Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

মোদী একটু দেখাতে ভালবাসেন, এই যা

কোনও প্রধানমন্ত্রী যদি ভাবেন, আবার প্রধানমন্ত্রী হই বা না হই, কিছু দীর্ঘস্থায়ী কাজ করতে হবে, তবেই দেশটার মঙ্গল।কিছু দিন আগে নতুন সরকারের এক বছর সম্পূর্ণ হল। বিভিন্ন মহলে এ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে: কী প্রত্যাশা ছিল, কেন তা পূরণ হল না, এখনও কেন ভারতীয় অর্থনীতির হাল তেমন ফিরছে না, বিনিয়োগ বাড়ছে না কেন, ইত্যাদি। কিন্তু অর্থনৈতিক প্রসঙ্গকে মাথায় রেখে নৈর্ব্যক্তিক যুক্তিযুক্ত আলোচনা খুব একটা চোখে পড়েনি।

সুগত মারজিৎ
শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

কিছু দিন আগে নতুন সরকারের এক বছর সম্পূর্ণ হল। বিভিন্ন মহলে এ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে: কী প্রত্যাশা ছিল, কেন তা পূরণ হল না, এখনও কেন ভারতীয় অর্থনীতির হাল তেমন ফিরছে না, বিনিয়োগ বাড়ছে না কেন, ইত্যাদি। কিন্তু অর্থনৈতিক প্রসঙ্গকে মাথায় রেখে নৈর্ব্যক্তিক যুক্তিযুক্ত আলোচনা খুব একটা চোখে পড়েনি।

প্রথমেই বলি, এক বছরে ভারতীয় অর্থনীতির কাঠামোগত কোনও গলদ শোধরানোর আশা করা উচিত নয়। বিশেষ করে কিছু ক্ষেত্রে ভাল-মন্দের নির্ধারক উপাদানগুলোর ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ না-ই থাকতে পারে। এমন দু’টি উপাদান হল বৃষ্টি ও তেলের দাম। বৃষ্টি ঠিকঠাক হলে আর তেলের দাম কম থাকলে যে কোনও সরকার সাফল্যের মুখ দেখবে, এগুলো বিরুদ্ধাচরণ করলে বিপদে পড়বে। অবশ্য ভারতে সেচের আওতায় জমির পরিমাণ বেশ কম, নদীনালার সদ্ব্যবহারের ইতিহাসও ভাল নয়। এক বছরে সরকার কিছু না করতে পারলেও ঠিক পদক্ষেপ নিতে পারে, কিন্তু সেটা অন্তত তেমন ভাবে প্রচার হয়নি। অন্য দিকে, স্বল্প পরিধির মধ্যে হলেও এ রাজ্যে ‘জল ধরো-জল ভরো’ পরিকল্পনা মন্দ কাজ করছে না।

স্বীকার করতেই হবে, বিগত সরকারের শেষ দিকে যেমন হাত-পা গোটানোর অবস্থা হয়েছিল, বর্তমান সরকার তার থেকে অনেকটা বেরিয়ে এসেছে, অনেক নতুন নীতি প্রণয়ন করেছে। আবার এটাও স্পষ্ট যে, এঁরা একটু বেশি দেখাতে ভালবাসেন, আর বিদেশ ভ্রমণে এঁদের উৎসাহ। কিন্তু সেগুলো বাদ দিয়ে গভীরতর বিষয় নিয়ে আলোচনা বাঞ্ছনীয়।

স্বচ্ছ ভারতের অঙ্গীকার ও ঘরে ঘরে শৌচালয় নির্মাণের নীতি প্রণয়ন ভাল উদ্যোগ। আমরা যে আসলে অসভ্য, সেটা মনে করিয়ে দিয়ে নিজেদের শোধরানোর প্রস্তুতিও বিচক্ষণ পদক্ষেপ। সবার জন্য বিমার ব্যবস্থাও সুপ্রস্তাব। বিশেষত এই কারণে যে, এটি নিজের পয়সায় নিজের ভবিষ্যৎ সুরক্ষা করার নির্দেশ। গরিব পুজোর নামে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের দানছত্র আমাদের গণতন্ত্রের এক অভিশাপ। দেশে গরিবের সংখ্যা সুপ্রচুর বটে, কিন্তু অনেক মানুষ আর দরিদ্র নেই। নিজেদের ও সমাজের কল্যাণে তাঁদেরও কিছু খরচ করা উচিত। গৌরী সেনের টাকা অপর্যাপ্ত নয়। নিজের স্বল্প খরচে বিমা, পেনশন ইত্যাদি মানুষকে একটু দায়িত্ববান হতে শেখায়, পরনির্ভরশীলতার বাজে সংস্কৃতিকে প্ররোচনা দেয় না। এই প্রকল্পগুলোতে সরকারের প্রত্যক্ষ অবদান থাকবে না। সরকার জনতার পেনশনের ফান্ডের বিমা ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি হবেন, এ অতি উত্তম প্রস্তাব। এক বার ভেবে দেখুন, যদি দেশে ৩০ বা ৪০ কোটি গরিব মানুষকে বাদ দিই, তবে থাকে ৮০ কোটি। চার জনের পরিবার ধরলে ২০ কোটি পরিবার। এঁদের সবাই দিনে ১ টাকা করে ‘ভারত কল্যাণ ফান্ড’-এ জমা দিলে বছরে হয় ৭২০০ কোটি টাকা। অবশ্যই আমরা সবাই পরোক্ষ কর দিই, জিনিসপত্রের দামের মধ্যে সেটা ধরে দিতে হয়, কিন্তু সে অন্য কথা। নিজেরা নিজেদের স্বল্পার্জিত অর্থের কিছুটা নিজেদের জন্য বিনিয়োগ করব, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কাউকে একটি টাকা দেশের কাজে খরচ করতে বললে রাজনীতির মহলে ত্রাহি ত্রাহি রব। এটা পালটানো দরকার।

রাজ্য সরকারগুলিকে রাজস্বের বেশি অংশ দিয়ে তাঁদের উন্নয়নের খরচ নিজেদের নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবহার করার যে মৌলিক দাবি অনেক দিন ধরেই ছিল, তাকে সার্থক করেছে এই সরকার। কিন্তু এই সরকার ব্যবসায়িক বুদ্ধি হয়তো বেশি ধরে, তাই অন্যান্য অনেক অনুদান কমিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ এক হাতে দিয়ে অন্য হাতে নিয়ে নিয়েছে। আখেরে কতটা লাভ হল, তা ক্রমশ প্রকাশ্য। কিন্তু পদক্ষেপটি ঠিক দিকে।

একটি বিষয়ে সরকারের উৎসাহ ও নীতি বালখিল্যবৎ। হঠাৎ জাতীয় আয় মাপার জন্য বেস পিরিয়ড ২০০৪-০৫ থেকে ২০১১-১২ করে দিয়ে দেখানো হল, আমরা চিনের চেয়ে বেশি হারে অগ্রসর। হিসেবের কারসাজির এমন নজির কমই পাওয়া যায়!

আমরা যে অশিক্ষিতের দেশ, তা বলে দিতে হবে না। জাতীয় আয়ের অংশ হিসেবে শিক্ষা খাতে সরকারি খরচ নিম্নমুখী, স্বাস্থ্য, মেয়েদের ওপর খরচের হাল তথৈবচ বলেই ধারণা। ‘শিল্প শিল্প’ করতে গিয়ে সামাজিক ক্ষেত্রের এই বিশাল সমস্যার কথা কেউ বলছেনই না।

‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উত্তম প্রস্তাব, সন্দেহ নেই। তবে আলপিন থেকে যুদ্ধজাহাজ, সব আমাদের নিজেদের তৈরি করার কোনও প্রয়োজন নেই। এটা অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মূল কথা। চিন অনেক কিছু তৈরি করতে পারে। আমাদের পক্ষে তা সহজ নয়, কারণ পরিকাঠামো, কাজের সংস্কৃতি, প্রচ্ছন্ন ভর্তুকি, বা যে কোনও গণ-বিরোধিতায় বুলডোজার চালানো— আমরা কোনওটাতেই পারদর্শী নই। তাই স্লোগান তুলে কিছু হবে না। এ দেশে উদ্যোগপতি হতে গেলে ব্যাংক-ঋণের প্রয়োজন। সামগ্রিক ব্যাংক-ঋণের কতটা শিল্পে নিয়োজিত হয়, তার মধ্যে কতটা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পান এবং তার মধ্যে আবার কতটা কোনও বড় ব্যবসায়ীর বা রাজনৈতিক দাদাদের সঙ্গে সম্পর্কিত নন এমন লোক পান, তার কোনও পরিসংখ্যান কি প্রকাশিত হয়? ক্ষুদ্র নতুন ব্যবসায়ীরা এ দেশে দুঃস্বপ্নের শিকার এখনও। যে ধার চায় না তার পিছনে আমরা দৌড়ই, আর যাঁরা ধার চান তাঁরা ব্রাত্য, কারণ তাঁদের পর্যাপ্ত সম্পদ নেই। মাইক্রো-ঋণ দিয়ে, আর যা-ই হোক, ব়ড় শিল্প হয় না।

ব্যাংক অনাদায়ী ঋণের ভয়ে ঋণ দেয় না। কিন্তু যাঁরা ঋণ শোধ করেননি, তাঁরা ঋণ পেতে পারেন অন্য নামে। কারণ, কোনও ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে ঋণ দেওয়া হয় না, হয় ব্যক্তিকে। অন্য দিকে, অনাদায়ী ঋণ-জনিত অপরাধীদের সরকার কি চিহ্নিত করেছে? করেননি। এটাও গুরুতর ব্যর্থতা।

ভালয়-মন্দয় মিশিয়ে এক বছর কেটেছে সরকারের। কোনও প্রধানমন্ত্রী যদি ভাবেন, আমি যখন প্রধানমন্ত্রী থাকব না, তখন দেশটার কী হবে কিংবা আবার প্রধানমন্ত্রী হই বা না-হই, কিছু দীর্ঘস্থায়ী কাজ করতেই হবে, তবেই এ দেশটার প্রকৃত উন্নতি হবে। দেশের স্বার্থের বাইরে গোষ্ঠী-স্বার্থের ওপর নজর দিলেই সর্বনাশ।

সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE