Advertisement
E-Paper

প্রেমের আখ্যান, রাজনীতিরও

১৯৫৪ সালে প্রকাশিত মালশ্রী উপন্যাসে বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী সাম্যের দ্বিচারিতা উন্মোচিত হয়েছিল মূল চরিত্র রাখির কাছে।

তপস্যা ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৭:২১

মালশ্রী
সাবিত্রী রায়
৩২৫.০০
লোকনদী ও পুনশ্চ

সাহিত্যচর্চার মূল স্রোতে সাবিত্রী রায় নামটি এখনও তেমন গাঢ় হল না। প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনার পরিধিতে সিলেবাসের অন্তর্গত হয়ে প্রশ্নোত্তরের বিষয় হয়ে উঠলেও তিনি রসচর্চার অঙ্গীভূত হলেন না। অথচ সময়ের পদচারণায় তাঁর গল্প-উপন্যাস প্রামাণ্য ভূমিকা নেয়। প্রথম উপন্যাস ১৯৪৫ সালে, শেষ উপন্যাস ১৯৭২ সালে, এবং ১৯৫২ সালে গল্প সঙ্কলন; এ ছাড়া ছোটদের জন্য বই— সব নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কমিউনিস্ট লেখিকার সময়ানুসন্ধান ও আত্মানুসন্ধানের মেলবন্ধনে তাঁর সৃষ্টি ভিন্ন ধারায় বহমান। আপসহীন এই লেখিকার ১৯৫২ সালে স্বরলিপি উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার পরে কমিউনিস্ট পার্টি বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কমিউনিস্ট পার্টির ভিতরকার দ্বন্দ্ব অনাবৃত করেছেন সাবিত্রী। অভ্যন্তরীণ দলাদলির এমন অকপট বর্ণনায় ক্ষিপ্ত পার্টি এহেন ফতোয়া দিয়েছিল। কথা ও কাজের অসামঞ্জস্য পীড়িত করেছিল তাঁকে। তবে, এ ঘটনার পরেও তাঁর ভাবনার ছাঁচ কিন্তু বদলায়নি।

১৯৫৪ সালে প্রকাশিত মালশ্রী উপন্যাসে বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী সাম্যের দ্বিচারিতা উন্মোচিত হয়েছিল মূল চরিত্র রাখির কাছে। রাখি এক সাধারণ মেয়ে। তার সহজ, আবেগমগ্ন, স্পষ্ট, সচেতন, আদর্শবাদী অস্তিত্ব পরিণতি পাওয়ার মধ্য দিয়ে উপন্যাসে সাবিত্রীর দর্শন প্রতিষ্ঠিত হয়। রাখির জীবনে মূলত তিনটি মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তাকে একটু একটু করে পরিণত করেছে। স্কুলজীবনে শিক্ষক সৌমিত্রের প্রতি রাখির কিশোর বয়সের চঞ্চলতাজাত মুগ্ধতা মেশানো প্রেম, অপেক্ষাকৃত পরিণত বয়সে সাহিত্যবোধ ও রাজনীতিবোধের সমন্বয়ে সাম্যের প্রতি মুগ্ধতা ও দাম্পত্য সম্পর্ক, এবং সংসারবিধ্বস্ত পোড়খাওয়া পরিণতবয়স্ক ও পরিণতমনস্ক অসুস্থ অবস্থায় দিগন্তের সংস্পর্শ— এই তিন রকমের অনুভবে রাখি শেষ পর্যন্ত নিজ ব্যক্তিত্বে স্থিত হয়েছে। এর সঙ্গে ছিল রাখির অপত্যস্নেহ, যা নাকি তাকে জীবনলগ্ন হয়ে থাকতে সহায়তা করেছে। বস্তুত, সৌমিত্রের প্রতি অভিমানে সাম্যের সঙ্গে প্রেম ও দাম্পত্য সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। আবার, সাম্যের দ্বিচারিতা দিগন্তের সঙ্গে পরিণত সম্পর্কে জড়াতে রাখিকে দ্বিধাহীন করেছে। এই সম্পর্কে একত্র জীবনযাপন গৌণ; মানসিক নৈকট্য, ব্যক্তিত্বের সাদৃশ্য, পারস্পরিক বোঝাপড়াই মুখ্য। দিগন্তের প্রেরণায় অসুস্থ রাখি তার উপন্যাস সম্পূর্ণ করে, নাম দেয় ‘পাকা ধানের গান’। তার জীবনের মোড় ফেরে— সদর্থক পদক্ষেপে উপন্যাস সম্পূর্ণ হয়।

রাজনীতির ঘূর্ণিপাক প্রত্যক্ষ ভাবে অনুপস্থিত মালশ্রী-তে। তবে, বামপন্থী আদর্শে আগ্রহী রাখি বামপন্থী সৌম্যকে ভালবেসেছিল। বিয়ের পরে সংসারের মূল্যবোধের সঙ্গে রাজনৈতিক আদর্শের কোনও সামঞ্জস্য করার চেষ্টা করে না সৌম্য, রাখিকে একাই বৃহত্তর সংসারের জোয়াল টানতে হয়। পুরুষের দাপট রাখিকে বিরূপ করে, স্বামী-স্ত্রীর দূরত্ব বাড়ে, কমিউনিস্ট দলের ভিতরকার দ্বিচারিতা স্পষ্ট হয়। বস্তুত, সাবিত্রীর যে কোনও লেখাতেই রাজনৈতিক চেতনা অন্তর্লীন হয়ে থাকে। মালশ্রী মূলত প্রেমের উপন্যাস। রাখির ব্যক্তিগত জীবনসূত্রে সামাজিক-রাজনৈতিক মূল্যবোধের স্বরূপ প্রকট করেন সাবিত্রী।

নিরাসক্ত দৃষ্টিকোণে সময়কে কাটাছেঁড়া করেন তিনি। মধ্যবিত্তের চেতনায় সময়ের অভিব্যক্তি যে ভাবে প্রতীয়মান, সে ভাবেই সাবিত্রী চল্লিশ থেকে সত্তর এই চার দশক জুড়ে তাঁর কথাসাহিত্যে দেখিয়েছেন। স্বরলিপি উপন্যাস প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, তাঁর কোনও চরিত্রই মিথ্যা নয়, বাস্তবেরই ছায়া, আবার কোনও চরিত্রই সত্য নয়, কল্পনারই প্রতিচ্ছায়া মাত্র। এ কথা তাঁর যে কোনও লেখা সম্পর্কেই প্রযোজ্য। ২০১৯ সালে জয়া মিত্রের সুসম্পাদনায় লেখিকাকন্যা গার্গী চক্রবর্তীর ভূমিকা-সহ মালশ্রী-র তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশ পাওয়াটা জরুরি ছিল, এমন এক লেখিকার সঙ্গে আধুনিক প্রজন্মকে পরিচিত করানোর জন্য।

book review
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy