Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

এক চৈত্র-সন্ধ্যায় মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন ঈশ্বর

যুগাগ্নি-র ‘ঈশ্বর এসেছেন’ নাটকটি পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের রাজনীতি বিশেষ করে বাম রাজনীতি আর সমাজের আসন্ন কিছু সঙ্কটের কথা অনুমান করতে পেরেছিল। লিখছেন সন্দীপন মজুমদার১৯৬৭ সালে  ফ্রান্সে জাঁ লুক গোদার কিছু মাওবাদী ছাত্রছাত্রীদের এক কাল্পনিক বিপ্লবী মহড়াকে ভিত্তি করে তৈরি করেছিলেন ছবি ‘লা শিনোয়া’। কী আশ্চর্য, তার মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে ১৯৬৮ সালের মে মাসে গোটা ফ্রান্স জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল ছাত্র যুব বিদ্রোহ যা গোটা ব্যবস্থার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল। 

শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৯ ০১:১৬
Share: Save:

২৯ মার্চ, ২০০৬। বহরমপুর রবীন্দ্রসদনে তখনও শীতাতপনিয়ন্ত্রিত যন্ত্র শুষে নিতে শেখেনি প্রতিষ্ঠানবিরোধী উত্তাপ। তখন ভারতবর্ষের সংসদে স্বাধীনতার পরে সর্বাধিক ৬১ জন বামপন্থী সাংসদ নিয়ন্ত্রণ করছেন প্রথম ইউপিএ সরকারের গতিপ্রকৃতি। অচিরেই পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় ২৩৫ জন বামপন্থী বিধায়ক ও রতন টাটার ছায়া দীর্ঘতর হয়ে উঠবে। এমনই এক চৈত্র-সন্ধ্যায় মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন ঈশ্বর।

শিল্প কি বাস্তবের পূর্বানুমান করতে পারে? ১৯৬৭ সালে ফ্রান্সে জাঁ লুক গোদার কিছু মাওবাদী ছাত্রছাত্রীদের এক কাল্পনিক বিপ্লবী মহড়াকে ভিত্তি করে তৈরি করেছিলেন ছবি ‘লা শিনোয়া’। কী আশ্চর্য, তার মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে ১৯৬৮ সালের মে মাসে গোটা ফ্রান্স জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল ছাত্র যুব বিদ্রোহ যা গোটা ব্যবস্থার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল।

শিল্পের গুণমানের দিকে কোনও তুল্যমূল্য বিচারের প্রশ্নই আসে না। কিন্তু এটা স্মর্তব্য যে, সীমিত ক্ষমতার মধ্যে বহরমপুরের যুগাগ্নি প্রযোজিত ‘ঈশ্বর এসেছেন’ নাটকটি পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের রাজনীতি বিশেষ করে বাম রাজনীতি আর সমাজের আসন্ন কিছু সঙ্কটের কথা অনুমান করতে পেরেছিল। আসলে কৌশিক রায়চৌধুরীর সৃজনে এই নাটকটি শুধু উন্নয়ন, উচ্ছেদ ইত্যাদি বিতর্ককে সামনে এনেছিল তাই নয়, বেশ কিছু সমস্যাকে একটা নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চেয়েছিল যার একটা প্রেক্ষিত ছিল উত্তর আধুনিক দর্শন।

এই নাটকটির সঙ্গে নাট্যকার হিসেবে জড়িত থাকার কারণে বলতে পারি উত্তর আধুনিকতার কাছে এই নাটক সময়ের চাহিদা থেকেই ঋণী হয়ে পড়েছিল এবং সেটা সচেতন ভাবেই। আঙ্গিকেও তার প্রভাব পড়েছিল। তাই এটাই ছিল মুর্শিদাবাদের প্রথম এবং সম্ভবত শেষ নাটক যা উত্তর আধুনিকতার দর্শন দ্বারা সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল। এটা অবশ্য কোনও গিমিক ছিল না। আসলে এত বছর পরে পিছনে ফিরে তাকালেও মনে হয় রাজনীতি এবং সমাজের যে ফাঁকফোকরগুলো ক্রমে গহ্বর এবং অতলান্ত খাদের চেহারা নেবে তাদের অন্তত চিনে নেওয়ার চেষ্টা করা প্রথাগত সমাজতত্ত্বের গণ্ডির ভিতর থেকে করা সম্ভব ছিল না।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধর পরে স্যামুয়েল বেকেট লিখেছিলেন ‘ওয়েটিং ফর গোডো’ নাটক যেখানে ভ্লাদিমির আর এস্ত্রাগন, দুই চরিত্র সারা নাটক জুড়ে গোডোর প্রতীক্ষায় থাকে। কে এই গোডো আমরা জানি না কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি এসে পৌঁছন না। যুগাগ্নির নাটক কিন্তু বেকেটের এই নাটকের অ্যান্টিথিসিস। এখানে প্রথম থেকেই ঈশ্বর এসে পৌঁছয় বটে, কিন্তু তাকে বিশেষ ভাবে কেউ গুরুত্ব দেয় না। প্রথম দৃশ্যে একটি তরুণীকে দেখা যায় যে মেট্রো রেলের সামনে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করতে চলেছে শুধু এই কারণে যে, তার এক বন্ধু (য়ে একটি চ্যানেলের ক্যামেরাম্যান) গোটা দৃশ্যটি ক্যামেরাবন্দি করে সম্প্রচার করবে।

ঈশ্বর যিনি এখানে সাদামাটা চেহারার প্রৌঢ়, ব্যাপারস্যাপার দেখে বেশ হকচকিয়ে যান। বিশেষত, মধ্যবিত্ত সমাজ যারা সুখী, আত্মতৃপ্ত, স্মৃতিবর্জিত, মিডিয়াশাসিত এক সম্প্রদায়, তাদের উদাসীনতা আর প্রত্যাখ্যান দেখে। অন্য দিকে আছে প্রান্তিক মানুষেরা, যারা উন্নয়নের অবশেষ মাত্র। এরা অসহায়, বিচ্ছিন্ন, অভিশপ্ত এবং বিস্মৃত। এরা ত্রাণকর্তাকে খোঁজে কিন্তু ঈশ্বর এদের কাছে পৌঁছতে পারেন না। ত্রাণকর্তা হিসেবে এদের কাছে যা পৌঁছয় তা আসলে বাস্তবের এক ক্যারিকেচার মাত্র। যেমন সত্তরের দশকে বলিউডে অ্যাংরি ইয়ং ম্যান মার্কা নায়কের উত্থান। রৈখিক ন্যারেটিভকে বাদ দিয়ে, এপিসোডিক ঢংকে আশ্রয় করে এগিয়েছিল এই নাটক। নিটোল কোনও কাহিনী নয়, সমাজের পরস্পরবিরোধী দ্বন্দ্বগুলোকে আবিষ্কার করা যে নাটকের উদ্দিষ্ট, তার আঙ্গিক অন্য খাতে বয়ে যাওয়া তো সম্ভব ছিল না।

প্রথাগত রাজনীতির সীমাবদ্ধতাকে বুঝতে চেয়ে উত্তর আধুনিকতার দ্বারস্থ হয়েছিল এই নাটক। কিন্তু সাধারণভাবে ধ্রুপদী বামপন্থীরা উত্তর আধুনিকতাকে সন্দেহের দৃষ্টিতেই দেখে এসেছেন। কিন্তু বেশ কিছু বিষয় আছে যেটা উত্তর আধুনিকরা খুব গুরুত্ব দিয়ে ভেবেছেন। যেমন প্রতিনিধিত্বর (representation) সমস্যা। এটা তো ঠিক যে, দরিদ্র, প্রান্তিক মানুষদের প্রতিনিধিত্ব যে তাঁরা নিজেরা করেন না এবং এই নিয়ে নানা স্ববিরোধিতায় বামপন্থাকে ভুগতে হয় সেটা আমরা নিজেদের অভিজ্ঞতায় জানি।

এই সমস্যাটিকে একটু তাত্ত্বিক আকারে বলেছিলেন গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক তাঁর ‘The subaltern can not speak’ প্রবন্ধে। ঈশ্বর এসেছেন নাটকে একেবারে আক্ষরিক ভাবে। এই ভাবনাটিকে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, যেখানে একটি দৃশ্যে একটি উচ্ছিন্ন, প্রান্তিক মানুষ একটি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকে— নীরব, নিশ্চুপ। তাকে ঘিরে, এমনকি তার হয়ে একটি আরোপিত তরজায় মেতে ওঠে এক অধ্যাপক এবং এক মানবাধিকারকর্মী। বিষয় উন্নয়ন এবং উচ্ছেদ। অথচ এক সময় দু’পক্ষই এক হয়ে যায়, এক অদৃশ্য কণ্ঠস্বর তাদের নিয়ন্ত্রন করে। প্যান অপটিকনের (মিশেল ফুকো) চড়া আলোর তলায় ধাতব কণ্ঠস্বরের হুমকির সঙ্গে গলা মিলিয়ে দুই পক্ষই বলে “কিসের বিচার? কিসের অভিযোগ? কোথাও কোনও অভিযোগ নেই।’’ হ্যাঁ, উত্তর আধুনিক তাত্ত্বিক জাঁ ফ্রাসোয়াঁ লিওতারের সূত্রায়ন ‘মুক্তির মহা-আখ্যানের অবসান’ (End of grand narrative of emancipation) নাট্যকার স্মরণে রেখেছিলেন। বাস্তবতার যে লঘুকরণ উত্তর আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্য সেখানে ভিস্যুয়াল মিডিয়ার একটা বড় ভূমিকা থাকে। এই সত্যকে বার বার তুলে ধরতে পিছপা হয়নি এ নাটক যেখানে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের খবরের গুরুত্বকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় অন্তর্বাসের বিজ্ঞাপন।

নাটক শুরু হওয়ার আগে মঞ্চের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত প্রসারিত থাকত এক বিরাট ব্যানার। যেখানে লেখা ছিল ‘ঈশ্বর সর্বশক্তিমান কারণ ইহা সত্য’। নাটকের শেষ দৃশ্যে অবশ্য পরাজিত, বিধ্বস্ত ঈশ্বরের বদলে পড়ে থাকে তাঁর খড়ের কাঠামো। এছাড়া থাকে এক অবয়বহীন জনতার চিৎকৃত উল্লাস, মিডিয়ার সর্বময় উপস্থিতি আর সেই নেপথ্য কণ্ঠস্বর যা ভুলিয়ে দেয় বাস্তবতার অন্তঃসারকে।

এক শ্রদ্ধেয় বামপন্থী নাট্যকার তথা পরিচালক বলেছিলেন, ‘‘এ নাটক আমাদের বামপন্থী ঐতিহ্যকে অসম্মান করেছে।’’ আবার প্রথাগত নাটকের সংজ্ঞায় বিশ্বাসী বহরমপুরের কিছু নাট্যকর্মীকে বলতে শুনেছি, ‘‘ওটা কোনও নাটকই না।’’ তাঁরা যদি আধুনিক নাটকের আন্তর্জাতিক ধারার সঙ্গে পরিচিত থাকতেন, যদি হেইনরিখ মুলার অথবা তাকেশি কাওয়ামুরার মতো বিশ্ববিশ্রুত নাট্যকারদের নাটক তাঁদের পড়া থাকত তবে বুঝতেন নাটকের যে কোনও ধরাবাঁধা সংজ্ঞাকে বর্জন করে পৃথিবী এগিয়ে গিয়েছে। পরিবর্তমান বাস্তবতাকে বোঝার জন্যই শিল্পের আঙ্গিক পাল্টায়, শিল্পীর কসরতবাজি দেখানোর জন্য নয়। সাধারণ দর্শকেরা কিন্তু এ নাটকে নতুনত্বের আস্বাদ পেয়েছিলেন। বিশিষ্ট বামপন্থী নাট্য সমালোচক শ্রী নৃপেন্দ্র সাহা অবশ্য আশ্চর্য ঔদার্যে নাটকটিকে গ্রহণ করেছিলেন। যার ফলস্বরূপ বোধহয় এটি রাজ্য নাট্যমেলায় মনোনীত হয়।

আজ পরিত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চেয়ে বামপন্থা যখন সুখী ও আত্মতৃপ্ত মধ্যবিত্তের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়, যখন প্রান্তিক ও নিপীড়িত মানুষের কাছে পৌঁছতে গেলে বাধা হয়ে দাঁড়ায় অলঙ্ঘ প্রাচীর, তখন কি মনে পড়ে সে দিন মঞ্চে ভূমিশয্যা নেওয়ার আগে ক্লান্ত, অবসন্ন ঈশ্বরের কাতর বিলাপ, ‘কী করে বাঁধব সেতু?’ দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত, নির্বাসিত মানুষের মিছিল সেদিন শুনতে পায়নি ঈশ্বরের এই বিলাপ। কী মনে হয়? সমাজ ও রাজনীতির ক্রমশ দুরারোগ্য হয়ে ওঠা অসুখগুলোর এক আগাম অভিক্ষেপ কি নিহিত ছিল না সে দিনের মঞ্চমায়ায়?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Drama Leftist Politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE