শিশুশ্রমের কুফল সম্পর্কে লাগাতার প্রচার চলছে উত্তর দিনাজপুরের বিভিন্ন গ্রামে।
এটা সব সময়ই মনে করা হয় যে, শিক্ষাই শিশুশ্রমিকদের সংখ্যা কমানোর উপযুক্ত উপায়। উত্তর দিনাজপুরের বিস্তৃতিতে সরকারি বিদ্যালয়ের সংখ্যা নেহাৎ কিছু কম নয়। ঘটনা হল, কাজ করতে করতে, সংসারের জন্য উপার্জন করতে করতেও উত্তর দিনাজপুরের বিভিন্ন গ্রাম ও শহরের বেশ কিছু সংখ্যক শিশুশ্রমিক ক্রমশ বিদ্যালয়মুখী।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ আর ইসলামপুরের মতো শহরের পরিচিত কিছু বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। অনাথ, অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার জন্য তাদের বাসস্থানের বন্দোবস্ত করে, দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের সংস্থান সুনিশ্চিত করে, পড়াশোনা করার সুযোগ করে দিয়ে তাদের শিশুশ্রমিক হওয়ার প্রবল সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে চলেছে। উত্তর দিনাজপুরের বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে শিশুশ্রমের কুফল সম্পর্কে লাগাতার প্রচার চালিয়ে এবং আলোচনা সভার আয়োজন করে, গ্রামবাসীর সঙ্গে বারংবার এ বিষয়ে কথা বলে তাঁদের সচেতন করে তোলার কাজ পুরোদমে চলছে।
দারিদ্র শিশুশ্রমিকের সংখ্যাবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ হওয়ায় এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির প্রয়াসে উত্তর দিনাজপুর জেলা জুড়ে নিম্নবিত্ত ও গরিব মানুষদের নিয়ে গড়ে উঠেছে বহু স্বনির্ভর গোষ্ঠী। এর মাধ্যমে পুরুষ-মহিলা বিভিন্ন ধরনের কাজের প্রশিক্ষণ নিয়ে, তাকে কাজে লাগিয়ে রোজগার করছেন এবং পরিবারের আয় বাড়াতে সহায়ক হচ্ছেন। রাজ্য সরকারি সংস্থাগুলোর পাশাপাশি উত্তর দিনাজপুরের বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি দারিদ্রের বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রামে নেমেছে। শিশুশ্রমিকের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার এটাও একটা অন্যতম কারণ।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ১২ জুনকে শিশুশ্রম বিরোধী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। শিশুশ্রম ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজের বিরোধিতা করে শিশুদের স্বাভাবিক জীবন ও শৈশবকে ফিরিয়ে আনতে, তাদের প্রাথমিক চাহিদা পূরণার্থে ও তাদের অধিকার রক্ষার্থে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। অন্যান্য জেলাগুলির মতো উত্তর দিনাজপুরেও দিনটিকে ঘিরে শিশুশ্রম-বিরোধী জনসমাবেশ, ট্যাবলো প্রদর্শন, বিভিন্ন সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রভৃতির আয়োজন করা হয়। কিন্তু এই প্রচেষ্টাকে বছরের একটু মাত্র দিনে সীমাবদ্ধ করে রাখলে তা দিয়ে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের অন্তরাত্মাকে স্পর্শ করা সম্ভব নয়। উত্তর দিনাজপুরের অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েরা, যারা দিনমজুরি করার চাপে, বাড়ি বাড়ি ‘কাজের লোক’ হিসেবে কর্মরত হয়ে প্রতিনিয়ত তাদের শৈশব হারিয়ে চলছে, তারাই ঐকান্তিক ভাবে চাইছে, এই সব প্রচেষ্টা বছরভর চালানো হোক। তারা যে হঠাৎ করে বড় হয়ে গিয়েছে! না বুঝতে চাইলেও বুঝতেই হচ্ছে তাদের কাজের কথা, কষ্টের কথা। উত্তর দিনাজপুরের নানান শহরের আঞ্চলিক চাইল্ডলাইনও শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। এরই পাশাপাশি প্রয়োজন সামাজিক এই কর্মসূচিতে সব স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ।
উত্তর দিনাজপুরে শিশুশ্রমকে সমূলে উৎপাটন করতে এগিয়ে এসেছে ‘ন্যাশনাল চাইল্ড লেবার প্রজেক্ট’ও। এনসিএলপি’র সহায়তায় পশ্চিমবঙ্গে শুধু শিশুশ্রমিকদের উন্নতিসাধনের জন্যই ৯২৪টি বিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়েছে, যে পরিকল্পনার মধ্যে উত্তর দিনাজপুরও আছে। বছরসাতেক আগে উত্তর দিনাজপুরের করণদিঘি সমষ্টিতে সবচেয়ে বেশি শিশুশ্রমিক ছিল আর সবচেয়ে কম শিশুশ্রমিক ছিল হেমতাবাদ সমষ্টিতে। জনবিশ্লেষকদের মতে, এই দ্বিতীয় সমষ্টিটি লেখাপড়ার দিক থেকে সর্বাধিক উন্নত।
সুতরাং, বোঝাই যাচ্ছে যে, শিক্ষাই শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মূল হাতিয়ার, একমাত্র পড়াশোনাই শিশুকে ফিরিয়ে দিতে পারে তার হারানো শৈশব। প্রশাসনিক প্রয়াসে উত্তর দিনাজপুরে শিশুদের (যাদের মধ্যে শিশুশ্রমিকেরাও আছে) যৌননিগ্রহের হারও এখন উল্লেখজনক ভাবে হ্রাস পেয়েছে। এ সব কারণে মনে করা যেতেই পারে যে, ক্রমশ আলোর পথেই এগিয়ে চলেছে একদা অন্ধকারে ডুবে থাকা উত্তর দিনাজপুরের শিশুশ্রমিকরা।
(লেখক রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের গবেষক। মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy