Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

সাঁওতাল সমাজের সেরা পরব সরহায়

লাল মাটির দেশে শাল-পিয়াল ঘেরা আদিবাসী গ্রামগুলিতে এখন সরহায় বা বাঁদনা উৎসবের প্রস্তুতি তুঙ্গে। পাঁচ দিনের পরবের প্রথম দিনটি হল ‘উম’ অর্থাৎ শুভ সূচনা। পরবের দ্বিতীয় দিন ‘হাপড়াম’ স্বর্গীয় গুরুজনের স্মরণে। তৃতীয় দিন বা ‘খুন্টৌ’ অর্থাৎ গৃহপালিত পশুদের উদ্দেশে আশীর্বাদমূলক মন্ত্র বা গান। পরের দিনটা হল, ‘জালি’। ধামসা ও মাদলের সহযোগে নাচ ও গানে প্রত্যেকে মেতে ওঠেন৷ লিখছেন সন্ন্যাসী লোহার।অর্থাৎ, একটা মুরগিকে ধরে আছেন, পুজো দেওয়ার জন্য। তার অপেক্ষায় অন্যেরা পাশে বসে আছেন একটা গাছতলায়।

শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০১৯ ০১:৪৭
Share: Save:

নীচের ছবি দু’টির দিকে লক্ষ করুন। দেওয়ালে মাটি দিয়ে কিছু দেওয়াল ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে। কয়েক জন মানুষ মাদল আর নাগরা বাজাচ্ছে। সঙ্গে রাখাল বালকেরা দলবদ্ধ গরুগুলিকে একপ্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, সামনে একটা ডিমকে লক্ষ করে। তার পাশেই কয়েক জন বয়স্ক মানুষ গভীর আগ্রহে কিছু করছেন। অর্থাৎ, একটা মুরগিকে ধরে আছেন, পুজো দেওয়ার জন্য। তার অপেক্ষায় অন্যেরা পাশে বসে আছেন একটা গাছতলায়। কয়েকটা মাটির হাঁড়ি, সেগুলিতে আসলে রাখা আছে পাত্রপূর্ণ হাঁড়িয়া বা মদ। আসলে এই দৃশ্যটিতে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের খুব গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসবকে উপস্থাপন করা হয়েছে।

সরহায়

সাঁওতাল সমাজের বিভিন্ন আনন্দ উৎসবের মধ্যে সরহায় বা বাঁদনা হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ পরব। ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে বসবাসকারী সাঁওতাল সমাজের মানুষেজন এই বাঁদনা পরব ভক্তিভরে উদ্‌যাপন করেন। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, হুগলি, পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অংশে এমনকি, ওড়িশায় বসবাসকারী সাঁওতাল সমাজের মানুষ এই উৎসব বা পরবটি প্রতি বছর পালন করে আসছেন কার্তিক মাসের কালী পুজার সময়। অন্য দিকে বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, অসম এবং ত্রিপুরায় একই পরবের শুভ সূচনা হয় পৌষ সংক্রান্তি বা পৌষ পার্বণের ঠিক পাঁচ দিন আগে। বাংলাদেশে থাকা সাঁওতাল সমাজের মানুষও একই ভাবে এই পরব উদ্‌যাপন করেন। সাঁওতালেরা প্রকৃতি প্রেমী, কঠোর পরিশ্রমী। এই সমাজের বিশ্বাস, প্রকৃতিই জীবন। তাই প্রকৃতির সব বস্তুই ভগবান।

সেই জন্য, পাঁচ দিন ব্যাপী এই বাঁদনা উৎসবটি পালিত হয় ভারতবর্ষ জুড়ে বিভিন্ন প্রান্তে প্রকৃতির খোলা হাওয়ায়। তার পরে গ্রামের পরিবারে। নির্ধারিত পৌষ মাসের প্রথম সপ্তাহে বা পরে বিভিন্ন গ্রামে মোড়ল গোষ্ঠী নিজেদের গ্রামে সেই পবিত্র দিনগুলি বাছাই করে নেন। এই উৎসব বা পরবটির মূল উদ্দেশ্য, সাঁওতাল সমাজের বিভিন্ন দেবতাদের (বঙ্গাদের) স্মরনার্থে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা। প্রকৃতিতে বিরাজমান ঈশ্বরকে নানা উৎসর্গ দানে পরিতৃপ্ত করা মানে, নিজেদের পরিবারে সুখ ও শান্তি বজায় রাখা।

লাল মাটির দেশে শাল-পিয়াল ঘেরা আদিবাসী গ্রামগুলিতে এখন সরহায় উৎসবের প্রস্তুতি তুঙ্গে। পাঁচ দিনের পরবে প্রথম দিনটি হল ‘উম’ অর্থাৎ শুভ সূচনা। ‘নাইকে’ বা পুরোহিত এবং ‘কুডৌমনাইকে’ অর্থাৎ সহকারী পুরোহিত— এই দু’জনের উপরে প্রথম পাঠের যাবতীয় দায়িত্ব থাকে। তা ছাড়া অন্যান্য দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা আত মেঞ্জিহি (গ্রাম সর্দার), জকমেঞ্জিহি (সহকারী সর্দার), গুডিৎ (আহ্বায়ক) এবং সঙ্গীসাথীরাও থাকেন। গ্রামের লোকজনও থাকেন। অর্থাৎ বছরের শেষে আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ ও কুশল বিনিময়ের এটাই বড় সুযোগ। শুধু তাই নয়, গ্রামের পরিবারের গৃহপালিত পশুরাও পায় সম্মান ও অধিকার। প্রথম দিন নাইকে অর্থাৎ পুরোহিত নিয়ম নীতি মেনে প্রকৃতির সমস্ত দেবতাকে তুষ্ট করানোর জন্য রওনা হন ‘গড়টেন্ডি’ অর্থাৎ ময়দানে, ভূমি দেবতা যেখানে থাকেন। নতুন কুলোর সাজে থাকে ধান ‘উখৌড়’-এ তৈরি আতপ চাল, সিঁদুর, শালপাতার ঠোলাই, কিছু মুরগির ছানা, একটা ধারাল ‘কেপি’ (বগি), প্রতিটি পরিবার থেকে দেওয়া অল্প চাল এবং চাল বাখরে মিশ্রিত তৈরি পবিত্র ‘হেন্ডি’ (হাঁড়িয়া)। দেবতার উদ্দেশে দ্রব্যগুলি উৎসর্গ করা হয়। মাঠে সামান্য একহাত বিশিষ্ট জায়গায় ঘাস পরিষ্কার করে নাইকে পুজোর মণ্ডপ তৈরি করেন। সেই মণ্ডপটিকে বলা হয় ‘খটঁ’। সেখানেই মুরগি ছানা বলি দেওয়া রক্তের ফোঁটা মণ্ডপে দিয়ে, আতপ চাল সিঁদুর দিয়ে প্রাথমিক ভাবে ভূমি দেবতা-সহ অন্য দেবতাদের ভক্তিভরে আমন্ত্রণ জনানো হয়। উৎসর্গিত দ্রব্যাদি দিয়ে মাটির হাঁড়িতে রান্না হয় সেই দিনের মহা প্রসাদ (সুড়ৌ)। এই প্রসাদ বিতরণ হয় নরনায়ায়ণের সেবায়। একই সময় পবিত্র ‘হেন্ডি চডর’ (হাঁড়িয়ার ফোঁটা) দেওয়া হয় শুষ্ক তৃষ্ণার্ত মাটিতে। যে মাটি বিশ্বের মানব জাতিকে

দিয়েছে আশ্রয়।

পড়ন্ত বেলায় গ্রামের সব গরুকে এক সঙ্গে খঁটের (মণ্ডপ) দিকে দেবতাদের স্পর্শ নেওয়ার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। শেষে গড়টেন্ডি থেকে মোড়ল গোষ্ঠী আর গ্রামবাসী মাদল ও নাগরা বাজিয়ে উৎসবে মেতে ওঠেন। তার পর থেকে গ্রামে গ্রামে প্রতিটি সাঁওতাল ঘরে যুবক যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা সারাসারা রাত ধরে চলে মাছ, মাংস খাওয়া ইত্যাদি। চলে নাচ-গান। মাদলের শব্দে জমজমাট হয়ে ওঠে আখড়া। পরবের দ্বিতীয় দিন ‘হাপড়াম’ স্বর্গীয় গুরুজনের স্মরণে। তৃতীয় দিন বা ‘খুন্টৌ’ অর্থাৎ গৃহপালিত পশুদের উদ্দেশে আশীর্বাদমূলক মন্ত্র বা গান। এই দিনে বাড়ির গৃহপালিত পশুর বন্দনা করা হয়ে থাকে৷ পরের দিনটা হল, ‘জালি’। এই দিনে গ্রামের পুরুষ ও মহিলারা এক সঙ্গে প্রত্যেকের বাড়িতে হাজির হন৷ সেখানে চলে খাওয়াদাওয়া এবং ধামসা ও মাদলের সহযোগে নাচ ও গানে প্রত্যেকে মেতে ওঠেন৷

সাঁকরাত

সরহায় পরবের শেষ অংশ হল সাঁকরাত। এটা বিরবঙ্গা অর্থাৎ বনদেবতার উদ্দেশে পুজো। পুজো ও উৎসব মানেই কয়েকদিন ব্যাপী আনন্দ, নাচ-গান, হইচই। তার পর শরীরে আসে ক্লান্তি, জড়তা। মনের একাগ্রতা ফিরিয়ে আনার জন্য গ্রামের পুরুষেরা মিলিত হয়ে সেই দিন বনে যাওয়া হয় শিকার করতে। বিষয়টি খুব সাধারণ হলেও এর ধর্মীয় গুরুত্ব অনেকখানি। প্রচলিত অর্থে বিরবঙ্গা ভক্তজনের মায়া ছেড়ে বনে ফিরে যেতে রাজি নন। কিন্তু বিধাতার নিয়ম, বনের দেবতাকে বনেই থাকতে হবে। তাই গ্রামের যুবক ও পুরুষরা মিলিত হয়ে কৌশলে ভুলিয়ে ভালিয়ে খেলতে যাওয়া অথবা শিকারে যাওয়ার ছলে বনে যান বিরবঙ্গাকে রেখে আসার জন্য। শিকার সাঙ্গ হলে গ্রামের এক স্থানে কলাগাছ পুঁতে সেখানে তেলের পিঠে রেখে চলে কলাগাছকে নিশানা করে তিরবিদ্ধ করার কাজ৷ দিনের শেষে শিকার করা মাংস রান্না করে খাওয়াদাওয়ার মধ্য দিয়ে সহরায় পরবের পরিসমাপ্তি ঘটে৷

বর্তমান সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সংস্কৃতিও পরিবর্তিত হচ্ছে। আদিবাসী সাঁওতাল সমাজে ঐতিহ্যগুলি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে, এটাই আক্ষেপের।

লেখক শিক্ষক ও চিত্রশিল্পী (মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Events Festival Tribal Festival Tribes Sarhay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE