Advertisement
E-Paper

হৃদয়ে খরার প্রকোপ

সভ্যতা যত এগিয়েছে, চেতনা যত আধুনিক হয়েছে, মানবিক বোধগুলো তো তত বেশি করে সশক্ত হয়েছে। তা সত্ত্বেও আশেপাশে রোজ অমানবিক মুখচ্ছবি সংখ্যায় বাড়ছে কেন? সংবেদনশীলতা কি কমে যাচ্ছে আমাদের?

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০১৮ ০০:৫৫
সোনারপুর থানা এলাকার মিশন পল্লীতে বাড়িতে অর্চনা কোলে।

সোনারপুর থানা এলাকার মিশন পল্লীতে বাড়িতে অর্চনা কোলে।

অমানবিকতার মুখ নিষ্ঠুরই হয়। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু সে মুখের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে দেখলে আশ্চর্য হতেই হয়। আতঙ্কিতও হতে হয়।

এক মা ও তাঁর দুই সন্তানের জীবনোপাখ্যান স্তম্ভিত করল। অর্চনা কোলের দাম্পত্য জীবন কেটেছে হাওড়ার সালকিয়ায়। স্বামীর অকাল প্রয়াণে ব্যাঙ্কের চাকরিটি তিনি পাচ্ছিলেন, কিন্তু নেননি। বড় ছেলেকে দিয়ে দেন। বাবার চাকরি পাওয়া সত্ত্বেও বড় ছেলে পরিবারের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করেননি। অশান্তি এড়াতে ছোট ছেলেকে নিয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনার সোনারপুরে গিয়ে থাকতে শুরু করেন অর্চনা। এ বার ছোট ছেলের তরফ থেকে আঘাতটা এল। স্ত্রীয়ের নামে সোনারপুরের বাড়ি অবিলম্বে লিখে না দিলে জানালা দিয়ে ফেলে দেওয়া হবে— মাকে শাসানি ছোট ছেলের। সঙ্গে মারধরও।

অর্চনা কোলের অভিযোগ অন্তত এ রকমই। তিনি পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছেন। প্রবীণার কনিষ্ঠ পুত্র এবং পুত্রবধূকে পুলিশ গ্রেফতারও করেছে।

পুলিশ-প্রশাসন হস্তক্ষেপ করেছে, কাম্য পদক্ষেপ করেছে, ন্যায়ের দিকেই হয়ত ঘটনাপ্রবাহ এগোচ্ছে। কিন্তু পুলিশ-প্রশাসন-বিচারালয়ের হাত ধরে অর্চনা কোলে যদি কোনও ন্যায়ে পৌঁছতেও পারেন, তা হলেও সে তো হবে আইনি ন্যায় বা ফৌজদারি ন্যায়। বৃহত্তর মানবিক অর্থে ন্যায় বলতে যা বোঝায়, অর্চনা কোলে কি কোনও ভাবেই আর সে ন্যায়ে পৌঁছতে পারবেন? জনৈকা অর্চনা কোলের সঙ্গে জীবন কি ন্যায় করল? নিজের পরিবারের কাছ থেকে যা পেলেন তিনি, নিতান্ত আপন মানুষগুলোর কাছে থেকে তা কি প্রাপ্য ছিল ওঁর? অন্যায়গুলোর মুখোমুখি হতে হতে এবং ভয়াবহ ধাক্কাগুলো খেতে খেতে জীবনের যে পর্বে এখন উপনীত ওই প্রবীণা, তাতে কি আর কোনও সম্ভাবনাময় কাল অপেক্ষায় থাকতে পারে তাঁর জীবনের অবশিষ্ট পথটুকুতে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলেই অসীম অস্বস্তি ঘিরে ধরতে শুরু করে।

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

শুধু অর্চনা কোলে নামে এক প্রবীণার জীবনোপাখ্যান কিন্তু এটা নয়। আখ্যানে উনিশ-বিশ ফারাক নিয়ে এমন আরও শয়ে-শয়ে, হাজারে-হাজারে অর্চনা কোলে ছড়িয়ে রয়েছেন। শহরে-শহরে, গ্রামে-গ্রামে, পাড়ায়-পাড়ায় এমন ঘটনা চোখে পড়ে আজকাল। কেউ প্রবীণ বাবা-মায়ের খোঁজ রাখেন না, কেউ বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসেন, কেউ নিয়ম করে মারধর করেন, কেউ জোর করে সম্পত্তি লিখিয়ে নেন, কেউ অসীম মানসিক পীড়ায় রাখেন, কেউ আবার দুর্বোধ্য আক্রোশে খুনও করে দেন। একের পর এক চমকে দেওয়া ঘটনা সামনে আসে মাঝেমধ্যেই! আমরা শিউরে উঠি। আমরা সমস্বরে বলি— ‘ছিঃ’। আমরা বিস্মিত হই একযোগে। তার আমাদেরই কারও না কারও ঘর থেকে একই আখ্যান রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। অনেক ঘটনা সংবাদমাধ্যমে পৌঁছয়। তার চেয়েও অনেক বেশি সংখ্যক সম্ভবত পৌঁছয় না। কিন্তু নিতান্ত আপন কোনও মানুষের সঙ্গে আবর্জনার মতো ব্যবহার করা বা তাঁকে ছুড়ে ফেলার প্রবণতা যেন দিন দিন শুধু বাড়তেই থাকে।

আরও পড়ুন: সম্পত্তি লিখে দাও, নইলে জানলা দিয়ে ফেলে দেব, মাকে হুমকি ছেলের

এই সঙ্কট কেন বাড়ছে, তা বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সভ্যতা যত এগিয়েছে, চেতনা যত আধুনিক হয়েছে, মানবিক বোধগুলো তো তত বেশি করে সশক্ত হয়েছে। তা সত্ত্বেও আশেপাশে রোজ অমানবিক মুখচ্ছবি সংখ্যায় বাড়ছে কেন? সংবেদনশীলতা কি কমে যাচ্ছে আমাদের? হৃদয়ের আর্দ্রতায় কি ঘাটতি দেখা দিচ্ছে? প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি দাঁড়ানো দরকার আজ। আমাদের প্রত্যেকের দাঁড়ানো দরকার। না হলে সামনের দিনগুলোয় অভূতপূর্ব আঁধার আমাদের অপেক্ষাতেও থাকবে।

Crime Newsletter Anjan Bandyopadhyay Sonarpur অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় সোনারপুর
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy