Advertisement
E-Paper

ভালমন্দ মিশিয়ে বাঙালির গৌরবকথা

কতকটা গর্বের সুরেই বছর ষাটেক আগে আচার্য যদুনাথ স্মরণ করিয়েছিলেন ‘প্রপিতামহদের’ কালে ইংরেজি শিক্ষা আর বুদ্ধির জোরে বঙ্গসন্তান কোয়েটা থেকে ভামো পর্যন্ত কী ভাবে ‘রাজত্ব’ করেছেন। এ যেন বাঙালির ভারত বিজয়।

শেখর ভৌমিক

শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৬ ০১:১১
জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস (বাঁ দিকে) ও ‘যোদ্ধা মুনসেফ’ প্যারীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় (ডান দিকে)।

জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস (বাঁ দিকে) ও ‘যোদ্ধা মুনসেফ’ প্যারীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় (ডান দিকে)।

কতকটা গর্বের সুরেই বছর ষাটেক আগে আচার্য যদুনাথ স্মরণ করিয়েছিলেন ‘প্রপিতামহদের’ কালে ইংরেজি শিক্ষা আর বুদ্ধির জোরে বঙ্গসন্তান কোয়েটা থেকে ভামো পর্যন্ত কী ভাবে ‘রাজত্ব’ করেছেন। এ যেন বাঙালির ভারত বিজয়। বাঙালি অবশ্য প্রবাসী হয়েছে আগেই। আঠারো শতকের তীর্থমঙ্গল-এই মুঙ্গেরের পশ্চিমভাগে মনোহর ‘মুখুর্য্যা’, প্রয়াগে দুলাল ‘চাটুর্য্যা’র পাশাপাশি কাশ্মীর বাঙালিটোলার বর্ণনা আছে। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস তাঁর বইয়ে ইংরেজ শাসনে প্রবাসে বাঙালির ক্রমবিস্তার দেখালেন। এর আগে ভিন প্রদেশে বাঙালির বসবাসের উল্লেখ করেছিলেন যদুনাথ সর্বাধিকারী। প্রোফেসর বোসের অপূর্ব্ব ভ্রমণবৃত্তান্ত-য় তো পেশোয়ারে বাঙালি মেস মায় রাওয়ালপিন্ডিতে বাঙালিদের তৈরি যাত্রাদলের কথাও আছে। তাঁরা অবশ্য বাঙালির গৌরবকথার প্রেক্ষিতে সে বিবরণ দেননি। সে অর্থে জ্ঞানেন্দ্রমোহন ব্যতিক্রমী।

মধ্য উনিশ শতক থেকে শুরু হওয়া স্থানিক ইতিহাস লেখার প্রবণতারই অনুসরণে ক্রমে ‘অঞ্চল’ চর্চা গুরুত্ব পায়। অনুপ্রেরণা আসে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়-র মতো মানুষদের ‘বাঙ্গালী’, ‘দেশের কথা’ জাতীয় লেখাপত্তরের মাধ্যমে। সেই প্রেরণার কথা শুরুতেই স্বীকার করে সমস্ত ‘কার্য্য বিভাগে’ বাঙালি কেমন করে ইংরেজের ‘দক্ষিণ হস্ত স্বরূপ’ ভারতময় ছড়িয়ে পড়লেন, সেই গৌরবকাহিনি লেখক তুলে ধরেছেন। বার বার ‘উপনিবেশ’ আর ‘ঔপনিবেশিক’ শব্দের ব্যবহারে তিনি শোনালেন বাঙালির উপনিবেশবাদের গল্প। আসলে সে সময় বাঙালির বীরত্ব, উদ্যমী মনোবল প্রচারের যেন এক জোয়ার এসেছিল। কৃষ্ণনাগরিক রায় মশাইয়ের কবিতার সেই বিখ্যাত দু’টি পঙক্তি— ‘একদা যাহার বিজয় সেনানী হেলায় লঙ্কা করিল জয়/ একদা যাহার অর্ণবপোত ভ্রমিল ভারত সাগর ময়’— জ্ঞানেন্দ্রমোহনও শুনেছিলেন নিশ্চিত।

বঙ্গের বাহিরে বাঙ্গালী, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস।
সম্পাদনা: নিমাইচন্দ্র পাল। সাগ্নিক বুকস, খণ্ড ১ ও ২, প্রতিটি ৭০০.০০

লেখক উৎসাহ পেয়েছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। প্রবাসী বাঙালি বিষয়ক প্রবন্ধ রচনায় উৎসাহ দিতে পুরস্কার চালু করেন রামানন্দ। সুবর্ণপদক জ্ঞানেন্দ্রমোহনকে বঞ্চিত করেনি। পেশায় পুলিশ ক্যাম্পে কনফিডেন্সিয়াল ক্লার্ক মানুষটি হয়তো ইন্টারমিডিয়েটও পাশ করেননি। চাকরিতে ঢুকেছেন আঠারো বছর বয়সে, বাইশ-তেইশ বছর ধরে ক্ষেত্রসমীক্ষা করে ‘জাতভাই’ খুঁজে যা লিখলেন, তাকে ‘ক্লাসিক’ বললেও কম হয়। তাঁর দাবি, এ ‘ঠানদিদির রূপকথা’ নয়, ইতিহাস। নিজে কোথাও না যেতে পারলে প্রশ্নাবলি পাঠিয়ে ‘নানা স্থানের অভিজ্ঞগণের’ উত্তর আনিয়েছেন। কী ভাবে প্রবাসী বাঙালিদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা যায়, তার লম্বা প্রক্রিয়া বা কৌশল বলে গেছেন ‘উত্তরা’ পত্রিকায়। ১৯২৭-এ মেরঠে অনুষ্ঠিত প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনের ষষ্ঠ অধিবেশনে প্রবাসী বাঙালির ধারাবাহিক ইতিহাস সংকলনের জন্য গঠিত সমিতির সভাপতি ছিলেন তিনি। সমগ্র উত্তর ভারত (যার মধ্যে সিকিম, ভুটান, নেপালও ছিল) জুড়ে বাঙালি বসতি বিস্তারের বিবরণ সংবলিত ‘উত্তর ভারত’ অংশ প্রকাশিত হয় ১৩২২ বঙ্গাব্দে। সংস্করণটি নিঃশেষিত হওয়ার পর তাকে দু’খণ্ডে নতুন করে ছাপবার জন্য বহু তথ্য জোগাড়ও করেন। তাই দক্ষিণ, পূর্ব ও বহির্ভারতের বাঙালিদের নিয়ে লেখা অংশের নাম দেন ‘তৃতীয় ভাগ’, প্রকাশিত হয় ১৯৩১-এ। প্রথম ভাগের পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ অবশ্য আর আলোর মুখ দেখেনি।

ভিন দেশে বাঙালির নানা কীর্তিকাহিনির তথ্যে ভরপুর দু’টি খণ্ড। বাঙালিরা সর্বত্র ‘গমন করিয়া’ সেখানকার ‘অধিবাসীদিগের মধ্যে’ কী ভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়ে ‘রাজভক্তি প্রচার’ করলেন, দাতব্য চিকিৎসালয় ইত্যাদি স্থাপন করে মানুষকে ‘আধুনিক যুগোচিত জ্ঞান-বিজ্ঞান’ শিক্ষা দিলেন, তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন গ্রন্থকার। এই বাঙালি উপনিবেশবাদের সঙ্গে কোথাও কি কিপলিং-এর ‘হোয়াইট ম্যান’স বার্ডেন’ মিলে যায়? জ্ঞানেন্দ্রমোহন নিজেই লিখেছেন বাঙালি ‘দেশপতির অদ্বিতীয় সহায়’। যদুনাথ সরকারও যাকে ‘অত্যাবশ্যক সহায়ক’ বলছেন। এর মাশুল বাঙালিদের কেমন দিতে হল, সেই বিবরণ আছে উত্তর ভারতে মহাবিদ্রোহের প্রত্যক্ষদর্শী যদুনাথ সর্বাধিকারীর লেখায়। ‘ম্লেচ্ছের দাস’ বলে নাক-কান কেটে দেওয়াও নাকি হয়। ফ্যানি পার্কস-এর নৌকোর উত্তর ভারতীয় লেঠেলরা শান্তিপুরের গঙ্গায় ভাসমান মৃতদেহে আঘাত করতে গিয়ে ‘বজ্জাত বাঙালির মুণ্ডু’ বলতেও কসুর করেনি। এই বাঙালি-পীড়নের বর্ণনার সঙ্গে ১৮৫৭-য় ইলাহাবাদে ‘যোদ্ধা মুনসেফ’ নামে পরিচিত প্যারীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সরকার-হিতৈষী বাঙালির কথাও জ্ঞানেন্দ্রমোহন গর্বভরেই বলেছেন।

আবার উনিশ শতকের ষাটের দশকের শেষেই ইলাহাবাদে সারদাপ্রসাদ সান্যাল আদালতে উর্দুর বদলে হিন্দি চালু করার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। ওড়িশায় ওড়িয়া ভাষা নিয়ে আন্দোলনেও বাঙালিদের একাংশ সদর্থক ভূমিকায় ছিলেন।

পরবর্তী কালে অবিভক্ত বিহার-সহ আরও অনেক বাঙালি উপনিবেশ সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় লিখেছিলেন জ্ঞানেন্দ্রমোহন। সেগুলি এই নতুন সংস্করণে সংযোজিত হলে গুরুত্ব বাড়ত। তবে প্রশ্ন হল তাঁর উত্তরাধিকারের। এই ঐতিহাসিক কাজের বাইরেও তো বহু উপাদান রয়ে গেল। বিহার-ওড়িশার বহু জনপদে তালাবন্ধ বাড়ির ফলকে ধূসর হয়ে আসা ‘আদরিণী’, ‘পিতৃস্মৃতি’-র মতো নামগুলো আজও পড়তে পারা যায়। মালিকের পরিচয় কখনও ‘প্লিডার’, কখনও ‘নাজির’ বা ‘সেরেস্তাদার’— আরও কত কী।

এদের জাত্যাভিমান প্রবলই ছিল। পুরী পুরসভার নথিতে উনিশ শতকেই তারাকান্ত বিদ্যাসাগর বা রামচন্দ্র আঢ্যের মতো বহু বাঙালির স্বাক্ষর রয়েছে বিশুদ্ধ বাংলায়। বিশিষ্টদের পাশে সাধারণ মানুষও ছিলেন— নন্দী শর্ম্মা ওরফে কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর কাশীর কিঞ্চিৎ-এর ‘চাঁপাদাসী’, ‘মেনীর মাসী’র মতো— দেখা দরকার তাঁদেরও। ক্ষেত্রসমীক্ষার পাশাপাশি উপাদান হিসাবে স্মৃতিকথা, ভ্রমণবৃত্তান্ত আছে। বহু প্রবীণ প্রবাসী বাঙালি এখনও জীবিত। ছাত্রজীবন পর্যন্ত বিহারে কাটানো বিশ্বভারতীর প্রয়াত অধ্যাপক বিকাশ চক্রবর্তীর স্মরণগ্রন্থে অনেকের লেখায় মজফফরপুরের মতো শহরে ‘হরিসভা’ পরিচালিত স্কুল বা ‘মুখার্জ্জী সেমিনারী হাইস্কুল’-এর কথা পড়তে পড়তে মনে হয় ‘ম্লেচ্ছের দাস’রা তো অনেক ভাল কাজও করেছেন। আবার অগৌরবের দিকগুলোও দেখা দরকার। স্থানীয় সমাজকে প্রবাসী বাঙালিরা কী ভাবে দেখতেন? জ্ঞানেন্দ্রমোহন কিছু না বললেও দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন-এ ‘গাত্রে দুর্গন্ধ’যুক্ত বিহারিদের ‘মেষের পাল’-এর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এই উন্নাসিকতাই যে সম্প্রীতিতে চিড় ধরায় একশো বছর আগে লেখা ‘ভাগলপুর চিত্র’য় ‘বিহার ও উড়িষ্যা সিভিল সারভিস’-এর আধিকারিক নগেন্দ্রনাথ মিত্রের মতো মানুষ তার উল্লেখও করতে ভোলেননি। জ্ঞানেন্দ্রমোহন বাঙালির যে এই বিরাট জগতের উল্লেখ করলেন, আজ কেন তা বেঙ্গালুরু আর নয়ডা বা গুরগাঁও-এ এসে ঠেকল, তা দেখা দরকার। এমন অনেক ভাবনা উস্কে দিল দু’টি খণ্ড।

সম্পাদনায় ত্রুটি কিছু রয়ে গিয়েছে। ‘উত্তর ভারত’ অংশে প্রথম ও পুনর্মুদ্রিত সংস্করণের প্রকাশকালের উল্লেখ নেই। ভূমিকার প্রথম দু’টি পাতার পর ঢুকেছে প্রকাশক ও গ্রন্থকারের নিবেদন অংশ। তারপর রয়েছে ভূমিকার অবশিষ্টাংশ। নির্ঘণ্ট উধাও। মুদ্রণপ্রমাদ— ‘অযোধ্যা প্রদেশ’-এর ‘অযোধ্যা প্রবেশ’ বা ‘ব্রজমণ্ডল’-এর ‘বজ্রমণ্ডল’ হয়ে যাওয়া চোখে লাগে। শুরুতেই ‘মানবজাতির উপনিবেশ, প্রবাস ও পরিব্রাজন’ শীর্ষক সারণিটি খুঁজে পাওয়া গেল না। এই সব ত্রুটি-বিচ্যুতি বাদ দিলে এই ধরনের বঙ্গ-গৌরবের পুনর্মুদ্রণ সময়োপযোগী। গৌরব বলার কারণ এই প্রাদেশিকতাবোধকে সংকীর্ণ বললেও তাকে কি আমরা এড়াতে পেরেছি? সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ছক্কা হাঁকালে ভারতীয় হিসাবে গর্বিত হই, নাকি বঙ্গসন্তান হিসেবে,— এ প্রশ্ন তো অনেক টাকার।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy