Advertisement
E-Paper

পাণ্ডবদের পিতৃতর্পণের স্মৃতি, সুবর্ণরেখা তীরে বালিযাত্রা

চৈত্র সংক্রান্তির দিনে সুবর্ণরেখার তীরে হয় বালিযাত্রা। ঝাড়খণ্ড-পশ্চিমবঙ্গ এবং ওড়িশার সীমানায় বিশাল এলাকা জুড়ে বসে মেলা। বালিযাত্রার স্বরূপ খুঁজলেন মধুপ দেবালিযাত্রা মেলা শুধু সুবর্ণরেখা নদীর তীরেই অনুষ্ঠিত হয়। সুবর্ণরেখা নদী পশ্চিমে যেখানে ঝাড়খণ্ড থেকে বাংলায় ঢুকেছে সেখানে করবনিয়া গ্রামের কাছে মূল বালিযাত্রা মেলাটি বসে।

শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০১
রীতি: দাঁতনের বেলমূলা গ্রামে সুবর্ণরেখার তীরে বালিমেলা। নিজস্ব চিত্র

রীতি: দাঁতনের বেলমূলা গ্রামে সুবর্ণরেখার তীরে বালিমেলা। নিজস্ব চিত্র

খুব সাধারণ উপকরণ। ছাতু। সেটাই উৎসর্গ করা হয় পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে। দলে দলে লোক এসে উপস্থিত হন সুবর্ণরেখার তীরে। পিতৃপুরুষকে স্মরণের এই রীতি উপলক্ষে নদীর তীরে বসে মেলাও। রীতি পালন এবং মেলা মিলে গোটা বিষয়টি ছাতু সংক্রান্তি মেলা নামে পরিচিত। কিন্তু এই রীতি বালিযাত্রা নামে পরিচিত।

বালিযাত্রা মেলা শুধু সুবর্ণরেখা নদীর তীরেই অনুষ্ঠিত হয়। সুবর্ণরেখা নদী পশ্চিমে যেখানে ঝাড়খণ্ড থেকে বাংলায় ঢুকেছে সেখানে করবনিয়া গ্রামের কাছে মূল বালিযাত্রা মেলাটি বসে। কিন্তু, সুবর্ণরেখা নদী পূর্বে যেখানে বাংলা থেকে ওড়িশায় ঢুকেছে সেই সব স্থান থেকে ৬০-৬২ কিলোমিটার দূরে করবনিয়ার মূল বালিযাত্রার স্থানে সকলে আসতে পারেন না বলে নদীর তীরে নানা স্থানে ছোট ছোট বালিযাত্রা মেলা হয়। দাঁতনের গরতপুর, সোনাকানিয়া এবং বেলমূলাতে, কেশিয়াড়ির ভসরাঘাটে এবং ওড়িশার জলেশ্বরের রাজঘাট ও মাকড়িয়ায় সুবর্ণরেখা নদীর তীরে চৈত্র সংক্রান্তির দিনেই বালিযাত্রা মেলা বসে।

বালিযাত্রার অন্য এক তাৎপর্য রয়েছে। এর সঙ্গে মহাভারতের যোগ রয়েছে বলে লোকবিশ্বাস। সেই কাহিনিটি জানা যেতে পারে। অজ্ঞাতবাসের শেষে চৈত্র সংক্রান্তির দিনে যুধিষ্ঠির বাৎসরিক পিতৃশ্রাদ্ধের ইচ্ছে প্রকাশ করেন। কিন্তু, তার জন্য প্রয়োজন উত্তরবাহিনী গঙ্গা। তিনি তখন সুবর্ণরেখার অববাহিকা অঞ্চলে বাস করেন। সাহায্যে এগিয়ে এলেন অর্জুন। তিনি তির ছুড়লেন মাটিতে। মাটির নীচ থেকে মন্দাকিনীর ধারা এসে মিলিত হল সুবর্ণরেখায়। সুবর্ণরেখা হয়ে গেল উত্তরবাহিনী গঙ্গা। যুধিষ্ঠির নদীর তীরে বালির চরে বসে ছাতু দিয়ে পিতৃশ্রাদ্ধ করলেন। পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম সীমানায় করবনিয়া গ্রামের কাছে আজও সুবর্ণরেখা নদী উত্তর বাহিনী। স্থানীয় বিশ্বাস, আজও এই অঞ্চলে সুবর্ণরেখা নদীর উভয় তীরে পাণ্ডবদের পিতৃশ্রাদ্ধের স্মরণে চৈত্র সংক্রান্তির দিনে অনুষ্ঠিত হয় বালিযাত্রা মেলা।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

বালিযাত্রাকে স্থানীয় ভাষায় বলে ‘বালিযাত’। সুবর্ণরৈখিক বাংলায় ‘যাত’ মানে মেলা। বালির উপরে অনুষ্ঠিত মেলা বা যাত হল ‘বালিযাত’। এই ‘বালিযাত’ই শিষ্ট প্রয়োগে ‘বালিযাত্রা’। কিন্তু, যাত্রা কথার মানে যাওয়া বা গমন করা। মনে করা যেতে পারে, চৈত্র সংক্রান্তির দিন যুধিষ্ঠির সুবর্ণরেখা নদীর তীরে বালির উপরে যাত্রা বা গমন করেছিলেন বলে ‘বালিযাত্রা’। বিষয়টি নিয়ে আসনবনি গ্রামের লোককবি সুরেশচন্দ্র সাউ পয়ার ছন্দে লিখলেন পাঁচালি গান, ‘সুবর্ণরেখার পরে বালিযাত্রা মেলা।/ বহু পুরাতন ইহা পাণ্ডবের লীলা’।

কিন্তু পাণ্ডবেরা কেন এই অঞ্চলে এলেন? মনে করা হয়, পাণ্ডবেরা বারো বছর বনবাস কাটিয়ে অজ্ঞাতবাসের জন্য এলেন ‘সোনারেখা’ বা সুবর্ণরেখা নদীর তীরে। সেটি ছোটনাগপুর মালভূমি এলাকার গভীর অরণ্যে। সুরেশচন্দ্রের কাব্যে মেলে, ‘মহাভারতের বনপর্বের মধ্যেতে।/সুবর্ণরেখার নাম পাবেন দেখিতে।।/সোনারেখা নাম হয় ভারত ভিতর।/পাণ্ডবেরা কি করিল শুন অতঃপর’। নদীর তীরে যেখানে তাঁরা কুটির বাঁধেন, সেই স্থানের নাম হয়েছে ‘পাণ্ডরা’ (পাণ্ডবরা)। এই পাণ্ডরা গ্রামে পাণ্ডবরা যে শিবলিঙ্গটিকে পূজা করতেন তার নাম পাণ্ডবেশ্বর শিব। এই অঞ্চলে বনের মধ্যে দ্রৌপদী রান্না করে গাছের নীচে একটি বেদিতে ভাতের হাঁড়ি রাখতেন। সেই স্থানের নাম ভাতহাঁড়িয়া বা ভাতহাণ্ডিয়া। এখানে ছিল অসুরদের বাস। হিড়িম্ব ছিল অসুরদের রাজা। প্রায় ষাট হাত লম্বা হিড়িম্ব রাক্ষসের ভয়ে সকলেই তটস্থ। অসুরের দল প্রায়ই এসে পাণ্ডবদের নানা ভাবে উপদ্রব করত। কিন্তু, উপদ্রব করতে আসা অসুরদের ভীমের হাতে মৃত্যু ঘটে। ভীম হাজার হাজার অসুরকে মেরে এক জায়গায় পাহাড় করে দিলেন। সেই ঘটনার স্মরণে একটি জায়গার নাম হয় অসুরহুড়ি।

অসুরকুলকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে ছুটে আসে হিড়িম্ব। হাতিবাড়িতে সুবর্ণরেখার তীরে যেখানে ভীম পাথর ছুড়ে খেলতেন, সেখানে শুরু হয় প্রবল যুদ্ধ। বিশাল বিশাল পাথর নিয়ে উভয়ের প্রবল যুদ্ধ শুরু। অবশেষে ভীম হিড়িম্ব রাক্ষসকে দু’হাতে তুলে প্রবল বেগে ঘোরাতে ঘোরাতে ছুড়ে দেন। হিড়িম্ব সুবর্ণরেখা নদীর যেখানে আছড়ে পড়ে সেখানে নদীর ভেতরে তৈরি হয়েছে ষাট হাত গভীর দহ। বর্তমানে যার নাম ‘ষাটিদহ’। এদিকে হিড়িম্বের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে তার বোন হিড়িম্বা ভীমকে হত্যার জন্য ছুটে আসে। কিন্তু, নদীর তীরে বাহুবলী

ভীমকে দেখেই তার মনে প্রেমের সঞ্চার হয়। হিড়িম্বা ভীমকে বিবাহের ইচ্ছা জানায়। যুধিষ্ঠিরের পরামর্শে ভীম হিড়িম্বাকে বিয়ে করলে অসুরদের সঙ্গে পাণ্ডবদের বন্ধুত্ব স্থাপিত হয়।

সুবর্ণরেখার তীরে ঝাড়খণ্ড-ময়ূরভঞ্জ-বঙ্গদেশের সঙ্গমস্থলে হিড়িম্বাদের বাসভূমি ছিল বলেই লোকবিশ্বাস। অজ্ঞাতবাসের শেষে যুধিষ্ঠির বালিযাত্রা করেন। সুরেশচন্দ্রের কথায়, ‘অজ্ঞাতবাসের কালে দ্বাপরের শেষে।/যুধিষ্ঠির বালিযাত্রা করেন হরষে।।” এপারে বাংলা ওপারে ঝাড়খণ্ড (পূর্বতন বিহার), মাঝখানে বয়ে যাচ্ছে সুবর্ণরেখা নদী। প্রবাহিণীর এপারে করবনিয়া আর মড়কো গ্রাম। নদীর ওপারে ঝাড়খণ্ডের কাশীপাল, পাঁচাণ্ডো, রাঙুনিয়া গ্রাম। পাণ্ডবদের বালিযাত্রার স্মৃতিতে আজও জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বহু মানুষ চৈত্র সংক্রান্তির দিনে এখানে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে ছাতুর পিণ্ড উৎসর্গ করতে আসেন। নদীর দু’পাশ জুড়েই বসে মেলা। নদীর তীরে চলে হাঁড়িয়া সেবন। জলের ধারে উন্মুক্ত প্রকৃতির কোলে জনজাতি গোষ্ঠীর রমণীরা খোঁপায় বুনো ফুল-পাতা গুঁজে নাচেন। মাদল ধামসা কাঁসর ঘণ্টার সঙ্গে জমে ওঠে নাচ। অসংখ্য দোকানপাতি বসে। কিন্তু প্রধান আকর্ষণ হল ঝাড়খণ্ডের দিকে বসা পাথরের থালা-বাটি, শিল-নোড়া, লোহার হাতা, খুন্তি, দা, কোদাল, কাটারি, কুড়ুল, কোদাল প্রভৃতি তৈজসপত্রের পসরা।

সুবর্ণরেখার তীরে সব জায়গাতেই মেলা এবং পিণ্ডদানের কাজ সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত হয়। বিকেলের পরে মেলা থাকে না। হিন্দুরা পিণ্ডশ্রাদ্ধ প্রদানের জন্য গয়াধামে যান, আদিবাসীবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষেরা এই কাজের জন্য যান দামোদর বা সুবর্ণরেখা নদীর তীরে ঠাকুরবাড়িতে। বালিযাত্রায় কিন্তু আদিবাসী এবং মূলবাসী উভয় গোষ্ঠীর মানুষই যোগ দেন। আর এখানেই এর অনন্য বৈশিষ্ট্য। এই মেলায় কোনও ঠাকুর দেবতা নেই। আছে কেবল নদী জল বালি গাছ পাথর ভরা উন্মুক্ত প্রকৃতি আর মানুষ। তবুও যোগ দেন সকলে। এখন তো মেলায় যোগ দেন ব্রাহ্মণেরাও। বালিযাত্রা যেন আদিবাসী-অআদিবাসী সকল মানুষেরই মিলন মেলা।

বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য যে ভারতের চিরকালীন বৈশিষ্ট্য।

লেখক লোকসংস্কৃতির গবেষক

Subarnarekha River History
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy