প্র থমে পুলিশ, অতঃপর সেনা। স্থূলত্বের বিরুদ্ধে সর্বত্র যুদ্ধ ঘোষিত হইল। পৃথুল পুলিশ জনস্বার্থবিরোধী, এই যুক্তিতে কলকাতায় মামলা পর্যন্ত হইয়াছে। মধ্যবয়সি পুলিশদের মেদবহুলতাকে পুলিশকর্তারা খানিক ক্ষমার চক্ষে দেখিলেও, কলকাতা হাই কোর্ট সে যুক্তি খারিজ করিয়া দিয়াছে। বিচারপতিদের প্রশ্ন, বয়স বাড়িলে কি তৎপর থাকিবার প্রয়োজন কমিয়া যায়? সেনাবাহিনীর কর্তারা মেদবাহুল্যের প্রতি আরও নিষ্করুণ। পদোন্নতি হইতে পদকপ্রাপ্তি, সকল বিবেচনাতেই যে কৃতিত্বের ওজন কমাইবে দেহের ওজন, সে বিষয়ে কড়া বার্তা দেওয়া হইয়াছে। সেনাবাহিনীর নানা প্রদর্শনীমূলক অনুষ্ঠানে যে স্থূলকায়রা সহজে স্থান পাইবেন না, তাহারও ইঙ্গিত মিলিয়াছে। দেহের ওজন দিয়া পেশাদারিত্বের বিচার সঙ্গত কি না, সে বিষয়ে ইহার পূর্বে বিতর্কে জড়াইয়াছিলেন বিমানসেবিকারা। তন্বী থাকিবার শর্তে আপত্তি তুলিয়া আদালতের শরণ লইয়াছিলেন এয়ার ইন্ডিয়ার তিন জন বিমানসেবিকা। তাহাদের অবশ্য কাজে পুনর্বাসন হইয়াছিল, তবে বিমানে নহে, বিমানবন্দরের কর্মী হিসাবে। ঘটনাগুলি এক একটি সতর্কবার্তা। স্থূলত্ব উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, মধুমেহ-সহ নানা রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। অতি-স্থূলত্ব স্বয়ং একটি রোগ। তাহা কার্যক্ষমতা হ্রাস করে।
এত দিন পশ্চিমের দেশগুলিতেই অতিরিক্ত স্থূলত্বের ঘটনা চোখে পড়িত। এখন ভারতেও তাহা দ্রুত বাড়িতেছে। ল্যানসেট পত্রিকায় প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রের দাবি, স্থূলত্ব-আক্রান্ত মানুষের হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চিনের পরেই ভারত। ভারতের জনসংখ্যার নিরিখে তিন কোটি খুব অধিক নহে, কিন্তু বিশ্বে তাহাই তৃতীয় স্থানে। গোটা বিশ্বে তিন জনের এক জন, অর্থাৎ দুশো কোটি মানুষ স্থূল। অতএব অতিরিক্ত ওজন এখন জনস্বাস্থ্য সমস্যায় পরিণত হইয়াছে। কিন্তু প্রতিটি স্বাস্থ্য সমস্যার একটি সামাজিক দিকও থাকে। স্থূলত্ব শুধু উদ্বেগ নহে, লজ্জার বিষয় হইয়া উঠিয়াছে। তাহা যেন ব্যক্তির ব্যর্থতা। মেদ লইয়া ব্যঙ্গকৌতুক চিরপ্রচলিত, কিন্তু এখন তাহা নির্দোষ আমোদ ছাড়াইয়া সামাজিক বর্জনের দিকে যাইতেছে। পুলিশ, সেনাবাহিনী, খেলাধুলার জগতে যাহা পেশার প্রয়োজনে অপরিহার্য, তাহা বাকি সমাজেও মাপকাঠি বলিয়া গৃহীত হইয়াছে।
পাশ্চাত্যে দেহাকৃতি লইয়া লজ্জাপ্রদান (বডি শেমিং) একটি সামাজিক ব্যাধি। তাহা পরোক্ষ ভাবে চলে অধিক। ফ্যাশন, প্রসাধন ও বিনোদনের জগতে ক্ষীণকায় ব্যক্তিদেরই ‘আকর্ষণীয়’ বলিয়া তুলিয়া ধরা হয়। ফলে স্থূলত্ব আপনিই খাপছাড়া, বিসদৃশ হইয়া ওঠে। স্থূল ব্যক্তি নিজেকে অপাংক্তেয় ভাবিতে থাকেন। ইহা অন্যায়। দেহবর্ণ বা মুখাকৃতি দিয়া মানুষের বিচার যদি বর্জনীয় হয়, তবে দেহের ওজন দিয়া তাহার মূল্যায়নও চলিতে পারে না। কারণ, চাহিলেই দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব এই ধারণা ভুল। উন্নয়নশীল দেশগুলিতেও এখন অধিক স্নেহপদার্থ, অধিক শর্করাযুক্ত প্যাকেটজাত খাবারের প্রচলন বাড়িয়াছে। সেগুলি মুখরোচক, স্বল্পমূল্য এবং সহজলভ্য। তাই দরিদ্র পরিবারগুলিতে এগুলির চাহিদা বাড়িয়াছে। অপর দিকে তাজা ফল, তরিতরকারি বহুমূল্য। অতিরিক্ত ওজন অনেক ক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক বিপন্নতার নিদর্শন। স্থূলত্ব কাম্য নহে, কিন্তু স্থূলকায় ব্যক্তিদের সকল প্রকার সম্মান ও সমাদর প্রাপ্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy