Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

মহানন্দে ফ্লোটাসন

আসলে এই জাতটাই হাবা। রাস্তায় জল জমেছে বলে কাঁউকাঁউ চেঁচাচ্ছে। ভূগোলে প্রত্যেকটা গ্যাঁড়া মেরেছিল। আরে, কলকাতা একটা ঢালু জায়গা। একটা বেসিন। বৃষ্টি পড়লে তাতে জল জমতে বাধ্য। পৃথিবীর কোনও মেয়র, কোনও দল, কোনও সদিচ্ছাময় জিনিয়াস এসে এর অন্যথা করতে পারবে না।

শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

আসলে এই জাতটাই হাবা। রাস্তায় জল জমেছে বলে কাঁউকাঁউ চেঁচাচ্ছে। ভূগোলে প্রত্যেকটা গ্যাঁড়া মেরেছিল। আরে, কলকাতা একটা ঢালু জায়গা। একটা বেসিন। বৃষ্টি পড়লে তাতে জল জমতে বাধ্য। পৃথিবীর কোনও মেয়র, কোনও দল, কোনও সদিচ্ছাময় জিনিয়াস এসে এর অন্যথা করতে পারবে না। এটা সায়েন্স। পাহাড়ে বাস করে কেউ কি চেঁচায়, কেন ধস নামছে? মরুভূমিতে থেকে কেউ কি নেতাদের দোষারোপ করে চিল্লায়, আমার উট কেন কাঁটা চিবোতে বাধ্য, কেন ফনফনে সজনে ডাঁটা ফলছে না? চেরাপুঞ্জিতে থেকে কেউ কি আন্দোলন করতে পারে, এত বৃষ্টি ভাল লাগছে না, আকাশে সেলোটেপ মারো? তেমনই, একটা ঢালু এরিয়ায় বাস করে দাবি জানানো যায় না, বৃষ্টি পড়ুক, তুমি রাস্তার জল বের করে দাও। সব ব্যাপারে সরকারকে দোষ দিতে খুব মজা, আর নিড়বিড়ে আড়বোঝা গামবাটদের তা খুবই প্রিয় শখ, কিন্তু কথায় কথায় বিদ্রুপ করে সবজান্তা জেঠু সাজা যায় না। পড়ো, জানো, ম্যাপ দেখো। কমোডে বসো বলেই কলকাতা বুঝে গেছো, ব্যাপার এত সরল নয়।

তার চেয়ে বড়, ‘বোঝা’টা, ‘দেখা’টা বদলে ফেলো। তোমার বাড়ির সামনেটা যখন-তখন একটা নদীতে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে, এ রূপকথাটা কেন উপভোগ করছ না? হুট করে জেগে উঠে দেখলে আজ আর গৎবাঁধা দিন নয়, খবরের কাগজ দেয়নি, বাজারও করা যাবে না, ঠিকে ঝি আসবে না, অফিস যাওয়াও বন্ধ, তাতে রেগেমেগে হাত-পা ছুড়ছ কেন? বরং টুইস্ট নাচো, আচমকা ছুটি পেলে! কোথাও যেতে হল না, ভেকেশন প্ল্যান করতে হল না, খরচাপাতি কিচ্ছুটি নেই, এ দিকে বারান্দার তলা দিয়ে বয়ে গেল ছলছলিয়ে কাঁসাই, বা ইছামতী, বা ইংরিজি জানলে মিসিসিপি। শুধু ভুল করে মিসিসিপিয়েম বোলো না। ঘরের দিকে উল্লাস-চিৎকার বাগাও: লাগাও খিচুড়ি। গিন্নিও খুশি, দু’বেলার খাটনি অনেকটা মাইনাস। এ বার বারান্দায় যুগলে বসে, বিচে জিরোনোর আরাম নাও। আঙুল তুলে ঢেউ দেখাও। ওই একটা ডলফিন গেল। আসলে ডলফিন নয়, সাইকেল। তা, একটু কল্পনাশক্তি থাকবে না? ব্রেনেরও তো ব্যায়াম দরকার। সিরিয়াল দেখে দেখে তো আর কিছু অবশিষ্ট নেই!

কী? অফিস যেতেই হবে? তুমি কে হে? সারা পশ্চিমবাংলা ডুব মারতে পারলে আর কিচ্ছুটি চায় না, আমাদের নেত্রী অ্যাক্সিডেন্টে বেড়াল মরলেও শোক-হলিডে দেওয়ার কথা ভাবছেন, আর তুমি কাজ দেখাতে এয়েচ? তা ছাড়া, কোন সেই মান্ধাতার অফিস, যেখানে এখনও টেবিলে বসে, ফাইল ঠেলতে হয়? মোবাইল বা ল্যাপটপ থেকে তাবৎ কাজ সেরে, জাস্ট ঠকাস করে একটি সুইচ টিপে সেন্ড করে দেওয়া যায় না? সারা ইন্ডিয়া ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে, আর তুমি সেকেলে বেঞ্চিতে টাল খাচ্ছ?

আচ্ছা মানছি, না গেলে সিএল কাটা যাবে, পুজোর মুসৌরি বেড়ানো থেকে একটি মূল্যবান দিবস খসে পড়বে। কিংবা অফিসে স্বাস্থ্যবতী কলিগটির সঙ্গে কিঞ্চিৎ না খিলখিলালে তোমার হৃৎপিণ্ড লাভডুবকি খায় না। বেশ তো, এটাকে অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্ট ভাবো! জল ছপাৎ ছপাৎ করে যেতে তো শৈশবে বর্তে যেতে। এখন মাগনা পেয়েছ ওয়াটার-পার্ক, শিশুর হরষে ভাসতে ভাসতে ফ্লোটাসন করো, গলায় একখান ভাটিয়ালি। আজকাল শহরে ফোকের হেভি দর। কী? প্যান্ট ভিজে যাবে? এ কোথাকার নেকুয়া রে! ইদানীং সায়েবের বাচ্চা হতে গেলে বাথরুমেও এসি, আর ইম্পর্ট্যান্ট মিটিঙে হাফপ্যান্ট মাস্ট জানিসনে? শপিং মলে যা। দামড়া মাচো-রা হাফপ্যান্ট, দামড়ি ললনারা হটপ্যান্ট। ভাল ঝুলের টি-শার্ট পরলে আদৌ প্যান্ট পরেছে কি না তা অবধি হাওয়াসাপেক্ষ। এই স্মার্টনেসে দীক্ষা নে! সিগনাল থেকে আমরা টেগোরের রেনি সং চালিয়ে দেব’খন। ‘ঝ’ দিয়ে খুঁজলেই ঝরোঝরো বা ঝমোঝমো কিছু একটা শিয়োর বেরিয়ে যাবে।

বিপদ? একটা শিশু ভেসে গেছে? আরে, ব্যাপারটাকে ভিডিয়ো গেম ধর না। ওখানে ঘূর্ণি, পাড়ার ছেলেরা খোলা ম্যানহোলে বাঁশ আর গাছের ডাল গুঁজে তফাতে গেছে? তোকে পাশ কাটিয়ে চলতে হবে। বাঁশ ভেসে গেছে, ম্যানহোল ঘাপটি? জলের স্পাইরাল মুভমেন্ট লক্ষ কর। ঢেউয়ের ওয়েভলেংথ মাপ! আরে বাবা, পৃথিবীর তিন ভাগ জল। তাকে না চিনলে চলবে? ়িডভাইডারে উঠে জাহাজের কাপ্তেনের মতো চোখ চালা, রেলিং বেয়ে ফুটপাথে লাফিয়ে পড়। ওইখানে মনে হচ্ছে আচমকা হেভি ডিপ, পড়ে কোমর ভাঙবে? উলটো দিক থেকে একটা গাড়ল আসা অবধি অপেক্ষা কর। তার হাইট মেপে তবে এগোবি। বাথরুম উবজে ‘এম্যাগো’ ভাসতে ভাসতে আসছে, ডজ করবি কী করে বুঝতে পারছিস না? দাশগুপ্তদের বারান্দায় উঠে পড়। জানলা দিয়ে জিজ্ঞেস কর, বুলু আছে? নেই শুনে, সরি বলে নেমে যা। তত ক্ষণে ঘেন্নাবস্তুরা লাহাদের দরজায়। ঝপাং করে পড়েই গেলি? ভাল তো, শুধু শুধু লেকের ধারে ওই বড়লোকি ক্লাবগুলোয় নাম লেখাতে হল না, ফ্রি ট্রেনিং!

বাবু, জলকে ভালবাসতে শেখ। এই তো এক বার সুইমিং পুল উদ্বোধন করতে গেছি, কে যেন রসিকতা করে আমায় টোকা দিয়ে জলে ফেলে দিল। হাবুডুবু খেলাম, কিন্তু মুখে হাসিটি ইনট্যাক্ট। যখন হঠাৎ দিদির নেকনজর থেকে নেক-ডিপ জলে চুবে গেলাম, কোনও দাপাদাপি দেখেছিস? উঁহু, তাইলে তলিয়ে যাবি। কিছু ক্ষণ চিৎসাঁতার দিয়ে স্টিল থাক, ঠিক তরী ভিড়বে। তখন টাইম বুঝে ফের দাপিয়ে চান। জলিয়ে জলিয়ে আমার নামের আগে জল বসে গেছে বাবা, জমা জল আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। গোটা বর্ষা কী স্টুপেন্ডাস বিনিয়োগ টানব জানিস? শয়ে শয়ে নৌকো নামাব, তাদের গায়ে সার সার স্পনসরদের ছাপ্পা। কবে নৌকো আসবে? দাঁড়া, ভাল জাতের কাঠে রং ধরতে একটু সময় লাগে। এই মেঘলা ওয়েদারে শুকোনোও ঝামেলা। আঃ, সব ক’টায় নীল-সাদা রং হচ্ছে না!

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE