Advertisement
E-Paper

রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন স্বপ্নের দরজায়

দশক বিভাজনের রীতি বাংলা কবিতায় নতুন নয়। এই বিভাজন কবিরাই করেন। তাঁরা দাবি করেন— আমি সত্তরের, আমি নব্বইয়ের, আমি শূন্য দশকের। আবার তাঁরাই ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেন— না না, দশক-টশক কোনও ব্যাপার নেয়, লেখাটা হচ্ছে কি না সেটাই বড় কথা।

শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০০
এই যে থাকা, দেবদাস আচার্য। ছোঁয়া, ১০০.০০

এই যে থাকা, দেবদাস আচার্য। ছোঁয়া, ১০০.০০

সুর লেগে আছে বারান্দায়, মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস। সিগনেট প্রেস, ১০০.০০

আমি আর আদিনাথ, সুকল্প চট্টোপাধ্যায়। সপ্তর্ষি প্রকাশন, ৬০.০০

কবিতা সংগ্রহ ২, নির্মল হালদার। ছোঁয়া, ২৫০.০০

দশক বিভাজনের রীতি বাংলা কবিতায় নতুন নয়। এই বিভাজন কবিরাই করেন। তাঁরা দাবি করেন— আমি সত্তরের, আমি নব্বইয়ের, আমি শূন্য দশকের। আবার তাঁরাই ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেন— না না, দশক-টশক কোনও ব্যাপার নেয়, লেখাটা হচ্ছে কি না সেটাই বড় কথা। জীবনানন্দের কি কোনও দশক আছে? পরপর পাঁচটি কবিতার বই দেখে এ রকমটাই মনে জাগে। মণিদীপা নন্দী বিশ্বাসের সুর লেগে আছে বারান্দায় পাঠ করতে করতে এক ধরনের ঘোর জন্মায়। ‘বাবার ব্লিডিং হার্টের মাঝখানে/ ছোট্ট লাল ফুল/ কান্না ঝরে সুপ্রকাশের/ অপঘাতে মৃত্যুর পর...’ চমৎকার গঠন কবিতার। এখানে ‘সুপ্রকাশ’ নাম বা শব্দের ব্যবহার অত্যন্ত আকস্মিক ও অমোঘ। কে সুপ্রকাশ কে জানে? কিন্তু তারও একটা দাবি টের পাওয়া যায়। ‘নৌকো’ কবিতার প্রথম দু’টি লাইন— ‘রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন স্বপ্নের দরজায়/ কিংবা সারা বছর। আদিগন্ত চরাচর জুড়ে’। মণিদীপা যে রবীন্দ্রনাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত, তা তাঁর কবিতা পড়লেই বোঝা যায়, যেমন মণিদীপা ডুবে আছেন তোর্সায়। ‘ফেরিঘাট’ কবিতাটি তার উজ্জ্বল উদাহরণ— ‘তোর্সা পার হয়ে তিস্তায়/ নীল গামছার ফেরিঘাট.../ চোখে পড়েনি তোমার জন্য/ এনে দিতে পারি কী যে...’। ছন্দের দখলেও মণিদীপা যথেষ্ট ভাল— ‘এখন আমার ঘরের টেবিল রবীন্দ্রনাথ/ এখন শুধুই টুকরো কথা গানের উপর আলপনা দাগ/ এখন শুধুই মনখারাপের পাহাড় ডিঙোই রাতের পাখি’।

সুকল্প চট্টোপাধ্যায়ের আমি আর আদিনাথ অন্য রকম কবিতা পাঠের অভিজ্ঞতা দেয়। উৎসর্গটাই চমৎকার। ‘মা কিংবা প্রেমিকা/ দূর্বা মুখোপাধ্যায়ের/ করকমলে’। চার পর্বে ভাগ এ বইয়ের। ইন্টিরিয়ার ডেকরেশন, হাটে বাজারে, আমি আর আদিনাথ, মাটির সংসার। চারটি পর্বের বিষয় বিভিন্ন হলেও কাব্যভাষা মূলত এক। সেটাই স্বাভাবিক। এ বই পাঠের সময় বারংবার উৎপলকুমার বসুর কথা মনে পড়ে। মনে পড়লেও সুকল্প যেন নিজের স্বর তৈরি করেছেন। ‘তোমার মহাভারত পড়া হলে/ তাকে তুলে রেখে খাবার গরম করতে যাও রোজ/ আমি চুপিচুপি তখন বইখানা নামাই/ অবাক হয়ে দেখি, কাশীদাসী মহাভারতে/ যুদ্ধের সময়সীমা পাল্টে গেছে,’। চমৎকার আধুনিক ইমেজারি। সুকল্প-র কবিতা পড়তে পড়তে মোহাবিষ্ট হতে হয়। যেমন— ‘কেনাবেচা থেকে সামান্য দূরত্বে অন্ধটি গান গায়/ দোকানির দর হাঁকা, খদ্দেরের বায়না/ টিপ্পনী আর সব্জি মাছ গন্ধ মাখা হাওয়ায়/ সে গান ভেসে যায় বাজার থেকে দূরে’। আদিনাথ-এর অংশটা যেন সুকল্প আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলছেন। এ বইয়ের শেষ অংশ ‘মাটির সংসার’। ৬৪ নম্বর পাতায় যে শেষ কবিতাটি রয়েছে, এর মতো এত ভাল শেষ কবিতার বইয়ে খুব কম পাওয়া যায়: ‘পুকুরপাড়ে পালাই, পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে বসে কাঁদি/ লক্ষ্য করি বিকেলের জলে/ আমাদের সংসারটির ছায়া পড়েছে’।

কবিতাসংগ্রহ, গৌতম বসু। আদম, ২০০.০০

গৌতম বসু-র কবিতাসংগ্রহ, অন্য ও অনন্য অভিজ্ঞতা। ১৯৮১ সালে ‘অন্নপূর্ণা ও শুভকাল’ প্রকাশের পর থেকে ‘স্বর্ণগরুড়চূড়া’ অবধি ও সঙ্গে অগ্রন্থিত কবিতা। গৌতম বসু একদমই রবীন্দ্রনাথের ভাষায়— ‘কে গো অন্তরতর সে’। তাঁর গোটা সংগ্রহের মধ্যে ইমন-বেহাগ ও ভৈরবী অত্যন্ত পরিশীলিত যাতায়াত করে। ক্রিয়াপদ ও শব্দের ‘তৎসম’ ব্যবহার যে ইচ্ছাকৃত ভাবে কতটা আধুনিক করে তোলা যায়, এই সংগ্রহ তার নিদর্শন। ‘মেঘ তুমি যাকে ছুঁয়ে যাও, সৃষ্টির মরালী/ একবস্ত্রে ঘুমে ডুবে আছে রথের ছায়ায়’। অক্ষরবৃত্তের ব্যবহারের মধ্যে যে চিত্রকল্প, তা মাধুর্যে ভরা। যেমন এই দু’-একটা লাইন না তুললেই নয়— ‘কেন যে তোমার নাম নিয়েছিলাম ভোরবেলায়, কেন জেগে আছি,/ ভেঙে পড়েছিলাম কেন, কেন-ই বা সব জোড়া লেগে গেল আবার’।

নির্মল হালদার বাংলা কবিতার প্রতিনিধিস্থানীয়। উত্তাল সত্তরে মালিন্যহীন নির্মলের জয়যাত্রা শুরু। তিনি নির্মল হালদার বলেই লিখতে পারেন— ‘হেই বাবা মারানবুরু/ আমাকে একটি পুত্র আরেকটি কন্যা এনে দাও/ কন্যাও যে ঘরের শোভা/ আমাকে কন্যা এনে দাও।’ তাঁর কবিতায় রাজনৈতিক অবস্থানও স্পষ্ট। শুধু স্পষ্ট নয়, প্রতিবাদীও। সেই সঙ্গে নির্মল যেন সম্পূর্ণ একাকী এক পুরুষ, যাঁর কোনও উত্তরপুরুষ নেই। তাই তিনি লেখেন— ‘ট্রেন যায়, ট্রেন আসবেও/ কোনও ট্রেন আমার নয়/ কোনও সন্তানই আমার সন্তান নয়/ সন্তান কামনায় আমি এক পুরুষ/ বুকে লালন করি নিজের রক্তবীজ’— এ উচ্চারণ এক অর্থে হাহাকার, আবার এ উচ্চারণ আর এক অর্থে গভীর বাণী কোনও কবির, যা শোনা যায় ঘন মেঘের ফাঁকে।

দেবদাস আচার্য সত্তরের কবিদের ‘আচার্য দ্রোণ’। তাঁর পত্রিকাকে ঘিরে বড় হয়েছেন এমন কবি কম নন। কিন্তু দেবদাস যেন আত্মসমাহিত এক কবি, যিনি নিজেকে অনেক দূরে সরিয়ে রেখেছেন।— ‘গ্রামের দিকে বেঁকে যাওয়া পথ/ কয়েকটা উঁচু তালগাছ/ তির তির করে বয়ে চলা একটা সোতা/ এরা সবাই এখানে/ পরস্পরের সঙ্গে/ গল্প করছে’। কী আশ্চর্য ঝংকারহীন এক রম্যদৃশ্য। দেবদাস ‘সে দিকেই’ নামে একটি কবিতা রচনা করেছেন, পুরো কবিতাটাই তুলে দিতে পারলে ভাল হত। এ বই দেখায় আভরণহীনতা কবিতাকে কতদূর নিয়ে যেতে পারে। প্রতিটা মুহূর্তেই কবি সব কিছুর সঙ্গে জড়িত, আবার সব কিছু থেকে বিযুক্ত, যেন অনেকটা ওপর থেকে দেখছেন।

সব মিলিয়ে এ যেন অফুরান এক কবিতা।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy