Advertisement
E-Paper

উন্নয়নের দায়িত্ব রাষ্ট্রেরই

দরিদ্র হলেও উচ্চবর্ণের জন্য কেন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়? অর্থনৈতিক ভাবে পশ্চাৎপদ শ্রেণির জন্য কেন্দ্রীয় সরকার দশ শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা ইস্তক এই প্রশ্নটার সুস্পষ্ট উত্তর খোঁজা খুব দরকার হয়েছে।

শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০১৯ ০১:০২
উল্লাস: আর্থিক ভাবে অনগ্রসরদের জন্য দশ শতাংশ সংরক্ষণের বিল পাশ হওয়ার পর মুম্বইয়ে বিজেপি সমর্থকদের জমায়েত। পিটিআই

উল্লাস: আর্থিক ভাবে অনগ্রসরদের জন্য দশ শতাংশ সংরক্ষণের বিল পাশ হওয়ার পর মুম্বইয়ে বিজেপি সমর্থকদের জমায়েত। পিটিআই

দরিদ্র হলেও উচ্চবর্ণের জন্য কেন সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়? অর্থনৈতিক ভাবে পশ্চাৎপদ শ্রেণির জন্য কেন্দ্রীয় সরকার দশ শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা ইস্তক এই প্রশ্নটার সুস্পষ্ট উত্তর খোঁজা খুব দরকার হয়েছে। ‘অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন’ বস্তুটার— সংরক্ষণ যার অতি জরুরি অংশ— দার্শনিক ভিত্তি মিলবে ডিস্ট্রিবিউটিভ জাস্টিস বা বণ্টনের ন্যায্যতার তত্ত্বে। সেই ধারায় অনেক তত্ত্ব, তার অনেক অভিমুখ। কিন্তু, মূল সুরটাকে যদি বার করে নিয়ে আসতে হয়, তবে তা এই রকম: ভাগ্যের কারণে যেন কাউকে বঞ্চিত না হতে হয়। তথাকথিত নিম্নবর্ণের ঘরে জন্মানো ‘দুর্ভাগ্য’ বটে— কারণ, বর্ণাশ্রমের অচলায়তন এই নিম্নবর্ণের মানুষকে দীর্ঘ কাল উন্নয়নের যাবতীয় সুযোগসুবিধার বাইরে রেখেছে। শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে, পেশা বাছাইয়ের স্বাধীনতায়, বহু প্রজন্ম ধরে এই সব কিছুর বঞ্চনা যে জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের দৌড়ের শেষ সারিতে রেখেছে, সেখানে জন্মানো দুর্ভাগ্য, নিশ্চয়। এবং এমন দুর্ভাগ্য, যার ওপর নিজের বিন্দুমাত্র নিয়ন্ত্রণ থাকে না। ঠিক যেমন শারীরিক প্রতিবন্ধকতা।

এই দুর্ভাগ্য যেন কাউকে বঞ্চিত না করতে পারে, তার জন্যই সংরক্ষণ। তফসিলি জাতি, জনজাতি বা অন্যান্য অনগ্রসর জাতির জন্য যেমন সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে, তেমনই আছে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রেও। অন্য দিকে, মদ খেয়ে, অথবা জুয়া খেলে সর্বস্বান্ত হলে, বা ব্যবসায় কারও ভরাডুবি হলেও কিন্তু সরকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে না। কথাটা এমনই স্বতঃসিদ্ধ যে হাস্যকর ঠেকতে পারে। হাসির কথা কিন্তু নয়। কোন দুর্ভাগ্য নিজের তৈরি করা, অর্থাৎ যাকে এড়ানো যায় বা যেত, আর কোন দুর্ভাগ্যের ওপর নিজের কোনও হাত থাকা সম্ভব নয়, অর্থাৎ যা এড়ানো অসম্ভব— ন্যায্যতার বিচারে সেটা মস্ত প্রশ্ন। যে দুর্ভাগ্য নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে, একমাত্র তাতেই সংরক্ষণের দাবি করা যায়।

যে অর্থনৈতিক দুর্ভাগ্য নিজের ডেকে আনা, তার জন্য সংরক্ষণের দাবি করা যায় না, সেটা স্পষ্ট। কিন্তু, যে অর্থনৈতিক দুর্ভাগ্য পিতৃপুরুষের থেকে উত্তরাধিকারে পাওয়া? কোনও এক প্রজন্মের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে যদি উচ্চবর্ণের কোনও পরিবার যদি ক্রমেই তলিয়ে যেতে থাকে দারিদ্রের পাঁকে, ক্রমেই পিছিয়ে পড়ে উন্নয়নের দৌড়ে? কয়েক প্রজন্ম পরে কি সেই দুর্ভাগ্যকে ‘নিয়ন্ত্রণের অতীত’ বলেই ধরে নেওয়া উচিত নয়? যদি তা-ই হয়, তবে দলিত পরিবারের সঙ্গে এই উচ্চবর্ণের পরিবারটির সংরক্ষণের দাবির ন্যায্যতায় ফারাক থাকবে কেন?

থাকবে, তার কারণ হল, নিয়ন্ত্রণাতীত দুর্ভাগ্যের শিকার হওয়া সংরক্ষণের আওতায় আসার জন্য জরুরি, কিন্তু যথেষ্ট নয়। সেই ‘দুর্ভাগ্য’ তৈরি হচ্ছে কী ভাবে, সেটা জানা প্রয়োজন— ব্যক্তির কারণে, না কি সমষ্টির কারণে? ‘সংরক্ষণ’ আসলে একটা রাষ্ট্রীয় প্রায়শ্চিত্ত। ক্ষতিপূরণ। কিছু জনগোষ্ঠী একটি নির্দিষ্ট পরিচিতির কারণেই দীর্ঘকাল অপর (ক্ষমতাবান) জনগোষ্ঠীর হাতে বৈষম্যের শিকার, এবং সেই কারণেই অর্থনীতির বিভিন্ন স্তরে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব স্বাভাবিকের চেয়ে কম— এই ভুলটা শুধরে দেওয়া ছাড়া সংরক্ষণের আর কোনও ভূমিকা থাকতে পারে না। ফলে, সংরক্ষণের আওতায় আসতে হলে শুধু দুর্ভাগ্যের শিকার হলেই চলবে না, সেই দুর্ভাগ্য হতে হবে সমষ্টিগত পরিচিতির কারণে। এবং, সংরক্ষণ যে পাল্টা বৈষম্য তৈরি করে— অর্থাৎ, ঐতিহাসিক ভাবে বঞ্চিতদের বাড়তি সুযোগ করে দেয় তথাকথিত উচ্চবর্ণের সুযোগ থেকে খানিকটা কেড়ে নিয়ে— ইতিহাসের কারণেই তাকে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায়ান্তর নেই। সময়ের উল্টো দিকে যে হেতু যাওয়া যায় না, অতএব যারা অন্যায় করেছিল, তাদের উত্তরসূরিদেরই প্রায়শ্চিত্তের দায় নিতে হবে। এই প্রায়শ্চিত্ত ছাড়া অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন হয় না।

তা হলে কি ঐতিহাসিক ভাবে বৈষম্যের শিকার না হলে উন্নয়নের সুযোগ পাওয়ার উপায় নেই? সেমন্তী ঘোষ লিখেছেন, দারিদ্র মোকাবিলা করার দায় সংরক্ষণের কখনও ছিল না (‘তাই বলে এমন বুদ্ধিনাশ?’ আবাপ ১১-১)। সেই দায় তা হলে কার? দায় রাষ্ট্রেরই। কোনও ঘটনার আকস্মিকতায় কারও যদি পা পিছলেও যায়, সে যাতে সামলে নিতে পারে, একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকতে না হয় তাকে, তা নিশ্চিত করার দায় রাষ্ট্রের। স্বাধীন ভারত সেই দায় নেওয়ার জন্য তৈরি হয়েছিল। যে সময় ভারতে দলিতদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা হচ্ছে, ঠিক সেই সময়েই জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, দেশের প্রতিটি শিশু যাতে উন্নতির সমান সুযোগ পায়, সবার যেন শিক্ষার সমান অধিকার থাকে, সমান পুষ্টি জোটে, তা নিশ্চিত করাই রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। কথাটাকে ভেঙে দেখলে দলিতদের পাশাপাশি অন্যদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্বের জায়গাটা স্পষ্ট হতে পারে। ধরা যাক, একটা পাঁচিল-ঘেরা জমির মধ্যে একটা বাড়ি, সেই বাড়িতে সমৃদ্ধি থাকে, উন্নয়ন থাকে। কিছু লোক আছে পাঁচিলের ভিতরে, কিছু লোক পাঁচিলেরও বাইরে। সংরক্ষণ হল পাঁচিলের গেটটুকু খোলা, যাতে বাইরের লোকরাও ভিতরে আসতে পারে। এর পর বাড়ির দরজা-জানালা খোলার কাজ। নেহরু বলেছিলেন, রাষ্ট্র সবার জন্য সে দরজাগুলো খুলবে।

তার উপায় কী? কয়েকটা উদারণ দিই। সবার জন্য শিক্ষা একটা উপায়। সবার জন্য স্বাস্থ্য আর একটা উপায়। এবং, সবাই যাতে সেই ‘সর্বজনীন শিক্ষা’ আর ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য’-ই ব্যবহার করে, তা নিশ্চিত করা। ভারতে বাজার এসে সর্বজনীন ব্যবস্থাকে নিয়ে গিয়েছে। সরকার এখনও স্কুল চালায়, হাসপাতাল চালায়। কিন্তু, চাকরির বাজারে যে শিক্ষার দাম, তা পেতে গেলে বেসরকারি স্কুলের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া উপায় নেই; আত্মসম্মান বজায় রেখে চিকিৎসা পরিষেবা পেতে পেলে কর্পোরেট হাসপাতালই গতি। গরিবের জন্য বৈষম্য সৃষ্টি করার এমন পথ আর হয় না। গত বছর এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, প্রতি বছর ভারতে সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে চলে যান শুধু চিকিৎসার খরচের ধাক্কায়। স্বাস্থ্যখাতে সরকার ব্যয়বরাদ্দ বাড়ায় প্রায় না বাড়ানোর মতোই। ভঙ্গুরতর হতে থাকে সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামো, আর মানুষ বাধ্য হন বেসরকারি হাসপাতালের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হতে।

সবার জন্য সরকারি শিক্ষা বাধ্যতামূলক হলে চিকিৎসার খরচে সর্বস্বান্ত হওয়া বা অন্য কোনও কারণে দরিদ্র হয়ে যাওয়া পরিবারের পক্ষে অন্তত একটা বৈষম্য এড়ানো সম্ভব হত। সবার সন্তানই বাধ্যতামূলক ভাবে সরকারি স্কুলে গেলে সেই স্কুলগুলোর মানেরও উন্নতি হত কি না— সেই তর্ক আলাদা। কিন্তু, চাকরির ক্ষেত্রে স্কুলের পার্থক্যের ফলে বড়লোকের ছেলের সঙ্গে গরিবের ছেলের যোগ্যতাগত ফারাক হত না। পারিবারিক অবস্থার তারতম্যের ফলে সন্তানের ‘সক্ষমতা’র মানে ফারাক তৈরি হত না। সবার জন্য দরজা খোলার এটাই তো উপায়। যেমন উপায় গণবণ্টন ব্যবস্থাকে আরও মজবুত করে তোলা। স্কুলের মিড ডে মিলে পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করা এবং ধনী-গরিব নির্বিশেষে সব বাচ্চাকে সেই খাবারের থালায় বসানো।

এগুলো উদাহরণমাত্র। কিন্তু, একটা কথা স্পষ্ট— সুযোগের সাম্য তৈরি করতে চাইলে সামাজিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের জোরদার উপস্থিতি প্রয়োজন, সেই জায়গাটা বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না। রাষ্ট্র হাজির থাকলে কোনও এক বার পা পিছলে গেলেও ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ থাকে মানুষের। বাজার সেই সুযোগ দেয় না। সেখানে এক বার পিছিয়ে পড়লে আরও পিছিয়েই যেতে হয়, ভারতের বহু লোক যে ভাবে পিছিয়ে যাচ্ছেন প্রতি দিন। নেহরুর ভারত অনেক দূরে পড়ে আছে— আমাদের দেশ জোরকদমে বাজারকে নিয়ে এসেছে সামাজিক ক্ষেত্রের প্রতিটা পরিসরে। সরকারি হাসপাতালগুলোকে ভাল করার বদলে কেন্দ্রীয় সরকার সবার জন্য বেসরকারি স্বাস্থ্যবিমার কথা বলেছে। তাতে চিকিৎসার খরচ বাড়া ছাড়া গরিবের কোনও উপকার হবে কি না, সেই প্রশ্ন করেনি। সবার জন্য সরকারি স্কুলের বদলে বেসরকারি স্কুলে অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল শ্রেণির বাচ্চাদের জন্য কোটার ব্যবস্থা করেছে। বাচ্চাগুলো সেই ব্যবস্থায় টিকে থাকতে পারবে কি না, খোঁজ নেয়নি।

বাজার নিজের ধর্ম মেনে অসাম্য বাড়িয়েছে। গরিব মানুষ প্রতি দিন পিছিয়ে পড়েছে দৌড় থেকে। তার পর, ব্যক্তি থেকে সেই গরিব একটা সমষ্টি হয়ে উঠেছে— উন্নয়নের মহাযজ্ঞ থেকে বাদ পড়ে যাওয়া মানুষের সমষ্টি। শুধু গরিব, এই কারণেই তারা বাদ পড়ে গিয়েছে বাজারের খেলা থেকে।

তার পর, স্বভাবতই, সেই গরিব দাবি করেছে সংরক্ষণের। রাজনীতি নিজের স্বার্থ বোঝে, কাজেই এই দাবিকে প্রশ্ন করেনি। বলেনি, সংরক্ষণ উত্তর নয়, দলিতদের অধিকার কেড়ে নিতে চাওয়া উত্তর নয়। উত্তর হল সবার জন্য সক্ষমতার সাম্য তৈরির পথ খুঁজে বার করা। রাষ্ট্রকে সে পথে হাঁটতে বাধ্য করা।

Government Policy BJP
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy