Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

তিনি পাচারকারীদের যম

এই রথীমহারথীরা ঝাড়খণ্ডের প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামগুলো থেকে শুধু শিশু ও নারী পাচার করেই কোটিপতি হয়েছে।

আর্যভট্ট খান
শেষ আপডেট: ১১ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

কেউ ওঁকে বলেন আয়রন লেডি। কেউ সুপারউওম্যান, কেউ বলেন পাচারকারীদের সাক্ষাৎ যম। বাঘা বাঘা শিশু-নারী পাচারকারীদের তিনি কুপোকাত করেছেন। জেলের গারদে পুরে তাদের দিকে তর্জনী তুলে বলেছেন, ‘‘মেরে বচ্চোঁকে উপর আঁখ উঠাকে ভি দোবারা মত দেখনা।’’ ঝাড়খণ্ডের প্রত্যন্ত এলাকার গরিব শিশুরা সত্যিই তাঁর কাছে ‘বেটা বেটি’। আরাধনা সিংহের (ছবিতে) সরকারি পরিচয়— তিনি ঝাড়খণ্ডের খুঁটি শহরে অ্যান্টি হিউম্যান ট্রাফিকিং অফিসার। অবশ্য সদ্য এই পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। কিন্তু অবসর নিলেও কাজ থামাবেন না তিনি। বললেন, ‘‘আপাতত ২৫০ জন শিশু নিয়ে আমার সংসার। এদের সবাইকে আমি বিভিন্ন বড় বড় শহরের নরক থেকে উদ্ধার করেছি। ওরা ঠিক মতো স্কুলে যাচ্ছে কি না, খাওয়াদাওয়া করছে কি না, ফের কোনও পাচারকারীর খপ্পরে পড়ছে কি না, সব দিকে আমায় নজর রাখতে হয়।’’

ঝাড়খণ্ডের বেশির ভাগ থানাতে ঢুকলেই দেখা যায় দেওয়ালে ঝুলছে চোর, ডাকাত, খুনি, পকেটমারদের ছবি। ঝাড়খণ্ডের রাঁচি থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে খুঁটি শহরে আরাধনা সিংহের চেম্বারে ঢুকে দেখা গেল সে রকম অনেক আলোকচিত্র। তবে চোর, ডাকাত বা পকেটমারদের নয়, ঝোলানো রয়েছে বাঘা বাঘা সব পাচারকারীদের ছবি। যাদের তিনি জেলে ভরেছেন। বললেন, ‘‘গত চার বছরে ৮০ জনের মতো নারী-শিশু পাচারকারীকে জেলে পুরেছি। এর মধ্যে পান্নালাল, বামদেব, কিনু মুণ্ডা, লতা লাকড়ার মতো রথীমহারথীরাও আছে।’’

এই রথীমহারথীরা ঝাড়খণ্ডের প্রত্যন্ত এলাকার গ্রামগুলো থেকে শুধু শিশু ও নারী পাচার করেই কোটিপতি হয়েছে। অভিযোগ, সেই টাকায় বড় বড় শহরে কেউ আবাসন শিল্পে, কেউ আবার হোটেল ব্যবসায় নেমেছে, কেউ শপিং মলও বানিয়েছে। আরাধনা দেবী বলেন, ‘‘অত্যন্ত প্রভাবশালী এই সব পাচারকারীদের ধরা কিন্তু সহজ ছিল না। অনেক রাজনৈতিক নেতাও এদের সঙ্গে ওঠাবসা করেন।’’ হাসতে হাসতে বললেন, ‘‘এদের ধরা আর সবুজ ঘাসে ভরা পিচে ফাস্ট বোলাদের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি করা একই ব্যপার। একের পর এক বাউন্সার সামলে তবেই ওদের ধরা গিয়েছে।’’

নারী-শিশু পাচার কেন এত সহজ হয়ে গিয়েছে আমাদের দেশে? আরাধনাদেবীর বক্তব্য, ‘‘একটু ঘুরে আসুন না ঝাড়খণ্ডের গ্রামগুলোতে। তা হলেই বুঝবেন কেন গ্রামের শিশুরা সহজলভ্য। এক একটা ঘরে কিলবিল করছে শিশু। সেখান থেকে এক জন দু’জনকে কাজের টোপ দিয়ে ভ্যানিশ করা খুব সহজ। শহরে গেলে কাজ মিলবে, জুটবে মোবাইল ফোন, ভাল জামাকাপড়, ভাল খাওয়াদাওয়া।’’

গ্রামের মানুষরা অনেকেই এই সব টোপ টপ করে গিলে ফেলেন। যখন তাঁদের হুঁশ ফেরে, তখন শিশুরা আর ফেরে না। তখন তাঁরা হাজির হন ত্রাতা আরাধনার দরবারে। সেখানে, দেখা গেল, বসে রয়েছেন খুঁটি জেলা থেকে আসা এক মহিলা। দু’বছরের মেয়েকে গামছা দিয়ে পিঠে বেঁধে গ্রাম থেকে থানায় আরাধনাদেবীর কাছে এসেছেন এই অসহায় মা। কাজ দেওয়ার নাম করে তাঁর বারো বছরের মেয়েকে নিয়ে গেল এক মহিলা। ছ’মাস হয়ে গেল মেয়ের খোঁজ নেই। বাবা চান বিষয়টাকে ধামাচাপা দিতে। কিন্তু মায়ের মন মেয়ের জন্য আকুল। তাই আরাধনার দরবারে।

মাকে খুব বকলেন আরাধনা। যার হাত দিয়ে মেয়েকে পাঠালে, তার ঠিকানা বা মোবাইল নম্বর আছে? এত দিন থানায় অভিযোগ জানাওনি কেন?

আরাধনা সেই মোবাইল নম্বর নোট করে নিলেন। তার পর জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তুমি কি তোমার স্বামীর বৈধ বউ? না সতিন?’’

হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন? কারণ, শুধু দারিদ্রের জন্যই যে গ্রাম থেকে শিশু পাচার হয়ে যাচ্ছে, এই সরল ব্যাখায় যেতে রাজি নন আরাধনা। তিনি জানালেন, সহজে শিশু পাচার হওয়ার জন্য দায়ী আদিবাসী গ্রামের নানা সামাজিক কারণও। তিনি বললেন, ‘‘আদিবাসীদের গ্রামগুলোতে গিয়ে দেখুন, অনেক বাড়িতেই পুরুষের একাধিক বউ। এক জন বৈধ বউ। অন্য জন নয়। পুরুষটি তাঁকে খেতে পরতে দেয়, এই যথেষ্ট। আইনি বউ না হলে তাঁর শিশুরা আরও বেশি অবহেলিত। একটু বড় হলেই তারা পাচারকারীর সহজ শিকার হয়ে যায়।’’

নিজেদের সংগঠন বাড়ানোর জন্য গ্রামের শিশুদের জোর করে ধরে নিয়ে যায় মাওবাদীরাও। তাদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এই সব শিশুকে বরং শহরে কাজে পাঠিয়ে দেওয়া ভাল বলে মনে করে অনেক পরিবার। যারা গ্রামে তাদের মেয়ে নিতে আসে তারা তো বন্ধু সেজেই আসে। কোথায় কাজ করবে তার লেটারহেড দেখায় তাঁদের। স্ট্যাম্প মারা কাগজপত্রে সইসাবুদও হয়। কিন্তু এই রকম কাগজপত্র সবই যে ভাঁওতা, তা বার বার ঠেকেও বুঝতে পারছেন না অনেকেই। তাই শুধু পাচারকারীদের ধরে ধরে জেলে পুরলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। আরাধনা মনে করেন, দরকার আরও বেশি বেশি প্রচার।

এই প্রচারের কাজটা অবসরের পর আরও জোরকদমে শুরু করবেন— জানালেন তিনি। অবসর নিলেও তাঁর নারী-শিশু পাচারের বিরুদ্ধে কাজ করে যাওয়া বন্ধ করবেন না। বললেন, ‘‘এত দিন একটা সরকারি তকমা ছিল। এ বার সেই তকমাটা গেল। তাই এখন কাজটা আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং। এ বার থেকে পাচারকারীদের গ্রেফতার করার ক্ষমতা থাকবে না ঠিকই, কিন্তু ওদের অন্য ভাবে জব্দ করব।’’

গ্রামের মানুষ জানেন তাঁদের ম্যাডাম আর এই থানায় বসবেন না আরাধনা বললেন, ‘‘এই থানায় যিনি বসবেন তাঁর কাছে তোমরা অভিযোগ জানাতে এসো। তবে আমার বাড়ির দরজাও তোমাদের জন্য সব সময় খোলা।’’ খোলা দরজার সামনেই এ বার থেকে বোধহয় ভিড় জমাবেন গ্রামের এই সব অসহায় মানুষগুলো।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE