প্রতীকী ছবি।
ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া শিশিরবিন্দুটিকে দেখিতে পঞ্চান্ন বৎসর কাটিয়া গেল। ১৯৬৪ সালের পর হইতে এই প্রথম কোনও ভারতীয় দল ডেভিস কাপ খেলিতে পাকিস্তানের মাটিতে পা রাখিবে। ছাড়পত্র পাইবার প্রক্রিয়াটি সহজ হয় নাই। পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত অন্য ক্রীড়াসফরগুলির মতো এই সফরটি লইয়াও যথেষ্ট অনিশ্চয়তা তৈরি হইয়াছিল। পুলওয়ামা-বালাকোটের পরে দুই দেশের সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটে। বন্ধ হয় আকাশসীমাও। তাহার মাত্র সাত মাসের মধ্যে ‘শত্রু’ দেশে টেনিস দল পাঠাইবার ন্যায় ‘ঔদার্য’ কিঞ্চিৎ অপ্রত্যাশিত বটে। তবু যে তাহা ঘটিতে চলিয়াছে, এবং দীর্ঘ পঞ্চান্ন বৎসর পর ঘটিতে চলিয়াছে, তাহা সুলক্ষণ।
বেদনারও বটে। পাশাপাশি দুই দেশ, অথচ এমন দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা! কী মজবুত কাঁটাতারই না বসানো হইয়াছিল ১৯৪৭ সালের অগস্ট মাসে! ধর্মের ভিত্তিতে টানা বিভাজনরেখাটি ক্রমে দুই দেশের সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের ক্ষেত্রটিও দখল করিয়া লয়। সেই কারণেই দুই দেশের সম্পর্ক যখনই তিক্ত হয়, কূটনৈতিক আলোচনা বন্ধ হইবার পাশাপাশি ছেদ পড়ে ক্রীড়া-সম্পর্কেও। নেতারা তো বটেই, নাগরিক সমাজের মধ্য হইতেও দাবি ওঠে— পড়শি দেশের শিল্পীকে বা খেলোয়াড়দের পত্রপাঠ বিদায় জানানো হউক। মুম্বইয়ে পাকিস্তানি সঙ্গীতশিল্পী গুলাম আলির অনুষ্ঠান বাতিল করা সংক্রান্ত কুনাট্য এখনও সম্পূর্ণ বিস্মৃত নহে। ইতিপূর্বে বহু বার দেশের মাটিতে জঙ্গি হামলার পর বাতিল হইয়াছে প্রতিবেশী দেশে ক্রিকেট সফর। পাকিস্তানের মাটিতে ভারতীয় ক্রিকেট দল এক দশকেরও বেশি সময় পা রাখে নাই। যখনই প্রস্তাবিত সফর বাতিল হইয়াছে, তখন নিরাপত্তার অভাবের প্রসঙ্গটি উঠিয়াছে। পাকিস্তানের মাটিতে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ নিঃসন্দেহে উদ্বেগের কারণ, বিশেষত শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট টিমের উপর জঙ্গি হামলার পরে তো বটেই। কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের ক্রীড়া-সম্পর্কে ধারাবাহিক শৈত্যের মূল কারণ যে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া ‘শিক্ষা’ দিবার বালখিল্য বাসনা, তাহাতে সন্দেহ নাই। এই মানসিকতার বশবর্তী হইয়াই ভারতে আয়োজিত শুটিং বিশ্বকাপে অংশ লইতে আসা পাকিস্তানি শুটারদের ভিসা দেওয়া হয় নাই। উদাহরণের তালিকা দীর্ঘ করা অনাবশ্যক।
অথচ, খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সহজ, সাবলীল যোগাযোগই এই সম্পর্কের উত্তাপ হ্রাস করিতে পারিত। তাহা হয় নাই। এ হেন মূল্যবান অস্ত্রটিকে রাজনৈতিক প্রয়োজনে উভয় সরকারই সচেতন ভাবে সরাইয়া রাখিয়াছে। ভাবিয়া দেখিলে, অমৃতসর হইতে লাহৌরের দূরত্বই বা কতটুকু? সড়কপথে এক ঘণ্টার অধিক তো নহে। অথচ দুই দেশের মানসিক দূরত্ব দাঁড়াইয়াছে কয়েক আলোকবর্ষ। র্যাডক্লিফের ছুরি শুধু একটি দেশকে দুই টুকরো করে নাই, অনেক পরিবারকেও বিচ্ছিন্ন করিয়াছে। দেশ ভাঙিলে, পারিবারিক সম্পর্কের মধ্যে হঠাৎই পাসপোর্ট-ভিসা প্রবেশ করিলেও অন্তরের টানটি তো শুকাইবার কথা নহে। হয়তো সত্যই শুকায় নাই। শুধুমাত্র ঢাকা পড়িয়াছে নিষ্প্রাণ কূটনৈতিক কঠোরতায়। সেই কারণেই হয়তো পঞ্চান্ন বৎসর পর টেনিস দল সীমান্ত পার হইবার সম্ভাবনায় প্রাণের উচ্ছ্বাস কম পড়ে, তাহা শুধুই ‘শান্তির পদক্ষেপ’ হইয়া থাকিয়া যায়। ইহার অপেক্ষা বেদনার আর কী-ই বা আছে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy