Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

খুব সহজে জাতীয় পানীয় হয়ে ওঠেনি চা

শুধুমাত্র একটি জনপ্রিয় পানীয় নয়, ভারতবর্ষে চা আমাদের প্রতি দিনের যাপন-সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোত এক প্রিয় অভ্যাস হিসেবে জীবনধারার অঙ্গ হয়ে উঠেছে সুদীর্ঘকাল ব্যেপে। এমনই এক স্বতঃসিদ্ধ ঐতিহাসিক সত্যানুসন্ধানে চা-সম্পর্কিত এই আলোকচিত্রময় ‘কফি টেবিল’ বইটি নির্মাণে ব্রতী হয়েছেন রেখা সারিন ও রাজন কপূর। রেখা শৌখিন গবেষক, রাজন মুখ্যত আলোকচিত্রী। রেখার গবেষণালব্ধ রচনা, রাজনের অসাধারণ আলোকচিত্র এবং সুমুদ্রিত সৌষ্ঠব বইটিকে আপাতরমণীয় করে তুলেছে।

অনুপ মতিলাল
শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

শুধুমাত্র একটি জনপ্রিয় পানীয় নয়, ভারতবর্ষে চা আমাদের প্রতি দিনের যাপন-সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোত এক প্রিয় অভ্যাস হিসেবে জীবনধারার অঙ্গ হয়ে উঠেছে সুদীর্ঘকাল ব্যেপে। এমনই এক স্বতঃসিদ্ধ ঐতিহাসিক সত্যানুসন্ধানে চা-সম্পর্কিত এই আলোকচিত্রময় ‘কফি টেবিল’ বইটি নির্মাণে ব্রতী হয়েছেন রেখা সারিন ও রাজন কপূর। রেখা শৌখিন গবেষক, রাজন মুখ্যত আলোকচিত্রী। রেখার গবেষণালব্ধ রচনা, রাজনের অসাধারণ আলোকচিত্র এবং সুমুদ্রিত সৌষ্ঠব বইটিকে আপাতরমণীয় করে তুলেছে।

রেখা ভারতবর্ষে চা-এর অভিজ্ঞতাকে তাঁর মতো করে চারটি নাতিদীর্ঘ অধ্যায়ে বিন্যস্ত করেছেন এবং সেই অধ্যায়গুলিকে পুনর্বিভাজন করেছেন সতেরোটি ক্ষুদ্র পরিচ্ছেদে। প্রথম অধ্যায়ের সূচনায় ‘চিরকালীন জনপ্রিয় চা’ শীর্ষক আলোচনায় তিনি সমগ্র দেশ জুড়ে, আঞ্চলিক সীমানা এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য উপেক্ষা করে, চা নামক পানীয়টির যে বিপুল জনপ্রিয়তা, তার সবিস্তার ব্যাখ্যা করেছেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের বর্তমান চা-অভ্যাস, চা-পানের পাত্রবৈচিত্র, বড় শহরগুলিতে এবং ছোট শহর ও গ্রামাঞ্চলে রাজপথের পাশে পাশে চা-পানকে কেন্দ্র করে যে ‘ধাবা’ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা-ও বিশদে আলোচনা করেছেন রেখা, চমত্‌কার ভাষা নৈপুণ্যে সেই আলোচনা হয়ে উঠেছে ভারি মনোজ্ঞ। কিন্তু চা তো রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি, বর্তমান জনপ্রিয়তার পশ্চাদভূমিতে যে দীর্ঘ বিবর্তের ইতিহাস লুকিয়ে আছে, রেখা সেই অতীতের অনুসন্ধান প্রয়োজন মনে করেননি। বস্তুত, উনিশ শতকের তিরিশের দশকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ভারতে চা উত্‌পাদন শুরু হয়েছিল নিছকই এক সাম্রাজ্যিক পণ্য হিসেবে। পরবর্তী কালে এই ‘সাম্রাজ্যিক পণ্য’টি নানা বন্ধুর পথ অতিক্রম করে কী ভাবে একদিন এ দেশে জাতীয় পানীয় হিসেবে ঘরে ঘরে জনপ্রিয় হয়ে উঠল, সেই ইতিহাসের কিঞ্চিত্‌ আভাস এই আলোচনায় প্রত্যাশিত ছিল।

বিশ শতকের একেবারে সূচনায় ১৯০১-এ ‘দি ইন্ডিয়ান টি মার্কেট এক্সপ্যানশন কমিশন’ এবং ১৯০৩-এ ‘দি ইন্ডিয়ান টি সেস কমিটি’ গঠিত হওয়ার আগে চা নামক পণ্যটিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে জনপ্রিয় করার কোনও সুসংহত এবং সক্রিয় উদ্যোগ ছিল না ব্রিটিশদের, এ দেশে উত্‌পন্ন চায়ের সিংহভাগ রফতানি হয়ে যেত ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায়। অর্থাত্‌, উত্‌পাদন শুরুর পর প্রায় সত্তর বছর অতিক্রান্ত হলেও চা সার্বিক ভাবে এ দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। গত শতকের শুরুতে অভ্যন্তরীণ প্রচার জোরদার হলেও জনপ্রিয় হওয়ার পথে এই পানীয়কে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে এবং তিরিশের দশকে ‘দি ইন্ডিয়ান টি মার্কেট এক্সপ্যানশন বোর্ড’ (১৯৩৬) এবং স্বাধীনোত্তর কালে ‘টি বোর্ড অফ ইন্ডিয়া’ গঠিত হওয়ার আগে চা একটি জাতীয় পানীয় হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। বিক্ষিপ্ত ভাবে জনপ্রিয় হলেও, একশো বছরেরও বেশি এই অভিযাত্রায় বিভিন্ন সময়ে চা-এর কপালে জুটেছে নানা দুর্ভোগ। ১৮৮০-র দশকে জাতীয়তাবাদী প্রেক্ষাপটে চা-শ্রমিকদের উপর চা-কর এবং আড়কাঠিদের অত্যাচার বহু মানুষকে চা-পান বিরোধিতায় মুখর করে তুলেছিল। এই বাংলায় প্রতিবাদে প্রখ্যাত ডাক্তার সুন্দরীমোহন দাস ও জাতীয়তাবাদী নেতা কৃষ্ণকুমার মিত্র চিরকালের মতো চা-পান ত্যাগ করেছিলেন। স্বদেশি রাজনীতির ধুয়ো তুলে চা-পানের অপকারিতা ব্যাখ্যা করে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় স্লোগান তুলেছিলেন ‘চা পান না বিষ পান’, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে শুদ্ধ তামিল আন্দোলনের জনক মারাইমালাই আদিগাল এবং তাঁর সহচরবৃন্দ চা-পানের বিরুদ্ধে প্রচার করেছিলেন। তামিলনাড়ুতে কফির পক্ষে এবং চায়ের বিরুদ্ধে একদল দীর্ঘকাল প্রচার চালিয়েছেন এই বলে যে, চা অ-ব্রাহ্মণ ও শ্রমিক-শ্রেণির পানীয়। ১৯৪০-এর দশকের গোড়াতেও গুজরাতের কচ্ছ অঞ্চলে চা-পানের অভ্যাস গড়ে ওঠেনি। সেখানকার মানুষ যথেষ্ট পরিমাণ চিনি ও ছাগলের দুধ সহযোগে চা-পাতা ফুটিয়ে লিকারটি ফেলে দিত এবং চিনি, জল ও দুধে মাখামাখি হওয়া মিশ্রণটি সুস্বাদু জলখাবার হিসেবে খেত। উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু অঞ্চলেও পানীয় হিসেবে ব্যবহৃত না হয়ে চা-পাতা পান্তাভাতে মিশিয়ে খাওয়ার রেওয়াজ ছিল দীর্ঘকাল। আসলে, চা সর্বত্র সর্বজনীন হয়ে ওঠেনি শুরু থেকেই। অঞ্চলভেদে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে চা-এর জনপ্রিয়তা ছিল বিভিন্ন রকম। দক্ষিণ ভারতের শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি চা-এর চেয়ে কফি’কেই ভালবেসেছে। অন্য দিকে, পূর্ব ভারতে একই মধ্যবিত্ত শ্রেণি মহার্ঘ এবং ক্ষতিকর মদ্যপানের চেয়ে চা-পানকেই শ্রেয় মনে করেছে। আবার, তিরিশের দশকে লেখা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প ‘মড়িঘাটের মেলা’য় দেখা যায় যে, গ্রাম বাংলায় দরিদ্র কৃষকের কাছে চা তখনও স্বাস্থ্যকর, কিন্তু বিলাসী এবং দামি পানীয়— ‘চায়ের দোকানের ভিড়ের মধ্যে দেখি মা অনিচ্ছুক ছোট ছেলের মুখের কাছে চায়ের ভাঁড় ধরে বলছে— খেয়ে নে, অমন করবি তো— এরে বলে চা— ভারি মিষ্টি— দ্যাখো খেয়ে— ওষুধ— জ্বর আর হবে না— আ মোলো যা ছেলে। চার পয়সা দিয়ে কিনে এখন আমি ফেলে দেব ক’নে? মুই তো দু ভাঁড় খ্যালাম দেখ্লি নে? খা—’। এই আলোচনার সূচনায় রেখা রবীন্দ্রনাথের প্রহাসিনী কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘সুসীম চা-চক্র’ কবিতাটির দু’টি ছত্র ইংরেজি অনুবাদে ব্যবহার করেছেন, কিন্তু কোনও অনুষঙ্গ উল্লেখ করেননি। প্রসঙ্গত বলা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ ১৯২৪-এ চিন দেশে গিয়ে দেখেছিলেন চা-পান একটি আর্টের মধ্যে গণ্য। চিন থেকে ফিরে সু-সুমো নামে বিশ্বভারতীর এক বিশিষ্ট চিনা বন্ধুর উত্‌সাহে শান্তিনিকেতনে একটি চা-বৈঠকের প্রবর্তন করেন তিনি। সেই বৈঠকের সূচনা উপলক্ষে কবিতাটি লেখা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন যে, তখনও ভারতবাসী প্রকৃত অর্থে ‘চা-স্পৃহ চঞ্চল’ হয়ে ওঠেনি।

এই অধ্যায়ের অন্য একটি পরিচ্ছেদে রেখা আলোচনা করেছেন ভারতে চা-এর পুনরাবিষ্কার ও উত্‌পাদনের সূচনাপর্বের ইতিহাস ‘ভারতে চা কী করে এল’ শিরোনামে। ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে (রেখা লিখেছেন ১৭৮৮) ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটির সভাপতি স্যর জোসেফ ব্যাঙ্কসকে বলা হয়েছিল, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য এ দেশে নতুন কৃষিজাত দ্রব্যের উত্‌পাদন-সম্ভাবনা নিয়ে একটি প্রতিবেদন লিখতে। সেই প্রতিবেদনেই ব্যাঙ্কস ভারতে চা-চাষ করার পরামর্শ দেন। তার পরের ঘটনাবলি এক দীর্ঘ ইতিহাস হয়ে আছে। সেই ইতিহাস রেখা সংক্ষেপে আলোচনা করেছেন। ভারতে চা নামক পণ্যটির পুনরাবিষ্কার নিয়ে নানা মিথ বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে আছে। রেখার গবেষণায় তার সবগুলির উল্লেখ নেই। ১৮২৩-এ অসমের জঙ্গলে স্কটিশ ব্যবসায়ী রবার্ট ব্রুস অসমের রাজার দেওয়ান মণিরাম দত্তবড়ুয়ার সহায়তায় প্রথম চা-চাষের সম্ভাবনা অনুসন্ধান করেছিলেন। পরের বছর রবার্টের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর পর তাঁর ভাই ক্যাপ্টেন চার্লস আলেকজান্ডার ব্রুস এই অনুসন্ধানে ব্রতী হন। কিন্তু তাঁর পাঠানো চা-পাতার নমুনাকে কলকাতার বোটানিকাল গার্ডেনের তদানীন্তন অধ্যক্ষ উদ্ভিদবিদ ন্যাথানিয়েল ওয়ালিচ (১৮১৪-য় ভারতীয় জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা) প্রকৃত চা-পাতা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃত হন। ১৮৩১ পর্যন্ত এই আবিষ্কারের কাজ থমকে ছিল। পরে, ১৮৩৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গভর্নর জেনারেল বেন্টিঙ্কের নেতৃত্বে বিশেষ ‘টি কমিটি’ গঠিত হলে (রেখা ১৮৩৩ লিখেছেন) ফ্রান্সিস জেনকিন্স এবং অ্যান্ড্রু চার্লটনের উদ্যোগে নতুন করে অনুসন্ধান শুরু হয়। এ বারে ওয়ালিচ তাঁর পূর্ব সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করলেন। ভারতে চা-এর উত্‌স সন্ধানে এই ইতিহাস রেখা বিবৃত করেছেন। এই ইতিহাসে উল্লেখিত হয়নি এডিনবরার বিখ্যাত উদ্ভিদবিদ রবার্ট ফরচুনের নাম, যিনি চিন দেশে চা-চাষ এবং উত্‌পাদন সম্বন্ধে একটি চমত্‌কার প্রতিচিত্র পেশ করেছিলেন ভারতের চা-চাষ উদ্যোগীদের কাছে।

এই বইয়ের অন্যান্য অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে চা-পর্যটন, অসম, দার্জিলিং ও দক্ষিণ ভারতে চা-উত্‌পাদন সম্পর্কিত সাম্প্রতিক চিত্র, প্ল্যান্টারদের জীবনলিপি, চা-বাগানের প্রাকৃতিক বৈচিত্র, স্বাস্থ্যকর পানীয় হিসেবে চায়ের গুণাগুণ প্রভৃতি নানা বিষয়। এই সব আলোচনা সাম্প্রতিক কালের নানা তথ্যে সমৃদ্ধ হয়েছে। এই আলোচনার অনুষঙ্গে রাজনের আলোকচিত্র বইটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। রাজনের আলোকচিত্র এই বইটির মূল সম্পদ। বইয়ের শেষে রেখা একটি নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি দিয়েছেন। সেই পঞ্জিতে চা-সম্পর্কিত দু’টি আকর গ্রন্থের অনুল্লেখ বিস্মিত করেছে। স্যর পার্সিভ্যাল গ্রিফিথ্‌স-এর দ্য হিস্টরি অফ দি ইন্ডিয়ান টি ইন্ডাস্ট্রি এবং ডব্লিউ এইচ উকার্স-এর অল অ্যাবাউট টি বই দু’টি না পড়ে ভারতে চা-সম্পর্কিত কোনও লেখা সম্ভব কি না জানা ছিল না।

টি বোর্ড অফ ইন্ডিয়া-র প্রাক্তন সচিব

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anup motilal tea book review book
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE