Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Christmas

নিজের ক্রুশ নিজে বহন করে যাওয়া মানুষ

আত্মসংশয়ী মানুষই তো দুঃশাসনীয় সময়কে প্রশ্ন করতে সক্ষমবাইবেলের সঙ্গে আমার মতো মধ্যবিত্ত বাঙালি ছেলের একটা পরিচয় গড়ে উঠেছিল ছেলেবেলা থেকে।

গৌতম ভদ্র
শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২০ ০১:০৭
Share: Save:

করোনার দাপটে ঘরবন্দি। একদম নেটিজ়েন নই, মোবাইল ফোন থেকেও দূরে থাকি, কী সব নিউ নরম্যাল-এর চোটে প্রাণ ওষ্ঠাগত। তাই ‘এমন বন্ধু আর কে আছে’, ভাবতে ভাবতে বই-এর মতো বই খুঁজে বার করে পড়ছি, দ্য বাইবেল। নাম জানতাম, কেই বা না জানে, কিন্তু বইটা ঠিক আগে কখনও পড়া হয়নি।

বাইবেলের সঙ্গে আমার মতো মধ্যবিত্ত বাঙালি ছেলের একটা পরিচয় গড়ে উঠেছিল ছেলেবেলা থেকে। হলিউডের সিনেমার মধ্য দিয়ে, দ্য টেন কম্যান্ডমেন্টস, সামসন অ্যান্ড দেলিলা আর খ্রিস্ট-ঘেঁষা কুয়ো ভাদিস-এর মতো ছবির মধ্য দিয়ে। গায়ে কাঁটা দেওয়া রাজসিক কার্যকলাপের সব জমকালো ফিল্ম। দেবসাহিত্য কুটিরও সঙ্গ দিত, বেছে বেছে বাইবেলের গল্পওয়ালা বই কিনে হলে-দেখা ছবির সঙ্গে গল্পটা মেলাতাম। বায়োস্কোপ, বই, বাইবেল সব একাকার হয়ে যেত।

কলেজে ইতিহাস পড়াশোনার বিষয় ছিল। ইউরোপের ধর্মবিপ্লবের ইতিবৃত্ত পড়তে গিয়ে ক্রিসমাস কেকের বাইরেও খ্রিস্টের জন্মতত্ত্ব ও ধর্মতত্ত্ব এক আধটু জানতে হত। নানা পণ্ডিতের বই পড়ে কূটকচালি বিতর্ক নিয়ে প্রশ্নোত্তর উপযোগী নোটও লিখেছি, তবু কখনও বাইবেলটা পড়ে উঠতে পারিনি।

মঙ্গলবার্তা বাইবেল (নব সন্ধি)
অনুবাদক: সজল বন্দ্যোপাধ্যায়, খ্রীস্তিয়াঁ মিংঙো
জেভিয়ার প্রকাশনী, কলকাতা

ঠেকে যেতাম ভাষায়। আমি বাংলা পড়াতেই স্বচ্ছন্দ। হিব্রু, গ্রিক বা লাতিনে অধিকার নেই, কাজের টানে বা দায়ে পড়ে ইংরেজি পড়েছি, তবে অবসর নেওয়ার পর ওই ধরনের পড়ায় আরও অনীহা এসেছে। বাইবেল মিশন বা সোসাইটির ছাপা নানা বাংলা বাইবেল দেখিনি, তা নয়। তবে ভাষার বিদঘুটেমি ছাড়িয়ে কয়েক পাতার বেশি এগোতে পারিনি, অনেক সময় প্রসঙ্গের মাথামুন্ডুও বুঝিনি। এই বুড়ো বয়সে হাতে এসেছে একবিংশ শতকের গোড়ায় ছাপা খ্রীস্তিয়াঁ মিংঙো ও সজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের করা অনুবাদ, মঙ্গলবার্তা বাইবেল, তিন খণ্ডে সমাপ্ত, জেভিয়ার প্রকাশনী, ২০০৩। অনুবাদকরা জানিয়েছেন যে, তাঁরা হিব্রু বা গ্রিক ভাষার বাচনরীতিকে ঢেলে সাজিয়ে একেবারে ‘সাবলীল বাংলা’য় ভাষান্তর করেছেন, উদ্দেশ্য ‘আজকের বাঙালির কি মন কি প্রাণ’ দুইকেই তৃপ্ত করা। সুবিন্যস্ত পাদটীকা ও পরিশিষ্টের ধর্মতত্ত্ব, ভূগোল ও ইতিহাসের নানা প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ সন্নিবেশিত হয়েছে, সাধারণ পাঠককে আর ধন্দে পড়তে হয় না। বাংলা ভাষায় মঙ্গলবার্তা বাইবেল নিঃসন্দেহে অনুবাদ তথা ধর্মসাহিত্যের ভান্ডারে অমূল্য সংযোজন।

এই তিনটি খণ্ড নাড়াচাড়া করতে করতে বুঝলাম যে, বাইবেল তো নানা ভাবে পড়া যায়, ভক্তের চোখে, পণ্ডিতের চোখে বা রসিকের চোখে। আমি তৃতীয় দলের পাঠক। দুই পর্বের বাইবেল, ওল্ড টেস্টামেন্ট আর নিউ টেস্টামেন্ট, দুই ভিন্ন রসের বাহক, রৌদ্র রস ও করুণ রস। ওল্ড টেস্টামেন্টের শিরোমণি জিহোজা, পুলিশ কঠোর দণ্ডদাতা ঈশ্বর, তাঁর নির্বাচিত ইজ়রায়েল জাতি আত্মগর্বী ও জেহাদি, ওই জাতির এক সময়কার নেতারা মাকাবি বা হাতুড়ি বলে আখ্যাত হতেন। আর তার বিপরীতে আছে নিউ টেস্টামেন্ট, মানবপুত্র জিশু ও পরমকারুণিক সর্বজনীন এক পরমপিতাই তো মধ্যমণি, গরিবগুর্বো জেলে আর কৃষক, আতুর ও পাপীয়সীদের কষ্টমোচন আর ত্রাণ কাহিনিতেই পর্বটি পূর্ণ। মানুষের ইচ্ছার সর্বোচ্চ প্রক্ষেপ তো ঈশ্বর, দুই পর্বের বাইবেল যেন দ্বিকোটিক মানব স্বভাবের বিবৃতি পছন্দমতো কোটিকে বেছে নেওয়া রসিকের কাজ।

পড়তে গিয়ে চোখ আটকে যায় চার খ্রিস্ট ভক্তের লেখা চারটি গসপেলে, জিশু জীবনী বৃত্তান্ত ও বাণীর চার সঙ্কলন। ঘটনাক্রম ঠিক থাকে, কেবল বাক্যের ভঙ্গিতে, তথ্যের সামান্য হেরফেরে আখ্যানের তাৎপর্য বদলে যায়, ভক্তের ভগবানও একমেটে থাকেন না।

গসপেলগুলি ভাবনা উস্কে দেয়। জিশু নিজেকে বার বার মানবপুত্র বলেছেন, প্রতিনিয়ত জানিয়েছেন যে, রক্তমাংসের মানুষ ‘বড় দুর্বল’, তিনিও ব্যতিক্রম নন। মানুষের সংশয়, অবিশ্বাস ও অবমাননার কাহিনিতে গসপেলগুলো ভরা, অসংখ্য পা-পিছলানোর মধ্যে ফিরে উঠে দাঁড়াবার সাধনার বৃত্তান্ত। নিজের গ্রামের লোকেরা জিশুকে বার করে দিয়েছে, এক জনই তাঁকে শত্রুদের হাতে ধরিয়ে দেয়, বিপদের মধ্যে শিষ্যরা তাঁকে অস্বীকার করে, উন্মত্ত জনতা তাঁর মৃত্যু দাবি করে। এহ বাহ্য। গসপেলের মানবপুত্র জিশু নিজেই সংশয়াকুল, ঘটনার চাপে বিপর্যস্ত হন, নিজের আত্মবিশ্বাসেই চিড় ধরে। বন্দি হওয়ার রাতে হতাশায় মগ্ন জিশু শক্তি প্রার্থনা করেন, লুকের ভাষায়, ‘‘তাঁর ঘাম যেন বড় বড় রক্তের ফোঁটা হয়ে মাটিতে ঝরে পড়তে লাগল।’’ গলগোথায় ক্রুশবিদ্ধ জিশু, দুপুরেই নেমে এসেছে অন্ধকার; জিশুর প্রথম চিৎকার, একেবারে তাঁর নিজের জবানিতে বিধৃত, ‘‘এলোয়ি এলোয়ি লেমা সাবাখ্তানি?’’, ‘‘ঈশ্বর আমার, ঈশ্বর আমার, কেন আমাকে পরিত্যাগ করেছ?’’ মৃত্যুর আগের মুহূর্তেও জিশু দ্বিতীয় বার চিৎকার করে ছিলেন, মার্ক বা মথি চিৎকারের শব্দ-কথাগুলি বলেননি। লুক সেটি জানিয়েছেন, ‘‘পিতা তোমার হাতেই প্রাণ সঁপে দিলাম।’’ জোহনের জানানো শব্দবন্ধটিই শেষ পর্যন্ত কানে বাজে, ‘তেতেলেসতাই’ বা ‘সব শেষ হল’। সব যন্ত্রণাই শমিত হয়, কারুণ্য পরিণতি পায় শান্তরসে।

গসপেল মানে তো সুসমাচার, মঙ্গলবার্তা। সব সময়ই বার্তা আসছে, তবে শোনার জন্য নিজের কান-মনকে তৈরি রাখতে হয়। কায়িক ও মানসিক ওয়েভলেংথ অনুযায়ী বার্তা নানা ভাবে শোনা যেতে পারে। সন্ত পিতা, সন্ত পল ও সন্ত জোহন এক বার্তা শোনেনি। মহামারিতে দীর্ণ ও মোদী-ট্রাম্প-বোলসোনারো শাসিত পৃথিবীর বাসিন্দা আমার মতো মানুষের কাছে গসপেল এক সংশয়ী সৎ জিৎজিজ্ঞাসু লোকের খবর পৌঁছে দেয়। আত্মসংশয়ী মানুষই তো দুঃশাসনীয় সময়কে প্রশ্ন করতে সক্ষম, নিজেকে শুদ্ধ করার তাগিদেই সে কালের মোকাবিলা করে, আত্মদর্শী হয়ে ওঠে বিশ্বদর্পণ। দর্পণে ধরা পড়ে অবমানিত, প্রহারে দীর্ণ নিজের ক্রুশ নিজে বহন করে নিয়ে যাওয়া মানুষের মৃত্যুঞ্জয়ী যাত্রা। যাত্রা আজও শেষ হয়নি। হয়তো কোনও দিন হবেও না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Christmas New Testament
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE