Advertisement
E-Paper

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেই ছিল শিল্পীর প্রতিরোধ

সম্প্রতি অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত মকবুল ফিদা হুসেন-এর প্রদর্শনীটি দেখে এসে লিখছেন মৃণাল ঘোষমকবুল ফিদা হুসেন-এর (১৯১৫-২০১১) জন্মশতবার্ষিকী অতিবাহিত হল গত বছর। আমাদের দেশে ১৯৪০-এর দশক পরবর্তী আধুনিকতাবাদী চিত্রধারায় তাঁর অবদান অপরিসীম।

শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০০

মকবুল ফিদা হুসেন-এর (১৯১৫-২০১১) জন্মশতবার্ষিকী অতিবাহিত হল গত বছর। আমাদের দেশে ১৯৪০-এর দশক পরবর্তী আধুনিকতাবাদী চিত্রধারায় তাঁর অবদান অপরিসীম।

জীবনকালে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে তাঁর মতো এত ব্যাপক অভিঘাত সৃষ্টি করতে পেরেছেন খুব কম শিল্পী।

ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে এটা খুব লজ্জার যে ধর্মীয় মৌলবাদের তাড়নায় এ রকম একজন শিল্পীকে জীবনের অন্তিম পর্বে তাঁর প্রিয় জন্মভূমি এই দেশ থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছে।

এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোথাও কোনও তীব্র প্রতিরোধ জাগেনি।

তাঁর শতবার্ষিকী স্মরণে কলকাতার অ্যাকাডেমিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল প্রদর্শনী, আলোচনা-সভা সহ নানা অনুষ্ঠান।

এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিল বিরাসাত আর্ট। সহযোগী ছিল গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ, রিফ্লেকশন অব অ্যানাদার ডে, সোসাইটি অব কন্টেম্পোরারি আর্টিস্টস, ক্যালকাটা পেইন্টার্স, থার্ড আই, স্পেকট্রাম ইত্যাদি সংস্থা।

অ্যাকাডেমির সব ক’টি গ্যালারি জুড়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে হুসেনের ছবির প্রদর্শনী।

মূল ছবি অবশ্য দেখানে সম্ভব হয়নি। দেখানো হয়েছে ছাপচিত্র— গ্র্যাফিক ও যান্ত্রিক, দু’রকমই। তবে তার ভিতর দিয়ে অবশ্য হুসেনের ছবির মূল প্রবণতাগুলি অনেকটাই প্রতিফলিত হয়েছে।

তাঁর তৈরি দুটি ফিল্ম-ও দেখানো হয়েছে ‘থ্রু দ্য আইজ অব আ পেইন্টার’ ও ‘গজগামিনী’।

এই উদ্যোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল আলোচনাসভাগুলি। অ্যাকাডেমি ছাড়া একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে।

সমগ্র প্রকল্পের আহ্বায়ক ছিলেন গণেশ প্রতাপ সিংহ।

হুসেনের শিল্পকলার বিকাশ ঘটেছে মুম্বইয়ের ১৯৪০-এর দশকের শিল্প আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে। ‘প্রোগ্রেসিভ আর্টিস্টস গ্রুপ’-এর সঙ্গে থেকেও হুসেন ছিলেন অন্য সবার থেকে আলাদা।

আঙ্গিকের ভিতর দিয়ে তিনি জাতীয় ঐতিহ্য ও আন্তর্জাতিক আধুনিকতার সমন্বয় সাধন করে নিজস্ব এক আত্মপরিচয় সন্ধান করেছেন।

রূপের সংক্ষিপ্ততা বা সংবৃতিই ছিল তাঁর আঙ্গিকের প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিন্তু নিছক আঙ্গিকবাদী তিনি ছিলেন না।

জীবনের সঙ্গে তাঁর যোগ ছিল নিবিড়। তৃণমূল স্তরের বাস্তবতাকে তিনি উপলদ্ধি করেছেন দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে তাঁর জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে।

গ্রামীণ ভারতের প্রতি যেমন তাঁর গভীর দায়বোধ ছিল, তেমনই ভারতের অধ্যাত্মসাধনা, পুরাণ ও ইতিহাসের বৈচিত্রকেও অত্যন্ত সম্ভ্রমের চোখে দেখেছেন।

এই প্রদর্শনীতে ছিল তাঁর ‘মহাভারত’ চিত্রমালার কয়েকটি ছবি। তারই একটি ছবির শিরোনাম ‘ভীষ্ম — কুরুক্ষেত্রের দশম দিন’।

শরশয্যায় শায়িত রয়েছেন ভীষ্ম। বিশদহীন দ্বিমাত্রিকতায় রূপায়িত তাঁর শরীর। সারি সারি একরৈখিক তিরচিহ্নে বোঝানো হয়েছে শরশয্যা। উপরে দশটি সমমাপের বর্গাকার ক্ষেত্রের ভিতর অর্ধবৃত্তাকারে উদীয়মান সূর্য। সমাপ্তি ও সূচনা একই সঙ্গে আভাসিত।

এ ভাবেই আধ্যাত্মিকতা ও নান্দনিকতার সমন্বয় ঘটিয়েছেন হুসেন তাঁর ছবিতে।

‘মাদার টেরেসা’ চিত্রমালায় আমরা দেখি কেমন করে সংবৃত একটি প্রতীকের মধ্য দিয়ে তিনি মাতৃত্বের আবিশ্ব করুণাকে বুঝিয়েছেন।

‘বেনারস চিত্রমালা’-র ঘনকৃষ্ণ প্রেক্ষাপটে শুধুই আলোকিত রেখায় আঁকা কয়েকটি ছবি ছিল এই প্রদর্শনীতে।

এত নিবিড় সংক্ষিপ্ততায় এত গভীর বাণীর সঞ্চার এই শিল্পীর রূপানুভবের শ্রেষ্ঠ সম্পদ।

কিন্তু হুসেন কখনওই নিছক শিল্পের জন্য শিল্প করেননি। আত্মপ্রদর্শনের প্রবণতা তাঁর ছিল। কিন্তু তা তাঁর গভীর সামাজিক দায়বোধকে কখনও আবৃত করেনি।

২০০২ সালের এপ্রিল-মে মাসে সন্ত্রাসে পৃথিবী তোলপাড় হচ্ছে। মানবতার এই দুর্মর পরাজয়ের মুহূর্তে একজন শিল্পীর যা করণীয় হুসেন তা-ই করেছেন। সংবাদের উপর এঁকেছেন হত্যা, ঘৃণা, অন্ধকার।

এক দিকে ধ্রুপদী আর লৌকিকের সংশ্লেষের ভিতর দিয়ে দেশের প্রাণ কেন্দ্রটির সন্ধান, আর এক দিকে উত্তর-আধুনিক কনসেপচুয়াল আর্টের আত্তীকরণ— এই দুই প্রান্তের মধ্যে আন্দোলিত হয়েছে হুসেনের রূপভাবনা।

শিল্প ও জীবনকে এ ভাবে মিলিয়ে নেওয়ার মধ্যেই ছিল তাঁর প্রজ্ঞার পরিচয়।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy