বছর পাঁচেক আগে প্রথম পা রেখেছিলাম। এর মধ্যেই চার বার ঘোরা হয়ে গেল। মাসাইমারা ন্যাশনাল পার্ক। মাসাইমারা মানে, কেনিয়ার দক্ষিণ দিক জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সাভানা, মাসাইমারা মানেই মইয়ে উঠে হাত বাড়ালে দুটো তারা পেড়ে আনার মতো ঝকঝকে আকাশ। আর, মাসাইমারা মানে, লক্ষ লক্ষ উইল্ডেবিস্ট (Wildebeest)-এর ‘গ্রেট মাইগ্রেশন’। সবুজ-সন্ধানে টানজানিয়ার সেরেঙ্গেটি ন্যাশনাল পার্ক থেকে কেনিয়ার মারা নদী পেরিয়ে মাসাইমারা ন্যাশনাল পার্কের দিকে যাত্রা।
নির্ঝঞ্ঝাট যাত্রা নয় মোটেও। ওদের পিছু নেয় ক্ষুধার্ত সিংহ, চিতা, লেপার্ড, বুনো কুকুর, হায়না, সুযোগসন্ধানী শকুনের দলও। সবচেয়ে ভয়ংকর, মারা নদী। শিকারের আশায় ঘাপটি মেরে থাকে কুমির। নদী পেরনোর সময় তাই বাড়তি সতর্ক থাকে উইল্ডেবিস্ট-রা। ওরা নাকি বিপদের আঁচ পায়। নদীতে বিপদ থাকলে ওরা নদীকে ঘিরে চার পাশে ঘুরতে থাকে। তার পর জনাকয়েক নদীতে নামে। আর অন্যরা ওদের অনুসরণ করে। তাতেও অবশ্য বিপদ কাটে না। নদী পেরনোর তাড়ায় উঁচু পাথর থেকে জলে ঝাঁপ দিতে গিয়ে অনেকেই মরে যায়, আহত হয়। এমনিতে শান্ত জলহস্তীরাও বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটলে মোটেই ভাল ব্যবহার করে না।
এক বার এক সিংহীর দেখা পেয়েছিলাম। সে মারা নদী পেরিয়ে এ পারে এসেছে। কিন্তু তার ছানা ও পারেই রয়ে গেছে। হয়তো পিছিয়ে পড়েছিল। সিংহী মা-র সে খেয়াল নেই। খেয়াল যখন হল, তখন নদীতে দুটো কুমির আর চারটে জলহস্তী। ছানাগুলোর এ পারে আসার কোনও সুযোগ নেই। দেখে সিংহী মায়ের সে কী অসহায় কান্না! উল্টো দিকে বাচ্চা দুটোও চিৎকার করছে। প্রায় ঘণ্টাচারেক পর আমরা ফিরে এলাম। পর দিন ভোরে ওই জায়গায় পৌঁছে দেখি তখনও সিংহী দাঁড়িয়ে। সারা রাত ওখান থেকে সে এক ফোঁটাও নড়েনি। বেলা গড়াতে কুমির আর জলহস্তীরা অন্য দিকে সরে গেল, জল পেরিয়ে মা ছানাদের কাছে পৌঁছে গেল।
জল, জঙ্গল আর অসংখ্য জঙ্গলচারী নিয়েই মাসাইমারা। বছরভর ক্যামেরা হাতে টুরিস্টদের সামনেই জীবনচক্র, শিকার, যৌনতা। কখনও লম্বা-গলা জিরাফকে ঘিরে ধরছে এক পাল সিংহ, কখনও একটু আড়াল খুঁজে মিলনে মাতছে সিংহ-দম্পতি। গত বছরের কথা। উইলসন এয়ারপোর্ট থেকে চার্টার্ড ফ্লাইটে মাসাইমারা চলেছি। জঙ্গলের গভীরে ছোট্ট এয়ারস্ট্রিপ। পাইলট বিমান নামানোর তোড়জোড় করছেন। কিন্তু রেঞ্জাররা অনুমতি দিলেন না। কারণ এয়ারস্ট্রিপে তখন চিতা বসে আড়মোড়া ভাঙছেন। আর এক বার— গাড়িটা একটু থেমেছে, খুদে খুদে চারটে সিংহছানা গাড়ির তলায় ঢুকে পড়ল। চমৎকার খেলার জায়গা পেয়ে গেছে ওরা। একটু দূরে দেখলাম মা সিংহ বসে বসে মুচকি হাসছে। সারা সকাল ওইখানেই ঠায় দাঁড়িয়েছিলাম।
ওখানে ওয়ার্টহগ বলে এক রকম প্রাণী দেখতে পাওয়া যায়। অনেকটা শুয়োরের মতো। ওদের স্মৃতিশক্তি নাকি ভীষণ কম। দেড় মিনিটের বেশি কিচ্ছু মনে থাকে না। হয়তো মা ওয়ার্টহগ সঙ্গে দুটো ছানা নিয়ে দৌড়চ্ছে সিংহ দেখে। ঠিক দেড় মিনিট পরেই ও ভুলে যাবে ও কেন দৌড়চ্ছে। এই জন্য এরা খুব সহজেই সিংহের শিকার হয়।
আফ্রিকায় রাজা সিংহ। তবে রাজাও তো মাঝেমধ্যে বেকায়দায় পড়ে। এক বার দেখি একটা সিংহ একটা বুনো মোষকে নজর করছে। অনেক ক্ষণ ধরেই তক্কে তক্কে আছে। হঠাৎ মোষটা একটা গোটা দল নিয়ে হাজির। এ বার আস্তে আস্তে গোটা দলটা সিংহটাকে ঘিরতে লাগল। সিংহমশাই বেগতিক দেখে ল্যাজ তুলে পালালেন।
ডমিনিক, আমাদের মাসাই গাইড-এর কাছ থেকেও মাসাইমারা-র অনেক গল্প শুনেছি। এখানকার জন্তুরা নাকি কখনও কোনও টুরিস্টদের আক্রমণ করেনি। হয়তো টুরিস্ট দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। ওরা সাধারণত আক্রমণ করে গ্রামের মানুষদের, জঙ্গলে গাছ কাটতে যাওয়ার সময়। তার কারণও আছে অবশ্য। মাসাইদের কাছে আধুনিক কোনও অস্ত্র পৌঁছয়নি। গাছের গুঁড়ি কেটে কেটে তির-ধনুক, শাবলের মতো কাঠের অস্ত্র বানায় ওরা। তাই দিয়েই যতটুকু প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়।
জন্তুজানোয়ার, প্রকৃতি নিয়েই মাসাইদের জীবন। উন্নয়ন ওরা তেমন দেখেনি। দেখতে চায়ও না। হয়তো আমাদের পক্ষে সেটা ভালই। মাসাইমারা-র মতো জায়গায় সমস্ত উন্নয়ন থেমে থাকলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুযোগ থাকবে ওই অন্য রকম পৃথিবীটার সঙ্গে পরিচয় করার!
ছবি: লেখক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy