Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

যুবনাশ্ব ছদ্মনামে লিখলেন পটলডাঙার বৃত্তান্ত

ঘটকবাড়ি হয়ে উঠেছিল বহরমপুর শহরের সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্মের অক্ষবিন্দু। মণীশ ঘটক আমৃত্যু সম্পাদনা করে গিয়েছেন ‘বর্তিকা’ নামে ভিন্ন ধরনের পত্রিকা। মণীশ ঘটক মানেই কল্লোল যুগের প্রথম সারির মুখ। ‘বলতে গেলে মণীশই কল্লোলের প্রথম মশালচী’  (‘কল্লোল যুগ’)। সাহিত্যের নিত্যক্ষেত্রে সে দিন তিনি এমন সব অভাজনকে ডেকে এনেছিলেন যা ছিল একেবারে অভূতপূর্ব।   

সুদীপ জোয়ারদার
শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৯ ০১:২৭
Share: Save:

থেমে থাকলে দাঁড়ি, হাঁটলে চিমটে।’ ইডেন হিন্দু হস্টেলে এ রকমই ছিল তাঁর পরিচয়। কারণ? ‘আমি শুধু রোগা নই; বেমানান ঢ্যাঙা। …তিরতিরে সোজা।’ ‘মান্ধাতার বাবার আমল’-এ কারণটাও বর্ণনা করে গিয়েছেন যুবনাশ্ব ওরফে মণীশ ঘটক। তবে ‘ছ ফুটের বেশি লম্বা, প্রস্থে কিছুটা দুঃস্থ হলেও’ তাঁর চেহারায় ছিল ‘বলশালিতার দীপ্তি’। আর শুধু কি চেহারা? ‘কল্লোলে আত্মপ্রকাশ করে সে যুবনাশ্বের ছদ্মনাম নিয়ে। সে দিন যুবনাশ্বের অর্থ যদি কেউ করত ‘জোয়ান ঘোড়া’, তা হলে খুব ভুল করত না, তার লেখায় ছিল সেই উদ্দীপ্ত সরলতা।’ লিখেছেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত তাঁর ‘কল্লোল যুগ’ গ্রন্থে।

মণীশ ঘটক মানেই কল্লোল যুগের প্রথম সারির মুখ। ‘বলতে গেলে মণীশই কল্লোলের প্রথম মশালচী’ (‘কল্লোল যুগ’)। সাহিত্যের নিত্যক্ষেত্রে সে দিন তিনি এমন সব অভাজনকে ডেকে এনেছিলেন যা ছিল একেবারে অভূতপূর্ব।

এ নিয়ে বিস্তারিত যুবনাশ্ব নিজেই লিখে গিয়েছেন তাঁর ‘মান্ধাতার বাবার আমল’ বইয়ে। পাবনায় জন্মগ্রহণ করে বাবার ও নিজের চাকরিসূত্রে বাংলাদেশ ও এ দেশের নানা শহর, মফস্‌সল ঘুরে অবশেষে বহরমপুরের পাকাপাকি বাসিন্দা হওয়া কবি ও কথাকার মণীশ ঘটকের লেখালেখির সূচনা হয় সমাজের তথাকথিত অবহেলিত ও অপরাধীদের নিয়েই। কলেজের ছাত্র তিনি তখন। এ সময় ‘কল্লোলে’র সংস্পর্শে এলেন হঠাৎ করেই।

‘কল্লোলে’র সংস্পর্শে আসার আগে অবধি তিনি ছিলেন মূলত সর্বভূক পাঠক এবং টেনিস খেলোয়াড়। হাতে হকিস্টিক নিয়ে কবিবন্ধু বিজয়ের সঙ্গে এক দিন হাজির হয়েছিলেন কল্লোলের অফিসে। সম্পাদক গোকুল নাগ এবং দীনেশরঞ্জনের অমায়িক, খোলামেলা ব্যবহার সে দিন তাঁর মন ছুঁয়ে গিয়েছিল। আসার সময় গোকুল নাগ তাঁর কানের কাছে ফিসফিস করে বলেছিলেন, ‘কিছু লিখেছ-টিকেছ?

গল্প কবিতা...’

ঘাড় নেড়ে মণীশ ঘটক জানিয়েছিলেন, ‘না।’ গোকুল নাগ বলেছিলেন, ‘লেখ, মনে যা দাগ কাটে, কথায় তাকে ফোটাও। লেখা যেন কথা কয়।’ লিখতে হবে, ‘মনে যা দাগ কাটে।’ লেখালেখির শর্তও তো তাই। তবুও গোকুল নাগের কথার একটা অনুরণন মনের মধ্যে মাঝে মাঝেই টের পেতে লাগলেন তিনি। এ সময় ঘটনাচক্রে পকেটমার ফজলের সঙ্গে গড়ে উঠল একটা সখ্যতার সম্পর্ক। তার হাত ধরে তিনি পৌঁছে গেলেন চোর-ছ্যাঁচর-পকেটমারদের দুনিয়ায়, যা এ যাবৎকাল অব্দি তাঁর ও বাংলাসাহিত্যের পাঠকদেরও অচেনা।

কিন্তু এদের নিয়ে লিখলেই তো হল না, অন্যায়-অবিচার-অসাধুতাকে সাহিত্যের উপজীব্য করা যায় কি না তা নিয়ে ছিল রীতিমতো সংশয়। সংশয়টা এক দিন জানালেন সাহিত্যিক বন্ধু বিজয়কেই। বিজয় বললেন, ‘মান্ধাতার আমল থেকে যা চলে আসছে শেষপর্যন্ত তাই চায় পাঠকেরা।’ মান্ধাতার আমল! কথাটা মাথায় পাক খেল। তা হলে তো লিখতেই হবে। ভাবলেন, ‘মান্ধাতার আমল দেখায় সবাই, মান্ধাতার বাবার আমলের নামে ভড়কাবে। সেই নাম, মানে যুবনাশ্ব। ছদ্মনাম নিয়ে লিখব।’

যুবনাশ্ব ছদ্মনামে লেখা হল পটলডাঙার বৃত্তান্ত। নড়েচড়ে বসল বাংলাসাহিত্যের পাঠক। সজনীকান্ত রবীন্দ্রনাথের দ্বারস্থ হলেন সাহিত্যের অশ্লীলতা নিয়ে। বাংলা সাহিত্য কিন্তু পেয়ে গেল এক বলিষ্ঠ কথাকারকে যাঁর লেখায় প্রথম কথা বলে উঠল ফজলের মতো সমাজের চোখে অপরাধী এবং অপাঙ্‌ক্তেয় মানুষজন।

মণীশ ঘটক জন্মেছিলেন পূর্ববঙ্গের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। পিতা সুরেশচন্দ্র ছিলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। সুরেশচন্দ্রের পরিবারে ছিল শিক্ষা ও সংস্কৃতির অনুকূল পরিমণ্ডল। তাই সুরেশচন্দ্র ও ইন্দুবালার ন’সন্তানের প্রায় সকলেই স্বকীয়তার ছাপ রেখেছিলেন সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে। এঁদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ মণীশ আর সর্বকনিষ্ঠ ঋত্বিকের বিদ্যুৎদীপ্তি ছড়িয়ে পড়েছিল সাহিত্য ও চলচ্চিত্রকে কেন্দ্র করে। মণীশ ঘটক কিন্তু শুধু পটলডাঙার পাঁচালিকার ছিলেন না। সে আমলে তিনি ছিলেন ক্ষমতাবান এক কবিও। তাঁর ‘শিলালিপি’ কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতা সে সময় সাহিত্যের উৎসাহী পাঠকদের কণ্ঠস্থ ছিল। বহরমপুরে বসবাস কালে তাঁদের লালদিঘির পাড়ের ঘটকবাড়ি হয়ে উঠেছিল এই মফস্‌সল শহরের সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্মের অক্ষবিন্দু। এই বহরমপুর থেকেই মণীশ ঘটক আমৃত্যু সম্পাদনা করে গিয়েছেন ‘বর্তিকা’ নামের ভিন্ন ধরনের এক পত্রিকা।

কর্মজীবনে প্রবেশের হাতছানি এসেছিল স্নাতক হওয়ার পরে পরেই। প্রবেশনার অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে ব্যাঙ্কের চাকরির ইন্টারভিউ উতরেছিলেন অনেক কষ্টে। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। আটকে গিয়েছিলেন মেডিক্যাল পরীক্ষায়। উচ্চতার অনুপাতে ওজন কম। ওজন বাড়াবার জন্য ব্যাঙ্ক দু’মাস সময় দিয়েছিল। চটজলদি সমাধানে এক সাহেবের পরামর্শে দার্জিলিং গিয়ে ভালমন্দ খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবনে প্রথম প্রবেশ করেছিলেন সুরায়। ওজন বাড়েনি, ফলত হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল চাকরি। অন্য খারাপ যা হয়েছিল সেটা পাকাপাকি পানাভ্যাসের কবলে পড়া। মোটা মাইনের চাকরি সে বার হাতছাড়া হলেও পরে আয়কর বিভাগে চাকরি পেয়ে আয়কর উপদেষ্টা হিসাবে সুনাম ও অর্থ দুই-ই পেয়েছিলেন।

সমসাময়িক সাহিত্যিক মহলে মণীশ ঘটক ছিলেন এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। তবে সবাই যে তাঁর উপর প্রসন্ন ছিলেন তা নয়। সজনীকান্ত ‘কল্লোল’ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে লিখেছেন, ‘আসল কর্ণধার গোকুলচন্দ্র নাগ… ‘তরুণ’ কবি ও শিল্পী হইলেও ভদ্ররুচি সম্পন্ন সংযত মানুষ ছিলেন, কোনওদিক দিয়া শালীনতা ক্ষুণ্ণ হইতে দিতেন না। মূর্তিমান বিদ্রোহের মতো মাঝে মাঝে পটলডাঙার পাঁচালিকার যুবনাশ্বের (মণীশ ঘটক) আবির্ভাব ঘটিলেও ‘কল্লোলে’র মোটামুটি আবহাওয়া ছিল শান্ত ও সুন্দর।’ মণীশ ঘটক সম্পর্কে এই অপ্রসন্নতা পরে সজনীকান্তের কেটে যায়। লেখেন, ‘মণীশ শক্ত জোরালো মানুষ, ঢাকঢাক গুড়গুড়ের দলে নয়।’

ষাটের দশকে কৃষ্ণনাগরিক লেখক সুধীর চক্রবর্তী মণীশ ঘটকের সংস্পর্শে আসেন। তাঁর মূল্যায়নেও যেন সজনীকান্তের প্রীতিপ্রসন্ন মন্তব্যেরই অনুরণন, ‘এত স্পষ্টভাষী, ঋজু শরীরের নির্মেদ মানুষ আর স্বভাবকোমল ব্যক্তিত্ব আর তো দেখলাম না।’

আয়কর বিভাগের বড়কর্তার কাজে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে সপ্তাহে তখন তিন দিন মণীশবাবু আয়কর দফতরে নানা কাজে আইনি পরামর্শ দিতে যেতেন কৃষ্ণনগরে। থাকতেন ‘বাসশ্রী’ হোটেলে। এ সময় কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজে অধ্যাপনার কাজে সদ্য যোগ দেওয়া সুধীরবাবু মাঝেমাঝেই যুবনাশ্বের সঙ্গে জুটে যেতেন। চলত সাহিত্যালাপ। বহরমপুরে তাঁর পরিবার অসংখ্য কৃতির সৌরভে তখন সম্পন্ন। বলতে ভালবাসতেন তাঁদের কথাও। কখনও ভাই ভবা (ঋত্বিক ঘটক), কখনও কন্যা মহাশ্বেতা, কখনও বা পুত্রবধূ গীতা ঘটক। আর থাকত আকুতি। সময় ও একাগ্রতার অভাবে ভাল কিছু লিখতে না পারার আকুতি।

এই আকুতি থেকে গিয়েছিল মৃত্যুকাল অব্দি। ১৯৭৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে সুধীরবাবু তাঁকে দেখতে এসেছিলেন বহরমপুরে। দীর্ঘদেহী ঋজু স্বভাবের মানুষটি ব্যাধিকবলিত হয়ে তখন তাঁর কবিতা ভাষাতেই ‘মহীরূহ হয়েছে অঙ্গার’। তবু ‘বর্তিকা’র শেষ শারদ সংখ্যার সম্পাদকীয় পড়ে শুনিয়েছিলেন অনুজ লেখককে। সে সম্পাদকীয়তে হয়তো সেই লিখতে না পারার আকুতি থেকেই জানিয়েছিলেন, ‘আমার শেষ প্রার্থনা এই যে যাঁর লিখবার কিছু ক্ষমতা আছে তিনি অন্তত দিনে তিন ঘণ্টা আপনমনে লিখে যাবেন, রাতারাতি বড়োলোক হবার আশা ত্যাগ করে’।

শিক্ষক, ভগবানগোলা হাইস্কুল

তথ্যঋণ: ‘পিতৃপ্রতিম তাপ’/ সুধীর চক্রবর্তী, ‘কল্লোল যুগ’/ অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, ‘আত্মস্মৃতি’/ সজনীকান্ত দাশ, ‘মান্ধাতার বাবার আমল’/যুবনাশ্ব

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Poet Manish Ghatak
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE