Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

দূষণ

কথাটি সর্বার্থে সত্য। কলিকাতার রাস্তায় পা রাখিলে বুঝা যায় শহরটি এক ভয়ঙ্কর শব্দপ্রাবল্যে ভুগিতেছে। নিঃশব্দ অঞ্চল কলিকাতা হইতে প্রায় অন্তর্হিত। হাসপাতাল, স্কুল-কলেজের সামনে অবাধে চলিতেছে মাইকের দাপট।

—ফাইল চিত্র

—ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০১৯ ০০:১৭
Share: Save:

অর্থনীতিতে নোবেল পাইলেন কৃতী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। আর শব্দতাণ্ডবে প্রাণ ওষ্ঠাগত হইল কলিকাতার কসবার বাসিন্দাদের। না, সমাপতন ভাবিলে চলিবে না। দুইয়ের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক। কসবার শব্দতাণ্ডব অভিজিৎবাবুর নোবেলপ্রাপ্তিকে উপলক্ষ করিয়াই। বিসর্জন, জলসা, চড়ুইভাতি-সহ যে সকল কারণে মহানগর ডিজে-র দাপটে কাঁপিতে অভ্যস্ত তাহার মধ্যে সাম্প্রতিকতম সংযোজনটি নোবেল। এমন নহে যে, এই বৎসর অর্থনীতির নোবেলটি শেষ পর্যন্ত এক বাঙালির হাতে যাইবে কি না, তাহা দেখিবার জন্য বাঙালি প্রহর গনিতেছিল। কিন্তু একে উৎসবের মাস, দুর্গাপূজার বিসর্জনবাদ্যের রেশ এখনও মিলায় নাই, তাহার উপর এ-হেন অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তি। রবীন্দ্রনাথ, অমর্ত্য সেনের নোবেলপ্রাপ্তির সময় ডিজে বক্স এই রূপে রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হয় নাই। উল্লাস প্রদর্শনের সুবর্ণসুযোগ হাতছাড়া হইয়াছে। আর সেই ভুল হইবার নহে। সুতরাং, অভিজিৎবাবুর নোবেলপ্রাপ্তিকে কেন্দ্র করিয়া শহরের একাংশ জানাইয়া দিল, কলিকাতা স-শব্দে বিরাজমান।

কথাটি সর্বার্থে সত্য। কলিকাতার রাস্তায় পা রাখিলে বুঝা যায় শহরটি এক ভয়ঙ্কর শব্দপ্রাবল্যে ভুগিতেছে। নিঃশব্দ অঞ্চল কলিকাতা হইতে প্রায় অন্তর্হিত। হাসপাতাল, স্কুল-কলেজের সামনে অবাধে চলিতেছে মাইকের দাপট। পরিবেশবিদদের সতর্কবাণী সত্ত্বেও গাড়ির হর্নের আওয়াজে লাগাম পরানো যায় নাই। শব্দের অত্যাচার কালীপূজা, নববর্ষের গণ্ডি অতিক্রম করিয়াছে বহু দিন। সম্প্রতি মনসা পূজা, ঘেঁটু পূজা হইতে আরম্ভ করিয়া লক্ষ্মীপূজার ভাসানেও তাহার দরাজ হস্তটি বাড়াইয়াছে। কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার ভাসানে ডিজে বক্স বাজিলে চঞ্চলা লক্ষ্মী আর বঙ্গ অর্থনীতিতে স্থিত হইবেন কী উপায়ে! কালীপূজা, নববর্ষে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে কিছু পুলিশি নজরদারি থাকে। কিন্তু অন্যান্য অ-প্রচলিত প্রমোদে শব্দের তাণ্ডব রুখিবার কোনও উদ্যোগ নাই।

সঙ্গে তাহারা আরও একটি বিষয় নিশ্চিত করিয়াছে। নিজ অস্তিত্বকে সাড়ম্বরে জানান দেওয়া। বস্তুত, এই নবলব্ধ প্রবণতা শব্দদূষণের মতোই ক্ষতিকারক। এবং এই প্রবণতাকে সযত্নে লালন করিতেছে সোশ্যাল মিডিয়া, আত্মপ্রচারের সার্থক মঞ্চরূপে। সম্প্রতি ‘ভাইরাল’ হওয়া একটি পোস্ট-এ যেমন বাঙালিদের কাছে কিছু প্রশ্ন রাখা হইয়াছে— আপনি কি নোবেলজয়ী ডক্টর অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কখনও একত্রে চা বা কফি পান করিয়াছিলেন? আপনি কি একত্রে একই দোকান হইতে চারমিনার কিনিতেন? বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে ক্ষীণতম সংযোগসূত্রটি তুলিয়া নিজেকে প্রচারবৃত্তের মধ্যে স্থাপন করিবার বাঙালি বাসনা অপ্রতিরোধ্য। বড় মানুষের প্রদর্শিত পথে নিজেকে চালিত করা নহে, তাঁহার সঙ্গে যে কোনও প্রকার বাহ্যিক সংযোগ দেখাইয়া রাতারাতি বাহবা কুড়াইবার তাগিদটিই বাঙালির কাছে প্রবল। কারণ স্পষ্ট। প্রথম পথটি কঠিন, তাহাতে নিজেকে আমূল সংস্কারের প্রয়োজন পড়িতে পারে। দ্বিতীয় পথটি সংক্ষিপ্ত, তাহাতে পরিশ্রম নাই, সামান্য শব্দব্যয় বা অর্থব্যয়ই যথেষ্ট। প্রকৃতপক্ষে, এই দ্বিতীয় পথটির অস্তিত্বই খানিকটা শব্দবাজির ন্যায়। সশব্দে ফাটিয়া সকলকে চমকাইতে পারে, কিন্তু অবশেষ কিছুই থাকে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE