হিমবাহ, কুঁয়ারি পাস, পঞ্চচুল্লি, রূপকুণ্ড, মণিমহেশ, স্পিতি উপত্যকা, সিল্ক রুট, সিকিম অরুণাচল মিজ়োরামের নানা জায়গায় ভ্রমণের বয়ান হয়ে উঠেছে একাধারে ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক পাঠ। ডায়েরির মতো সহজ ঝরঝরে গদ্যশৈলী, সঙ্গে সাদা-কালো ও রঙিন ছবির সমাহার, পাতার পর পাতা পড়ে ফেলা যায় একটানে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)