Advertisement
E-Paper

গরিব মানুষ রাজনীতিবিমুখ হতে পারেন না

ট্রেন কম্পার্টমেন্ট মানে শব্দের বাহুল্য। কথার পর কথা, কথা কেটে কথা। এবং প্রায়শই অন্যদের কথা চাপা দিয়ে কথা। ট্রেনের যান্ত্রিক শোরগোলও সেই কথার কাছে হার মানে। আর সেটা যদি হয় ভোটের মরশুম, তা হলে তো কথা-ই কথা। ট্রেন, চায়ের দোকান, সব্জির বাজার, সর্বত্র রাজনীতি বিষয়ক তার্কিকতার সরব নমুনা। কিন্তু কেন যেন মনে হয়, একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে।

কুমার রাণা

শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০১৪ ০০:০৮

ভয়ে কথা বলিস নে আর

চোখ রাঙিয়ে বলিস নে আর

মুখ বাঁকিয়ে বলিস নে আর

... শুনতে শুনতে, ভয়ের কথা শুনতে শুনতে

কখন দেখি হাই তুলে এক ছোট্ট শিশু

বলছে: আরেক গল্প বলো, আরেক গল্পো—

ভয়ের গল্প এক্কেবারে বাজে।

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

ট্রেন কম্পার্টমেন্ট মানে শব্দের বাহুল্য। কথার পর কথা, কথা কেটে কথা। এবং প্রায়শই অন্যদের কথা চাপা দিয়ে কথা। ট্রেনের যান্ত্রিক শোরগোলও সেই কথার কাছে হার মানে। আর সেটা যদি হয় ভোটের মরশুম, তা হলে তো কথা-ই কথা। ট্রেন, চায়ের দোকান, সব্জির বাজার, সর্বত্র রাজনীতি বিষয়ক তার্কিকতার সরব নমুনা। কিন্তু কেন যেন মনে হয়, একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। শিয়ালদহ-বোলপুর, হাওড়া-বর্ধমান, সাঁতরাগাছি-ঝাড়গ্রাম, নাতিদীর্ঘ ট্রেন সফরগুলোয় তর্ক ও চিৎকার জারি আছে, যাঁরা ঘুমোতে চান এবং বিরল যে দু-এক জন কিছু পড়তে চান, তাঁদের বিরক্ত-বিষণ্ণ করে অনর্গল কথা চলছে।

কিন্তু কী আশ্চর্য, ভোট নিয়ে কোনও বাক্যক্ষেপ নেই। তা হলে কি বঙ্গবাসী রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়ল? প্রশ্নের তুলনায় উত্তরটা অনেক জটিল, নৈর্ব্যক্তিক, টিক-দেওয়া উত্তরে কুলোবে না, কেননা এটা লোকভেদে ভিন্ন রকম। চাকুরিজীবী— কেরানি, মাস্টার, ছোট-বড় আমলা— প্রাইভেট টিউটর বা স্বনির্ভর কমিশনভোগী অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে যারা নাম লেখায়, তারা যত সহজে রাজনীতিবিমুখ হতে পারে; ঠেলাওলা, দিনমজুর, প্রান্তিক চাষি বা ভ্রাম্যমাণ ব্যাপারির পক্ষে তা সম্ভব নয়। আমাদের কথা নয়, সমাজ-গবেষক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের প্রজ্ঞা আমাদের এ কথা জানিয়েছে। সক্রিয় রাজনীতিতে মধ্যবিত্ত বাঙালির যোগটা যে নিরন্তর নয়, সেটা জানা, কিন্তু ঝুঁকিহীন রাজনীতি বিষয়ক তর্কেও তার অনাগ্রহ? এতকাল তো এই তর্কই ছিল তার পুঁজি, অন্য পক্ষে যে বাঙালি প্রবল ভাবে রাজনীতি-নির্ভর, সেই শ্রমজীবী অংশটা এ নিয়ে কথা বলার ফুরসতই পায়নি। তাদের মেসোমশাইগিরি করে এসেছে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত।

তা হলে এ বারের নির্বাচনের ধারাটা অন্য রকম ঠেকছে কেন? এ রাজ্যের যুযুধান চারটি দলের চার জন নেতার কাছে প্রশ্নটা রাখতেই সমস্বর উত্তর: ‘হ্যাঁ, ঠিক, লোকে কিছুটা রাজনীতিবিমুখ হচ্ছে।’ সব বিষয়েই যাঁরা পরস্পর মতবিরোধী— অসহিষ্ণু ভাবে বিরোধী— তাঁরা আবার রাজনীতি-বিমুখতার কারণটা সম্পর্কেও সম্পূর্ণ একমত: ‘এ সব বাজার অর্থনীতির কুফল, বিশ্বায়নের ধাক্কা, বিশেষত যুবসমাজ প্রচণ্ড বিভ্রান্ত।’ এগুলো তো বামপন্থী লব্জ বলে লোকে জানে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের জল-হাওয়ায় কংগ্রেস-বিজেপিতেও এই বাগ্বাজি!

লব্জ-নির্ভরতার একটা বড় সুবিধা আছে। সমস্যাটাকে কোনও একটা বাক্যের খোপে পুরে ফেলতে পারলে ঝামেলা থাকে না— চিন্তা করতে হয় না, আলোচনা করতে হয় না, শ্রমসাধ্য দৈনন্দিন রাজনৈতিক কাজগুলোও করার দরকার পড়ে না। অভিযোগ-প্রত্যভিযোগের স্বাচ্ছন্দ্যেই যদি দিন কাটিয়ে দেওয়া যায়, তা হলে আর চিন্তা-ভাবনার পরিশ্রম করা কেন! সম্ভবত, এই স্বাচ্ছন্দ্য থেকেই এ রাজ্যের রাজনীতির অধুনা প্রধান বৈশিষ্ট্যটি গড়ে উঠেছে। এটা হল, সহিংস আধিপত্য ও অবদমনের রাজনীতি, যেখানে সামান্যতম বিরোধিতাকেও সবলে টিপে মারা হয়। পঞ্চায়েত নির্বাচনেই এ বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুট— একের পর এক পঞ্চায়েত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কেড়ে নিয়েছে শাসক দল, অধুনা যার নাম তৃণমূল কংগ্রেস, অনতি-অতীতে যা বামফ্রন্ট নামে অভিহিত হত। পঞ্চায়েত নির্বাচনের গতিপ্রকৃতিগুলোতেই চোখে পড়ে, পশ্চিমবাংলায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘জয়ী’ হওয়ার মানচিত্রটা কেমন হুবহু এক হয়ে দাঁড়াল— পরিবর্তন লোকসমষ্টির নয়, কেবল বর্ণের, নির্ধারক হয়ে উঠেছে স্থানীয় ক্ষমতাবানরা, যারা যতটা না রাজনীতির লোক তার চেয়ে ঢের বেশি ঠিকাদার, ব্যবসায়ী, দালাল। অগণতন্ত্রের এমন বিস্তার যে দণ্ডভীতি প্রদর্শন ছাড়া সম্ভব নয়, সেটা জানতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়তে হয় না।

এ কথা ঠিক যে, পঞ্চায়েত নির্বাচনের সঙ্গে লোকসভা ভোটের প্রক্রিয়াগত পার্থক্য অনেক। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের সক্রিয়তা, রাজ্য শাসকদের ভাষায় অতি-সক্রিয়তা, এ ফারাকের অন্যতম দিক। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেতার তো প্রশ্নই নেই, এমনকী জোর করে স্ব-দলে টেনে আনা দলীয় আনুগত্য নিশ্চয় করাও আপাতদৃষ্টিতে কঠিন। কিন্তু, সেটা আপাতদৃষ্টিতেই— সমাজের উপরিত্বকের একটু নীচের স্তরে যা ঘটে চলেছে, সেটা যাঁরা দেখতে পাচ্ছেন, তাঁদের কাছে গণতন্ত্রের ভভিষ্যৎ এক অকূল অনিশ্চয়। ত্রাস, মতরোধ, অসহিষ্ণুতা, মত-ক্রয় এবং ক্ষমতাদখলের উগ্রতাই যেন সমাজের বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে।

এটা ঠিক যে, আমাদের ব্যক্তিগত দেখাগুলো সীমিত। কিন্তু সেগুলো তো ঠিক একক দেখা নয়, বহু লোকের ব্যক্তিগত উপলব্ধির সঙ্গে মিলে সেগুলো যে আশঙ্কা গড়ে তোলে, তাকে অমূলক বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বস্তুত, ক্ষমতাশ্রয়ী রাজনীতি বিষয়ে অ-সমালোচনার লালিত ঐতিহ্য থেকেই যে বর্তমান উগ্রতার জন্ম, এটা আজ অজানা নয়। আশঙ্কাগুলোকে গুরুত্ব দিয়েই বোধ হয় এর থেকে মুক্তির প্রয়াস করা যেতে পারে।

ক্ষমতা দখলের উগ্রতার একটা নমুনা পেশ করা যাক। বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের কয়েকটা গ্রামে দেখে এলাম নীরব সন্ত্রাসের হাড়-হিম-করা অন্তঃস্রোত। পাড়ায় ঘোষণা, ‘জানি, তোমরা আমাদের পার্টিকে খুব ভালবাসো। সে জন্যই বলছি, তোমরা ভোট দিতে না গেলেই বুঝব আমাদেরই ভোট দিলে।’ নির্বাচন কমিশন এখানে কী করবে? বিশেষত, যাদের এই হুমকিটা শোনানো হচ্ছে, তারা যে দলটাকে আসলে ভোট দিতে চায়, তাদের ‘নেতারা সব ঘরে ঢুকে গেছে।’ তারা গরিব, এবং শ্রমজীবী বিশ্বাসে তারা ‘তাদের পার্টি’কে ভোট দিতে চায়, কিন্তু তাদের হয়ে ‘দাঁড়াবার কেউ নেই’। পুলিশ অভ্যাসবশত ক্ষমতাসীন দলের কথায় ও ইশারায় চলে। অতএব, ‘আমাদের বাঁচাবে কে?’ কাকতালীয় ভাবে, এই অবস্থাটার অস্তিত্বই সমর্থিত হল পরের দিন ট্রেনের কামরায়। এক নেতা, পরে জানলাম বিধায়ক, অনর্গল সেলফোনে নির্দেশ দিয়ে চলছিলেন। তার মধেই একটা ধারালো বাক্য পরিষ্কার কানে এল: ‘আরে ছাড় না, গাঁয়ে শুধু এক বার বলে আয় অমুক দাদা আসছে। দু’চার জনকে কাপড়ে হাগা, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

সংবাদমাধ্যমেও সহিংস আধিপত্য বিস্তারের কিছু কিছু প্রকাশ দেখা যাচ্ছে, কিন্তু সেগুলো নমুনামাত্র। সমাজদেহে ভয়ের রাজনীতির যে বিষবৃক্ষ সাধারণ চোখে ধরা পড়ছে, প্রকৃতপক্ষে তার শিকড়বাকড়ের বিস্তার অনেক বেশি। পথটা সহজ। এ পথে চিন্তাগত কোনও চ্যালেঞ্জ নেই, মেধার কোনও ভূমিকা নেই, বিরুদ্ধতা মোকাবিলা করায় সংলাপের কোনও কষ্টসাধ্য অনুশীলন নেই। বিপরীতে, এ রাস্তায় নিরঙ্কুশ ক্ষমতাভোগের নিশ্চয়তা। সুতরাং লোকে যদি রাজনীতিবিমুখ হয়ে ওঠে, তাতে বৃহত্তর রাজনীতি, গণতান্ত্রিক বোধ ও অনুশীলন যতই ক্ষতিগ্রস্ত হোক না কেন, ক্ষমতার রাজনীতির তাতে কেবল লাভের সঞ্চয়।

তা হলে, এই ক্ষমতাচ্ছন্নতাই কি ভবিষ্যৎ? গণতন্ত্রের কোনও আশাই কি নেই? না, অবস্থাটা বোধ হয় এত ঘোর নিরাশারও নয়, অন্তত যত দিন সমাজে সেই সব সাধারণ মানুষেরা আছে, যাদের উদয়াস্ত খেটে খেতে হয়, ঘাম যাদের জীবনধারণের গ্যারান্টি, রাজনীতি যাদের জীবনে জলহাওয়ার মতো প্রাসঙ্গিক।

হুমকিগুলোর কাহিনি শুনতে শুনতে প্রশ্ন করি, ‘তা হলে তো আপনাদের ভোট দেওয়া হবে না?’ উত্তরে উঠে এল এক মহাকাব্যিক জীবনবিশ্বাস: ‘কেন নয়? হয়তো এ বার আটকে দেবে, হয়তো পরের বারও আটকে দেবে, কিন্তু তার পরের বার? তারও পরের বার?’

এই কণ্ঠস্বরেই ১৯৭৭-এ ইন্দিরা গাঁধীর স্বপ্নভঙ্গ, অথবা দুঃস্বপ্ন। এই প্রতিজ্ঞাতেই ২০১১-য় বামফ্রন্টের মোহচ্যুতি। ট্রেনের কামরা, চায়ের দোকান, ক্লাব বা অফিস ক্যান্টিনও টিকে থাকে এই কণ্ঠস্বরের জোরে। মহাকাব্যের প্রকৃত নায়কনায়িকা এই ঘর্মজীবী লোকসমাজ; ভোট তাঁদের বৃহত্তর লক্ষ্যের একটা, কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ, উপলক্ষ। রাজনীতি নিয়ে তর্ক করার সময় তাঁদের নেই, কিন্তু রাজনীতিবিমুখতার বিলাসিতাও তাঁরা দেখাতে পারেন না।

kumar rana
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy