রাজ্যে বিধানসভা ভোট যত এগিয়ে আসছে নিত্য নতুন শিলান্যাস আর উদ্বোধনে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে তৃণমূল সরকার। ‘মাল্টি সুপার স্পেশ্যালিটি’ হাসপাতাল থেকে নানা নতুন ইউনিট— বাদ থাকছে না কিছুই। কিন্তু প্রশ্নের মুখে পড়ছে ধুঁকতে থাকা পুরনো পরিকাঠামোর মৌলিক মানোন্নয়ন না ঘটিয়ে এই সব নতুন পরিকাঠামোয় টাকা খরচ করার বর্তমান সরকারি নীতি।
যার নিট ফল— গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিকাঠামো আরও বেহাল হয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ। আর তারই জেরে রামপুরহাট মহকুমা হাসপাতালের মতো ‘স্বাস্থ্যজেলা’ হাসপাতালগুলিতে কর্মী-চিকিৎসকের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে রোগী পরিষেবা। সব থেকে সমস্যায় পড়েছেন সেখানকার নার্সিং স্টাফেরা। ওই হাসপাতালে গত কয়েক বছরে এক দিকে শয্যা সংখ্যা বেড়েছে। উল্টো দিকে, যাঁরা সেই পরিষেবা দেবেন, সেই তার তুলনায় নার্সের সংখ্যা দিনের পর দিন কমেছে। ফলে ক্ষোভ বেড়েই চলেছে সেখানকার রোগী ও নার্সের মধ্যে।
হাসপাতাল সূত্রের খবর, সেখানে আগে ছিল ২৮৬টি শয্যা। নতুন এসএনসিইউ ও সিসিইউ ইউনিট খোলার পরে বর্তমানে শয্যা সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২৬-এ। নিয়ম অনুযায়ী প্রতি চার রোগীর অনুপাতে এক জন করে নার্স থাকার কথা। েখানে রামপুরহাটের এই হাসপাতালে কোনও কোনও ওয়ার্ডে ৫০ জন রোগীর দেখভালের জন্য মাত্র দু’জন নার্স রয়েছেন। হাসপাতালের নার্সিং সুপার সুস্মিতা বণিক বলছেন, ‘‘এই হাসপাতালে যে অনুপাতে রোগী থাকেন, তাতে মহূর্তে ১৮৩ জন নার্স প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে রয়েছেন মাত্র ৮৩ জন নার্স। ফলে প্রয়োজনীয় আরও ১০০ জন নার্সকে ছাড়াই আমাদের এই হাসপাতালে পরিষেবা জুগিয়ে যেতে হচ্ছে। ফলে যে রকমের অসুবিধা হওয়ার কথা, তা তো স্বাভাবিক ভাবেই হচ্ছে।’’
এ দিকে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণা অনুযায়ী এই মহকুমা হাসপাতাল খাতায়-কলমে ইতিমধ্যেই জেলা হাসপাতালে ‘উন্নীত’ হয়েছে। ওই হাসপাতাল চত্বরেই তৈরি শুরু হয়েছে ‘মাল্টি সুপার স্পেশ্যালিটি’ হাসপাতাল গড়ার কাজ। আবার এই হাসপাতালেই মুখ্যমন্ত্রীর ‘মেডিক্যাল কলেজ’ গড়ার প্রতিশ্রুতিও মতো পরিদর্শনের কাজও সমাপ্ত হয়েছে। নিত্য নতুন পরিকাঠামোর ভিড়ে নতুন বিল্ডিং, রংয়ের পোঁচ পড়লেও চিকিৎসক-নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যার দিক থেকে এখনও বহু পিছিয়ে হাসপাতালের পুরনো পরিকাঠামোটিই। যা দেখেশুনে রোগীর পরিজনদের প্রশ্ন, ‘‘পুরনো পরিষেবাই তো তলানিতে। পর্যাপ্ত নার্স না থাকায় এখনই রোগীদের ঠিকমতো যত্ন নিতে পারছেনা না নার্সেরা। নতুন হাসপাতাল চালু হলে সেখানে আদৌ পরিষেবা মিলবে তো?’’
ঘটনা দেখে তৃণমূল সরকারকে বিঁধতে ছাড়ছেন না বিরোধীরা। তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন দু’দিন আগে মেদিনীপুরের নয়াগ্রামের ঘটনার কথা। যেখানে মুখ্যমন্ত্রীর সাধের ‘মাল্টি সুপার স্পেশ্যালিটি’ হাসপাতালগুলির কী হাল, তা বিলক্ষণ টের পেয়েছিলেন শাসকদলেরই কিছু কর্মী-সমর্থক। সে দিন নয়াগ্রামে দলনেত্রীর সভায় যোগ দিতে গিয়ে পিকআপ ভ্যান উল্টে জখম হয়েছিলেন কিছু তৃণমূল কর্মী। কাছের নয়াগ্রাম মাল্টি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে গেলে সেখানে তাঁরা কোনও পরিষেবাই পাননি বলে অভিযোগ।
জেলা সিপিএমের এক নেতার দাবি, ‘‘মাল্টি সুপার, মেডিক্যাল কলেজ— এ সবই আসলে জনগণকে বুদ্ধু বানিয়ে তৃণমূল নেতাদের সহজে ভোট-বৈতরণী পার হওয়ার এক ধরনের খেলো চেষ্টা!’’
বিরোধীরা যা-ই বলুন, হাসপাতালের বর্তমান পরিকাঠামোর এমন বেহাল দশায় ক্ষোভ বাড়ছে চিকিৎসক-নার্স মহলেও। রামপুরহাটের হাসপাতালের নার্সদের একটা বড় অংশের বক্তব্য, ‘‘নার্স কম থাকায় চাপের মধ্যে ডিউটি করতে হচ্ছে। ভীষণ প্রয়োজনে ছুটি চাইলেও পাচ্ছি না আমরা। এর মাঝে কোনও অঘটন ঘটে গেলে আমাদের উপরেই তো সরকারি খাড়া নেমে আসবে!’’ স্পষ্টই তাঁদের ইঙ্গিত গত ২০ নভেম্বর রাতে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের এসএনসিইউ-এ ‘রেডিয়েন্ট ওয়ার্মারে’ পুড়ে দুই সদ্যোজাতের মৃত্যুর ঘটনা। যার পরে হাসপাতালের তিন জুনিয়র ডাক্তার এবং এক নার্স সাসপেন্ডকে হয়। যদিও সেখানেও প্রয়োজনের তুলনায় নার্সের সংখ্যা বহু কম ছিল বলেই অভিযোগ।
হাসপাতালের এমন দশা নিয়ে মুখ খুলতে নারাজ তৃণমূল। বক্তব্য মেলেনি স্থানীয় বিধায়ক তথা স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তবে, হাসপাতাল সুপার সুবোধকুমার মণ্ডলের দাবি, হাসপাতালে নার্সিং স্টাফ কম থাকার কথা একাধিক বার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।