Advertisement
E-Paper

আয়ু, আয়, সাক্ষরতা— এ নিয়ে জনস্বাস্থ্য

অরণ্যহনন হয়েছে একটা দীর্ঘ সময় ধরে। যদিও অরণ্যকে বাঁচাতে আদিবাসীরা বারবার বিদ্রোহ করেছেন। তবে ক্ষতি রুখতে পারা যায়নি। না তাঁদের শহুরে সুযোগসুবিধা মিলেছে, না তাঁরা ফিরে যেতে পেরেছেন অরণ্যের কাছে। আলোচনায় নচিকেতা বন্দ্যোপাধ্যায়অরণ্যহনন হয়েছে একটা দীর্ঘ সময় ধরে। যদিও অরণ্যকে বাঁচাতে আদিবাসীরা বারবার বিদ্রোহ করেছেন। তবে ক্ষতি রুখতে পারা যায়নি। না তাঁদের শহুরে সুযোগসুবিধা মিলেছে, না তাঁরা ফিরে যেতে পেরেছেন অরণ্যের কাছে।

শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৯ ০১:১৪
কুষ্ঠরোগীরা। ফাইল চিত্র

কুষ্ঠরোগীরা। ফাইল চিত্র

বড়দিনের সন্ধ্যায় জি ই চার্চে উৎসব। চার্চে ঢুকতেই মনে পড়ল উফ্‌ম্যান সাহেবের কথা। এক সময় এই চার্চের কাছেই ছিল উফ্‌ম্যান সাহেবের কুষ্ঠ আশ্রম। খ্রিস্টান মিশনারিরা মানভূম তথা পুরুলিয়াতেও নিয়ে এসেছিলেন ইউরোপীয় চিকিৎসা পদ্ধতি। সেই ১৮৯১ সালে। এর সাড়ে তিন দশক পরে পুরুলিয়া জেলায় প্রথম গড়ে ওঠে সাবেক সদরের হাসপাতাল।

পুরুলিয়া জেলায় বর্তমানে কুষ্ঠরোগের প্রাদুর্ভাবের হার ১০ হাজার জন প্রতি ২.৪১। নতুন করে কুষ্ঠ রোগের আক্রান্ত হওয়া ব্যক্তির সংখ্যা সহস্রাধিক। জাতীয় কুষ্ঠ দূরীকরণ কর্মসূচি নিজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নিয়েই চলছে। সেই কাজের নির্দিষ্ট কৌশল রয়েছে। রোগ দূরীকরণের জন্য ‘ক্যাপাসিটি বিল্ডিং’, ‘সেন্সিটাইজেসন’, রোগ সম্পর্কে জনমানসে সচেতনতা বৃদ্ধি, রোগীর সেবা-শুশ্রূষা ও তাঁকে পর্যবেক্ষণ করা তো রয়েছেই। যত দূর জানি, পশ্চিমবঙ্গের যে আটটি জেলায় এখনও কুষ্ঠরোগের প্রাদুর্ভাব রয়েছে, পুরুলিয়া তাদের অন্যতম।

পুরুলিয়ার মানভূম অঞ্চল অনেকটাই কৃষিনির্ভর। তবে এই এলাকা সংলগ্ন কয়লা খনি অঞ্চলে শহরকেন্দ্রিক সমস্যা শুরু হয়েছে সেই কোন কাল থেকে। অপ্রতুল বাসস্থান, পরিস্রুত পানীয় জলের অভাব রয়েছেই। এলাকার মানব সম্পদ অর্থাৎ, শ্রমিকদের বঞ্চনার ঘটনা ঘটেছে দিনের পর দিন। অন্য দিকে, ছোটনাগপুরের মালভূমি অঞ্চল খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ তো বটেই, অরণ্য কিন্তু তার একান্ত নিজস্ব এবং প্রাচীন সম্পদ। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়া শিল্পায়ন ও রেলপথের প্রকল্পে জন্য সেই সমৃদ্ধ অঞ্চলেরই অরণ্যহনন হয়েছে একটা দীর্ঘ সময় ধরে। যদিও এই অরণ্যভূমিকে বাঁচাতে, তাকে সংরক্ষণ করতে ছোটনাগপুরের আদিবাসীরা বারবার বিদ্রোহ করেছেন। তবে ক্ষতি খুব একটা রুখতে পারা যায়নি।

সব মিলিয়ে এই পরিস্থিতি দরিদ্র মানুষদের আরও দরিদ্র করেছে। না তাঁদের যথার্থ শহুরে সুযোগসুবিধা মিলেছে, না তাঁরা ফিরে যেতে পেরেছেন অরণ্যের কাছে। এই দারিদ্র, অর্থাভাব ডেকে এনেছে অপুষ্টি। আর অপুষ্ট দেহ আধার হয়েছে শুধু কুষ্ঠ নয়, কলেরা, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মার মতো অসুখের। নিরন্তর শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। প্রসূতি মৃত্যু, অপুষ্টি ও সংক্রামক রোগে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি এমন নয়।

সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন রূপে জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণের ধারণার উন্মেষ হয়েছিল উনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপে। তাদের মৌলিক সমস্যাগুলো ছিল দারিদ্র, শিশুশ্রম, অপুষ্টি, আবাসন, স্বাস্থ্যবিধি প্রভৃতি। জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণ করতে গেলে কয়েকটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। যেমন, পানীয় জল, বাসস্থান, নির্বিষ পুষ্টিকর খাদ্য। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে পশ্চিমি স্বাস্থ্যনীতি এবং চিকিৎসা শুরু হয় সে দেশের সেনাবাহিনী ও ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর জন্য। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ধীরে ধীরে এ জেলাতে গড়ে ওঠে স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রের পরিকাঠামো।

জেলার হাসপাতালগুলি নিরন্তর পরিষেবা দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে। তবে সংক্রামক রোগ ও ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি বা জলবাহিত রোগ যেমন টাইফয়েড বা আন্ত্রিক নিয়ম করে হানা দেয় এ জেলার মানুষের শরীরে। ম্যালেরিয়া রোগের সংক্রমণকে অনেকটাই আয়ত্তে আনা গিয়েছে। যক্ষ্মা নিরাময়ের চেষ্টায় ডটকেন্দ্রের কর্মসূচিও যথেষ্ট সফল। ফাইলেরিয়ার ‘মাস ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ কার্যকর হয়েছে। জনমানসে প্রচার পেয়েছে। এগুলি নিঃসন্দেহে সরকারি তৎপরতার নিদর্শন।

প্রকৃতপক্ষে জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণের বিষয়টি নির্দিষ্ট কোনও ব্যক্তি অপেক্ষা সমষ্টি বা সম্প্রদায়ের সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানসিক ও দৈহিক স্বাস্থ্যের উপরেই বেশি নির্ভরশীল। আবাসন, আয়, অর্থনৈতিক সামর্থ্য, লিঙ্গসাম্য, পরিবেশ, চেতনা ইত্যাদি জনস্বাস্থ্যের নির্ধারক বিষয়। এগুলির পারস্পরিক সাযুজ্য নিয়ন্ত্রণই বোধ হয় জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জনস্বাস্থ্যের সর্বব্যাপী প্রভাব রয়েছে মানবগোষ্ঠীর সামগ্রিক জীবনযাপনে।

আবার শুধু কোনও ব্যক্তির রোজগার সামগ্রিক ভাবে জনস্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রণ করে না। জীবনের উৎকর্ষ বৃদ্ধি করতে শিক্ষার অবশ্যই একটা ভূমিকা আছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং রোজগার প্রভৃতি মিলিয়ে জীবনযাপনের হাল হকিকত সম্পর্কে ধারণা করা যায়। বিগত ‘সেনসাস রিপোর্ট’ অবশ্য এক আশঙ্কার কথা জানিয়েছে। এ জেলার সাক্ষরতার হার যথেষ্ট লজ্জার কারণ। আশা রাখি, পরবর্তী (২০২১) সুমারিতে তা ঊর্ধ্বমুখী হবে। ২০১১ ‘সেনসাস রিপোর্ট’ অনুযায়ী, সামগ্রিক ভাবে পুরুলিয়া জেলার সাক্ষরতার হার ৬৪.৪৮ শতাংশ। তার মধ্যে ৭৭.৮৬ শতাংশ পুরুষ এবং ৫০.৫২ শতাংশ স্ত্রী। গ্রামীণ ক্ষেত্রে মেয়েদের সাক্ষরতা ৪৮ শতাংশ ও ছেলেদের ৬৭.১৫ শতাংশ। কৃষিনির্ভর জেলায় নারীই সমাজের অন্যতম স্তম্ভ। সে কৃষিক্ষেত্রেই হোক বা গৃহস্থালির কাজে। সই কারণে এখনই গ্রামীণ নারীশিক্ষার বিবর্তন প্রয়োজন।

শিক্ষালয় এখন পর্যাপ্ত। অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্প, স্বনির্ভর দল দল এবং কন্যাশ্রী প্রকল্প স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক ও শিক্ষা প্রকল্পে নিয়োজিত। সামাজিক ক্ষেত্রটিকেও জেলার মেয়েরা চিনে নিতে শুরু করেছেন। বাল্যবিবাহ রুখে দিয়ে বীণা কালিন্দি, সুনিতা মাহাতো, সঙ্গীতা বাউরি প্রমুখ এক সামাজিক আন্দোলনের আদর্শ। সমগ্র দেশের বালিকাদের ‘রোল মডেল’।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং রোজগার— এই তিন শর্ত জনস্বাস্থ্যকে সামগ্রিক বলীয়ান করে। তাই এদের প্রতিটিকে পৃথক-পৃথক ভাবে বলীয়ান করা অবশ্য কাম্য।

লেখক সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার

Health Leprosy Purulia
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy