প্রতীকী ছবি।
নামে অনেক কিছুই আসিয়া যায়। নাম, কোনও এক জনের অস্তিত্বের পরিচায়ক, তাহার স্বাতন্ত্র্যের চিহ্ন। নাম, তাহার স্বপক্ষে কিছু অধিকারের কথাও বলিয়া থাকে। জন্মের শংসাপত্রে পিতা ও মাতার নাম আবশ্যিক। কারণ, তাহাতে সন্তানের সঙ্গে তাঁহাদের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা পায়। কিন্তু ইহা প্রগতিশীল সমাজের আধুনিক চিন্তার প্রতিফলন। যে সমাজ এই ‘আধুনিকতা’রই বিপরীত দিকে হাঁটিতে চায়, তাহার কথা আলাদা। যেমন, আফগানিস্তান। দীর্ঘ তালিবানি শাসনের ছায়া আফগান সমাজ এখনও কাটাইয়া উঠিতে পারে নাই। তালিবানি বন্দুকে ঝাঁঝরা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বা ব্যক্তির অধিকারের ন্যায় শব্দগুচ্ছ আজও সেখানে আবর্জনা-সম বর্জনীয়। উপরন্তু, এই বিপথগামী শব্দগুচ্ছ যদি ভুল করিয়া নারীর সঙ্গে জুড়িবার উপক্রম করে, সেই আশঙ্কায় আফগান নারীদের নাম-হীন করিয়া রাখা হইয়াছে। সেখানে জন্মের শংসাপত্রে, বিবাহের নিমন্ত্রণপত্রে, এমনকী কবরেও মেয়েরা নামবিবর্জিতা। তাঁহাদের আদি-অকৃত্রিম পরিচয়— তাঁহারা কাহারও (অবশ্যই পুত্রের) মা অথবা কাহারও স্ত্রী, কন্যা। (ঠিক যেমন ভারতীয় নারীর জন্য শৈশবে পিতার, যৌবনে স্বামীর এবং বার্ধক্যে পুত্রের অনুগত থাকিবার বিধান!) সম্প্রতি এহেন রীতির প্রতিবাদে পথে নামিয়াছে আফগানিস্তানের নারী অধিকার আন্দোলনের মেয়েরা। ‘হোয়্যারইজমাইনেম’ হ্যাশট্যাগ-এর আড়ালে চলিতেছে আদ্যন্ত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের আত্মপরিচয়কে প্রতিষ্ঠা দিবার অসম লড়াই। ইহাকে কুর্নিশ।
খবরটি পড়িলে আত্মতৃপ্তি জাগে— আমরা তো আধুনিক, ঘরখানিও যথেষ্ট সুরক্ষিত। কিন্তু ভাবিয়া দেখিলে, এহেন ধারণা কিয়দংশে ভ্রান্ত। প্রকৃতপক্ষে, দুই দেশের মানসিকতার দূরত্ব মাপিতে বসিলে অবাক বনিতে হয়— দূরত্ব বিশাল নহে! উভয় ক্ষেত্রেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষ বলিয়া ভাবে এবং সেই কারণেই আফগান নারীর মতোই ভারতীয় নারীও অ-পরিচয়ের শিকার। সেই অ-পরিচয় শুধুমাত্র নামকেন্দ্রিক নহে। কারণ, ভারতীয় নারী নামবিহীন নহেন। খাতায়-কলমে তাঁহার একটি সুস্পষ্ট নাম আছে। সরকারি কারণেই আছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তাহা শুধুমাত্র খাতায়-কলমেই সীমাবদ্ধ। সামাজিক পরিচিতির ক্ষেত্রে এখনও মেয়েরা পুরুষসঙ্গীটির উপর নির্ভরশীল। কিছু কাল আগেও গৃহস্থালির কাজে সাহায্য করিতে আসা মহিলার পরিচয় ছিল কাহারও মা বা স্ত্রীরূপে। এখনও বিবাহিত মহিলার সম্বোধনে, নাম নহে, ‘বউ’ বা ‘বউমা’ বসাইবার রীতি বহুলপ্রচলিত। তথাকথিত প্রগতিশীল উচ্চস্তরের মধ্যেও সান্ধ্য আয়োজনে, পাঁচতারা ক্লাবের আড্ডায় মহিলাদের ‘মিসেস...’ বলিয়া সম্বোধনই দীর্ঘ কালের অভ্যাস। ইহা তো না হয় ‘সামাজিক অভ্যাস’-এর কথা। কিন্তু যে ক্ষেত্রে মেয়ের নাম তাঁহার অধিকারটি আইনসম্মত ভাবে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সহায়তা করিবে, সেখানেও এই দেশে মেয়েদের নাম ব্যবহৃত হয় না। যেমন, কন্যার বিবাহে যে গহনা, দানসামগ্রী বা নগদ টাকা ধরিয়া দেওয়া হয়, তাহাতে কন্যার নাম লেখা থাকে না। ফলে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই দানে কার্যত কন্যার কোনও অধিকারই প্রতিষ্ঠিত হয় না। আবার, নির্মাণ শিল্পের মতো পরিসরে কর্মরত অসংখ্য মহিলা শ্রমিকের নাম শ্রমিক হিসাবে নথিভুক্ত থাকে না। কারণ, তাহা হইলে তো শ্রম আইন অনুযায়ী সুযোগসুবিধা বরাদ্দ করিতে হয়। সুতরাং, মেয়েদের প্রতি বঞ্চনার ধারা সীমানা মানে না। আফগানিস্তান দেখিয়া ভারতের গর্বিত হইবার কারণ নাই।
বরং সচেতনতার দিক হইতে আফগানিস্তান এক পা অগ্রসর হইয়াছে। মেয়েদের পরিচয়-সচেতনতা। নাম না থাকিবার যন্ত্রণা আফগান মেয়েরা যতটা সম্যক উপলব্ধি করিয়াছেন, ভারতীয় মেয়েরা নাম পাইয়াও অনেকেই হয়তো তাহা করেন নাই। আফগান মেয়েরা যে অধিকার লড়াইয়ের বিনিময়ে জিতিয়া লইতে বদ্ধপরিকর, ভারতীয় মেয়েদের একাংশ তাহা স্বেচ্ছায় পরিত্যাগ করিয়াছেন। নিজের নামে নহে, বরং তাঁহারা সফল স্বামী বা সন্তানের পরিচয়ে পরিচিত হইতে গর্ববোধ করেন, তাঁহাদের কৃতিত্বেই সুখী হইতে ভালবাসেন। তাঁহারা স্বেচ্ছায় নিজেদের পুরুষের অনুগতরূপে দেখিতে চাহেন। কারণ, জীবনভর কৃচ্ছ্রসাধন এবং আত্মত্যাগই মেয়েদের গহনা— আশৈশব এমন ধারণা তাঁহারা লালন করিয়া আসিয়াছেন। এই যন্তরমন্তর হইতে তাঁহাদের আশু মুক্তি নাই। ‘হোয়্যারইজমাইনেম’ হ্যাশট্যাগ তাই আত্মতৃপ্তি জাগায় না। বরং শঙ্কিত করে অনেক বেশি।
যৎকিঞ্চিত
পশ্চিমবঙ্গে গণেশপুজো হইহই করে বাড়ছে। আর সেই বাড়বাড়ন্তের পিছনে নাকি তৃণমূল কংগ্রেসের বিরাট ভূমিকা। বিজেপির নেতারা বলছেন, তৃণমূল চাঁদা তোলার জন্য সিদ্ধিদাতা গণেশকেও ধরেছে। সে-সব রাজনীতির কূটকচালি। রসিক নাগরিকরা বলছেন, গণেশই শাসক দলের স্বাভাবিক দেবতা। তিনি জননীকে প্রদক্ষিণ করে বলেছিলেন, পৃথিবী প্রদক্ষিণ করা হয়ে গেল। তৃণমূলের ভাইসকলও সর্বদা দিদিকে প্রদক্ষিণ করে সর্বসিদ্ধি লাভ করেন। এক ছাঁচে ঢালা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy