Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
রামমন্দির থেকে লাদাখ: বিহারের ভোটে এই প্রচারই শোনা গেল
Bihar Election 2020

আত্মনির্ভর, না মোদীনির্ভর?

বিজেপি নেতারা প্রায়ই বিভিন্ন সমীক্ষা তুলে ধরে দাবি করেন, দেশ জুড়ে মোদীর জনপ্রিয়তা এখনও অটুট।

অনুপস্থিত: প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মঞ্চে থাকলেও পিছনের ছবিতে নেই এনডিএ জোটের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী নীতীশ কুমার। বিহার, ২৩ অক্টোবর। পিটিআই

অনুপস্থিত: প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মঞ্চে থাকলেও পিছনের ছবিতে নেই এনডিএ জোটের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী নীতীশ কুমার। বিহার, ২৩ অক্টোবর। পিটিআই

প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০২০ ০১:২৭
Share: Save:

কালো চামড়ার ব্যান্ডের ঘড়িটা সে দিনও উল্টো করেই বাঁ হাতের কব্জিতে বাঁধা ছিল। বিহারের আরায় জনসভার মঞ্চ থেকে বাঁ হাতে টেবিল চাপড়ে নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, ‘‘এখান থেকেই বিহারের প্যাকেজ ঘোষণা করে দিচ্ছি।’’ গর্জে উঠেছিল জনতা। মোদী প্রায় নিলামের দর হাঁকতে শুরু করেছিলেন। ‘৫০ হাজারের করব না তার বেশি?’ ‘৬০ হাজার না তার বেশি?’ ‘৭৫ হাজার না তারও বেশি?’ দর বাড়ছিল। জনতার গর্জনও তুঙ্গে উঠছিল। শেষ পর্যন্ত সওয়া এক লক্ষ কোটি টাকার বিহার প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী।

সেটা ছিল ২০১৫-র বিহার বিধানসভা নির্বাচন। তার এক বছর আগেই দেশ জুড়ে মোদী-ঝড় তুলে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তিনি। গুজরাত থেকে দিল্লি হয়ে তাঁর অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটতে শুরু করেছে। কিন্তু না। সওয়া এক লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করেও মোদী পটনায় পট-পরিবর্তন করতে পারেননি। নীতীশ-লালুপ্রসাদ জোটের কাছে মোদীর বিজেপিকে হার মানতে হয়েছিল। নীতীশই ফের মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসেছিলেন।

এ বার নরেন্দ্র মোদী ও নীতীশ কুমারের জুটি বিহারের ময়দানে। এবং সেই জোটকে ফের গদিতে ফেরানোর চ্যালেঞ্জ মোদীরই কাঁধে। না কি তাঁর নিজের রাজনৈতিক জাদুকাঠির কার্যকারিতা প্রমাণই আসল চ্যালেঞ্জ? রাজনীতির হাওয়া জানান দিচ্ছে, বিহারের ভোট যতখানি নীতীশ কুমারের পরীক্ষা, যতখানি তেজস্বী যাদবের নিজেকে প্রমাণের পরীক্ষা, ঠিক ততখানিই নরেন্দ্র মোদীরও পরীক্ষা। লোকসভা ভোটে স্পষ্ট, জাতীয় রাজনীতিতে মোদী এখনও অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু সেই মোদী-ম্যাজিক রাজ্য রাজনীতিতে খাটছে না। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের পরে পরেই দিল্লি, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড, হরিয়ানায় বিধানসভা ভোটে বিজেপিকে হোঁচট খেতে হয়েছে। এখানেই নরেন্দ্র মোদীর আসল চ্যালেঞ্জ। কারণ, বিজেপি ফের তাঁর কাঁধে ভর করেই বিহারের বৈতরণি পার হতে চাইছে। শুধু বিজেপি নয়, একদা নরেন্দ্র মোদীর জন্যই এনডিএ ত্যাগ করা নীতীশ কুমার নিজেও।

কোভিড অতিমারির মধ্যে প্রথম নির্বাচন হচ্ছে বিহারে। এখনও পর্যন্ত একটি ইঙ্গিত স্পষ্ট। মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার সরকারের বিরুদ্ধে কালের নিয়মে মানুষের মধ্যে অভাব, অভিযোগ, ক্ষোভ জমা হয়েছে। মাঝের এক বছর বাদ দিলে ২০০৫ থেকে নীতীশ মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে। এত দিন যে কোনও সরকার ক্ষমতায় থাকলে তার বিরুদ্ধে মানুষের মনে ক্ষোভ জন্মাবেই। টানা তিন বার নীতীশ ভোটে জিতে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। চতুর্থ বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে ফেরার পরীক্ষায় বহু দুঁদে রাজনীতিকই ব্যর্থ হন। বিহারে লালুপ্রসাদ-রাবড়ী দেবীও ব্যর্থ হয়েছিলেন। লালুপ্রসাদ-পুত্র তেজস্বী যাদব সেই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়েই তাঁর নীতীশ চাচাকে ধরাশায়ী করতে চাইছেন।

এখানেই নরেন্দ্র মোদী ‘ভরসা’। ষষ্ঠীর দিন বিজেপির ইস্তাহার প্রকাশ হয়েছে। তাতে শুধুই মোদী। নীতীশ নিরুদ্দেশ। বিহার জুড়ে বিজেপির গেরুয়া রঙের ব্যানারে শুধুই মোদীর হাসি মুখ— ‘ভরোসা উসি পর, জিসনে ঘর ঘর বিজলি পঁহুছাই, ওহি রোজগার নয়া দিলায়েগা’, ‘ওহি কিসানো কা আয় দুগনি করায়েগা’। বার্তা স্পষ্ট। নীতীশের উপরে ভরসা হারিয়েছেন? নরেন্দ্র মোদীকে ভরসা করুন। নীতীশের ‘সুশাসন’-এ ভরসা না থাকলে মোদীর ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর জন্য ভোট দিন।

কিন্তু তাতে কি কাজ হবে? ২০১৫-র নভেম্বর থেকে ২০২০-র ফেব্রুয়ারি— ১৮টি বড় ও রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে বিধানসভা ভোট হয়েছে। এর মধ্যে উত্তরপ্রদেশ ও গুজরাত বাদে ১৬টিতেই বিজেপি হেরেছে। হরিয়ানার হারের পরেও বিজেপি অন্য দলের সঙ্গে জোট করে সরকার গড়েছে। ২০১৫-য় বিহারে নীতীশ-লালুর কাছে হেরে যাওয়ার দু’বছর পরে নীতীশ ফের বিজেপির হাত ধরেন। সেই সুবাদে বিজেপি বিহারে ক্ষমতার ভাগ পায়। কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশে বিরোধী আসন থেকে শাসক দলের বিধায়ক ভাঙিয়ে বিজেপি ফের গদিতে ফিরেছে। তাতে রাজ্যগুলোর ভোটে বিজেপির হারের ট্র্যাক-রেকর্ড বদলায় না।

এমন নয় যে মোদী একার হাতে খেলা ঘোরাতে পারেন না। ২০১৭-র গুজরাত ভোট তার সব থেকে বড় নমুনা। জিএসটি নিয়ে ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ, পাতিদার আন্দোলন, গরিব চাষি থেকে আদিবাসীদের অভিযোগকে হাতিয়ার করে রাহুল গাঁধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস যখন প্রথম সাফল্যের আলো দেখতে পাচ্ছে, তখন মোদী প্রায় একার হাতে জয় ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু মোদীর সেই জাদুকাঠি বিধানসভা ভোটে তেমন খেল দেখাতে পারেনি। লোকসভা ভোটে বিপুল জয়ের পরেও ২০১৯-এর ঝাড়খণ্ডে বিজেপি ক্ষমতা হারিয়েছে। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে দিল্লিতে নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে বিজেপিকে। মহারাষ্ট্রে বিজেপি বৃহত্তম দল হিসেবে উঠে এলেও সরকার গড়তে পারেনি।

প্রধানমন্ত্রী প্রচারে গিয়ে নীতীশের সুশাসনের কথা বলছেন ঠিকই, তবে অনেক বেশি তাঁর নিজের সরকারের গুণকীর্তন করছেন। কাশ্মীরের ৩৭০ রদ, তিন তালাক নিষিদ্ধ করা, রামমন্দির নির্মাণ থেকে লাদাখে চিনের সেনাদের সঙ্গে লড়াইয়ে বিহারের জওয়ানদের বীরত্ব তাঁর প্রচারের বাণীতে উঠে এসেছে। তা বলে অবশ্য ওয়াকওভার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ মোদীর নেই। কারণ, লকডাউনের পরে বিহারের পরিযায়ী শ্রমিকদের হেনস্থা ও দুর্দশার জন্য নীতীশ সরকারের দিকে আঙুল উঠবে ঠিকই, মোদীকেও প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে। দেশের মধ্যে বিহার থেকেই সবচেয়ে বেশি পরিযায়ী শ্রমিক অন্য রাজ্যে কাজ করতে যান। তড়িঘড়ি লকডাউনের জেরে বিহারের শ্রমিকরাই সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে গ্রামে ফিরেছেন। শ্রমিকদের জন্য বিনামূল্যে রেশন বিলিয়ে কতখানি খেলা ঘোরানো যাবে, বলা কঠিন।

বিজেপি নেতারা প্রায়ই বিভিন্ন সমীক্ষা তুলে ধরে দাবি করেন, দেশ জুড়ে মোদীর জনপ্রিয়তা এখনও অটুট। কিন্তু ২০১৪-র পরে ২০১৯-এর লোকসভা ভোট বাদ দিলে তার প্রমাণ মেলেনি। প্রশ্ন ওঠে, জাতীয় রাজনীতিতে আর কোনও বিকল্প নেই বলেই কি নরেন্দ্র মোদী এখনও অপ্রতিরোধ্য? আর রাজ্যে বিকল্প থাকলেই বিজেপি মুশকিলে পড়ে?

বিরোধীদের এই প্রশ্নকে ভুল প্রমাণ করতে পারেন মোদী নিজেই। তিনি জানেন, বিহারের ভোটে বিজেপি জোটের হার হলে ভুল বার্তা যাবে। ২০১৫-য় সওয়া এক লক্ষ কোটি টাকার বিহার প্যাকেজ, একাই রেকর্ড সংখ্যক— ৩০টা জনসভা করেও তিনি বিজেপিকে জেতাতে পারেননি। নীতীশ আরজেডি-র সঙ্গ ছেড়ে বিজেপির সঙ্গে সরকার না গড়লে, বিহারের ভোটে এ বারও ক্ষমতায় ফেরার জন্যই মোদীকে লড়তে হত।

অযোধ্যায় রামমন্দিরের শিলান্যাস থেকেই বিহারের ভোটপ্রচার শুরু হয়েছিল। রামমন্দিরের ট্রাস্টে বিহারের কামেশ্বর চৌপালকে সদস্য করা হয়। অযোধ্যায় ‘জয় শ্রীরাম’-এর সঙ্গে ‘জয় সিয়ারাম’ ধ্বনিও ওঠে। তার পরে ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার আগে পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী বিহারে একের পর এক প্রকল্পের শিলান্যাস করেছেন। প্রায় রোজই ভার্চুয়াল সভা করেছেন বিহারবাসীর উদ্দেশে।

এর পরেও বিহারে বিপর্যয় হলে বিজেপি তার দায় পুরোটাই নীতীশ কুমারের ঘাড়ে ঠেলে দিতে পারবে। জয়ী হলে পুরো কৃতিত্ব নরেন্দ্রভাইয়ের— তাঁর ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর লক্ষ্যে কর্মসূচির। বিহারের ভোট নিয়ে চিন্তিত বিজেপি-আরএসএস নেতৃত্ব অবশ্য একটি বিষয়ে এখনও ভাবনাচিন্তা করছেন না। নিজেরা আত্মনির্ভর হওয়ার বদলে পুরোপুরি নরেন্দ্র-নির্ভর হয়ে পড়ছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE