Advertisement
E-Paper

বাঙালি এমন শূন্যকুম্ভ ছিল না

আশির দশকের শেষের দিক। কবি শঙ্খ ঘোষের শরীর ভাল নেই। গলা দিয়ে স্বরই বেরোচ্ছে না প্রায়। শঙ্খবাবুর কাছে আসতে চান বসন্ত চৌধুরী। স্টুডিয়োতে যাওয়ার পথে এক বার তাঁকে পড়ে শোনাতে চান কিছু গদ্য।

বিশ্বজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০১৭ ০০:০০

আশির দশকের শেষের দিক। কবি শঙ্খ ঘোষের শরীর ভাল নেই। গলা দিয়ে স্বরই বেরোচ্ছে না প্রায়। শঙ্খবাবুর কাছে আসতে চান বসন্ত চৌধুরী। স্টুডিয়োতে যাওয়ার পথে এক বার তাঁকে পড়ে শোনাতে চান কিছু গদ্য। ‘জীবনশিল্পী রবীন্দ্রনাথ’ নামে ছ’খানা রেকর্ড তৈরি হয়ে উঠছে। তাতে রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতা-নাটক-উপন্যাস থেকে সংকলিত হয়েছে ছয় দশকের ‘ক্রমান্বয়িক জীবনভাবনা’। তারই জন্য লেখা গদ্য-ধরতাইগুলি। সেগুলিই বসন্ত চৌধুরীর পড়ার কথা। কথাগুলি গেঁথেছেন শঙ্খবাবু। তাই ‘রুপোলি পর্দার রূপবান নায়ক’ এসে হাজির কবির ‘এলোমেলো রোগশয্যার পাশে’। সবজান্তা অহংকারী হলে না-ই আসতে পারতেন। না এলে কিছু বলার ছিল না। শুধু তো পড়ার কথা। সেটুকু কি আর করা যায় না? যায় হয়তো। তবু এসেছেন কবিকে পাঠ শোনাতে। কবি যে ভাবনা থেকে লিখেছেন গদ্য, পড়াটা তেমন হচ্ছে তো, না কি সংশোধন দরকার? এই তাঁর জিজ্ঞাসা। নিশ্চিত হতে চান বসন্ত চৌধুরী। চটজলদি পড়ে চলে আসা তাঁর উদ্দেশ্য নয়। শঙ্খবাবুকে ‘পালটে দিতেও হলো দু-একটা স্বরভঙ্গি।’ বসন্ত চৌধুরীরও মেনে নিতে অসুবিধে হল না।

কৃষ্ণচন্দ্র দে-র জন্মদিন। মান্না দে গান গাইবেন। অনেক দিন পরে সে-বার কলকাতায় গান গাইছেন মান্না দে। রবীন্দ্রসদন কানায় কানায় ভরা। মান্না দে-র অনুরোধেই অনুষ্ঠানের গোড়ায় কয়েকটা রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার কথা গীতা ঘটকের। দর্শকেরা অবশ্য গীতা ঘটকের গান শুনতে আগ্রহী নন, কোথায় ‘গুরু’ মান্না দে আর কোথায় গীতা ঘটক! ফলে গীতা ঘটকের চার নম্বর গানের সময় প্রত্যাখ্যান ধ্বনিত হল জনতাকণ্ঠে। ক্রমশ ‘মান্না দে, মান্না দে’ হল্লায় ভরে গেল হল। মান্না দে মঞ্চে এলেন। হারমোনিয়াম দূরে ঠেলে কঠিন মুখে তাকালেন শ্রোতাদের দিকে। বললেন, ‘এখানে গানের কোনও শ্রোতা নেই। সৌজন্যবোধও নেই।... উইংসের ধারে বসে শুনছিলাম, কী সুর, গলার কী কাজ, কী মনপ্রাণ ভরিয়ে গাইছিলেন উনি। সে-গান শুনবার পরও যারা এ-রকম অসভ্যতা করতে পারে তারা কি গানের শ্রোতা?’

কবি-অধ্যাপক অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কাছে ১৯৩০ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত বাংলা কবিতার চিত্রকল্প নিয়ে কাজ করছেন এক জন। তাঁর গবেষণা পত্রের পরীক্ষক হওয়ার কথা অধ্যাপক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তিনি দ্বিধাগ্রস্ত। জানালেন অলোকরঞ্জনকে, পঞ্চাশ-ষাটের কবিতা ‘এখানে-ওখানে দেখেছি ঠিকই কিন্তু বই ধরে তো পড়িনি কখনো। সেভাবে তো আমার অধিকার তৈরি হয়নি। তা হলে আমি কীভাবে পরীক্ষক হতে পারি ?’

নানা ক্ষেত্রে বিশিষ্ট বাঙালি ভদ্রলোকদের এমন সব কাজ-কথা-অনুভূতি-প্রতিক্রিয়ার প্রসঙ্গ রয়েছে শঙ্খ ঘোষের সদ্য প্রকাশিত বই নিরহং শিল্পী (তালপাতা)-তে। পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল শঙ্খবাবু যে সময়ের কথা লিখছেন তা মোটের ওপর ষাটের দশক থেকে শুরু করে নব্বইয়ের দশকের গোড়া। তখন স্বাধীনতার পরে নানা রাজনৈতিক পালাবদলের মধ্য দিয়ে গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। অভিনেতা-গায়ক-অধ্যাপক, যাঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশিষ্ট, তাঁরা কিন্তু জীবনযাপনে সুসংস্কৃতিকে অস্বীকার করছেন না। মান্না দে ব্যবহার করেছিলেন ‘সৌজন্যবোধ’ শব্দটি। বোধ তো শুধু সৌজন্যেরই নয়, আরও অনেক কিছুর। সে বোধ বাঙালিদের মধ্যে ছিল। তাঁরা নিজেদের পারা ও না-পারা সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। কেউ একটি বিষয় পারেন বলেই যে অন্য বিষয়েও তিনিই শেষ কথা বলার অধিকারী, এমন ভাবতেন না তাঁরা। বসন্ত চৌধুরী বা শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনি সেটাই জানায়।

বাঙালির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে ইদানীং এ বিষয়গুলি চোখে পড়ে না। কেন? অধিকারী-অনধিকারী ভেদ স্বীকার করা ও শিখতে চাওয়া এই মানসিকতা বাঙালি সমাজ থেকে ক্রমে ক্রমে হারিয়ে গেছে। এর একটা কারণ বোধ হয় বাঙালি ভুল সাম্যবাদে নিজেকে দীক্ষিত করেছিল। সাম্যবাদের এক আশ্চর্য সহজিয়া সিদ্ধান্ত অলস বাঙালি ক্রমে করতলগত করে নেয়। সবাই সমান। সুতরাং যিনি যেটা পারেন সেটাকে আর আলাদা করে স্বীকার করার দরকার নেই। টেনে সবাইকে সমান করে দাও। ইস্কুলের বিশেষ স্তর পর্যন্ত পাশ-ফেল প্রথাই উঠে গেল এবং বাঙালি সমাজে যোগ্য-অযোগ্য অধিকারী-অনধিকারী মানদণ্ডটুকু আর রইল না। ফলে কেউ আর শুনতে চান না, সবাই জানুন না জানুন বলতে চান।

দ্বিতীয়ত, ভদ্রলোক বলতে যে কেবল অর্থনৈতিক শ্রেণিবিশেষকে বোঝায় না, ভদ্রলোক বলতে যে আত্মগত ও অর্জিত গুণের অধিকারীকেও বোঝায় তা আমরা ভুলে গেলাম। ‘ভদ্দরলোক’ বলে গালাগাল দিলাম কিন্তু সৌজন্যবোধ, ভদ্রতা, অপরের কথা শোনার মন তৈরি করলাম না। ভদ্রলোক এই অর্থনৈতিক শ্রেণির সমালোচনা করতে গিয়ে ভদ্রতাও বিসর্জন দিলাম। তর্ক আর গালাগাল যে সমগোত্রীয় নয়, তর্ক যে তর্কশীলতা তা মনে রইল না।

যত দিন যাচ্ছে, বাঙালির ভেতরটা খালি হচ্ছে আর অধিকারী-অনধিকারী নির্বিশেষে সবাই আশ্চর্য এক সাম্যে উপনীত হয়ে শুধুই বলছেন, শুধুই বলছেন। এবং, চেঁচিয়ে বলছেন। প্রত্যেকেই ঘোষণা করছেন, ‘আমাকে দেখুন’। শূন্য কলস তো এমনই সশব্দ হয়।

বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy