গাঁধীমূর্তির রং রাতারাতি গেরুয়া করিয়া দিলে কি গাঁধীর আদর্শের রং পাল্টাইয়া যায়, না কি ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে গেরুয়াপন্থীদের গুরুত্ব বা অবদান তাহাতে তিলমাত্র বাড়ে? উত্তরপ্রদেশের শাহজাহানপুর জেলার ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া যদি এই প্রশ্নগুলি মনের গভীরে আন্দোলিত হয়, যদি এই দুষ্কৃতীদের আচরণকে অবান্তর বালখিল্যতা বলিয়া বোধ হইতে থাকে, তবে মনকে শাসন করা প্রয়োজন। মনকে বলা বিধেয় যে এই কুকীর্তি এক দুঃসময়ের প্রতীক। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের উপর গায়ের জোরে গৈরিক জাতীয়তাবাদ চাপাইয়া দেওয়ার প্রকট অপচেষ্টার প্রতীক। মুঘলসরাই জংশনের নাম পাল্টাইয়া দীনদয়াল উপাধ্যায় করিয়া দেওয়া যেমন, উত্তরপ্রদেশের কার্যত সব সরকারি বাড়িকে গৈরিক রঙে রঞ্জিত করা যেমন, গাঁধীমূর্তির উপর এই আক্রমণও তেমনই। জাতির জনকের মূর্তি বিকৃত করিবার ঘটনাটি এমনিতেই নিন্দনীয়। কিন্তু, গৈরিক আধিপত্যবাদের প্রেক্ষিতে সেই নিন্দার ভাষা আরও তীব্র, আরও কঠোর হইতেই হইবে। সরাসরি আঙুল তুলিতে হইবে রাজ্য সরকারের দিকে। এ কোন সংস্কৃতিকে তাহারা স্বীকৃতি দিয়াছে, মদত দিয়াছে যে স্বয়ং মহাত্মা গাঁধীরও আর নিষ্কৃতি নাই? অবশ্য, এই প্রসঙ্গে কেহ বলিতে পারেন, যে মতাদর্শের ধারক বাহকেরা রক্তমাংসের মহাত্মাকেই ছাড়েন নাই, তাঁহারা মূর্তিকে রেহাই দিবেন কেন? মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীকে হতমান না করিলে কি ভারতের বুকে কখনও নাগপুর ছাঁচের হিন্দু জাতীয়তাবাদের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব?
শুধু যোগী আদিত্যনাথকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাইলে বিচার সম্পূর্ণ হয় না। দায় নরেন্দ্র মোদীর উপরও বর্তায়। দেশের উপর হিন্দু জাতীয়তাবাদকে চাপাইয়া দেওয়াই যে এই যুগের ধর্ম, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে কথাটি তিনি বহু বার বুঝাইয়া দিয়াছেন। এই আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁহার মন কি বাত কখনও শোনা যায় নাই। এই হিন্দু আধিপত্য নাগপুরের দীর্ঘ লালিত স্বপ্ন। গাঁধী-নেহরুকে বিচ্যুত করিয়া দীনদয়াল উপাধ্যায়-মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর-শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারকে দেশনায়কের ভূমিকায় প্রতিষ্ঠা করা সেই স্বপ্নের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাহার জন্য এক দিকে যেমন দীনদয়াল উপাধ্যায়দের নাম বারে বারে জনপরিসরে ফিরাইয়া আনিতে হয়, তেমনই ভাঙিতে হয়, মুছিতে হয় গাঁধী-নেহরুকে। তাঁহারা প্রতিষ্ঠান ভাঙিতেছেন, প্রতীক মুছিতেছেন। আর নিচু তলার অত্যুৎসাহী কর্মীরা গাঁধীমূর্তিকে গৈরিক করিয়া তুলিতে ব্যস্ত।
প্রশ্ন হইল, এই ভাবে কি গাঁধীকে মুছিয়া ফেলা যায়, বা অপ্রাসঙ্গিক করিয়া তোলা যায়? উত্তরটি আশাপ্রদ নহে। গাঁধীর আদর্শ কী ছিল, অথবা নেহরু ভারতকে কী ভাবে দেখিতে চাহিয়াছিলেন, সেই প্রশ্নের উত্তর নাগপুরের শত প্রচেষ্টাতেও বদলাইবে না। তাহার প্রয়োজনও নাই। সেই কথাগুলি যাহাতে জনগণের নিকট না পৌঁছায়, গাঁধী-নেহরুর দর্শন সম্বন্ধে সাধারণ ভারতবাসী যাহাতে অজ্ঞ থাকেন, শুধু সেটুকু নিশ্চিত করিতে পারিলেই নাগপুরের প্রকল্পটি সফল হইবে। যেমন, দীনদয়াল উপাধ্যায় কে, সেই বিষয়ে বিন্দুমাত্র ধারণাহীন এক জন মানুষ যদি যাতায়াতের পথে প্রতিনিয়ত একটি গুরুত্বপূর্ণ রেল স্টেশনে তাঁহার নাম দেখিতে থাকেন, তিনি হয়তো বিশ্বাস করিবেন, উপাধ্যায় ভারতের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। যে মানুষ গাঁধীকে চিনিবেন না (অথবা গৈরিক বসনে চিনিবেন), অথচ উপাধ্যায়কে সম্মান করিতে শিখিবেন, তাঁহার সেই অজ্ঞানতার সুযোগেই তাঁহাকে হিন্দু ভারতের নাগরিক করিয়া তোলা সহজ হইবে। ঠিক এই কারণেই উত্তরপ্রদেশের ঘটনাক্রম ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ, উদার চরিত্রের পক্ষে অতি বিপজ্জনক। ইতিহাস এই পথেই বিকৃত হয়। দেশ এই পথেই রসাতলে যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy