কর্নাটকের ভারতীয় জনতা পার্টির পক্ষে এ বারের জয় সহজ ছিল না। সাম্প্রতিক ভারতের জটিল ভোট-ময়দানে কোনও জয়ই ‘সহজ’ নহে, অনেক অনিশ্চয়তা পার হইয়াই সেখানে পৌঁছাইতে হয়। কিন্তু কর্নাটকে সেই স্বাভাবিক অনিশ্চয়তার বাহিরেও কতকগুলি বাধা ছিল। যেমন, সে রাজ্যে এত দিন যে কংগ্রেস সরকার ছিল, তাহার বিরুদ্ধে, দৃশ্যত, স্থিতাবস্থা-বিরোধিতার প্রবল ঢেউ ছিল না। বরং মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়ার সরকার নানা অর্থেই জনপ্রিয় ছিল। তাহারা নানা জনমুখী সংস্কার ঘটাইয়াছে, পরিচিতি-ভিত্তিক রাজনীতির সফল খেলা খেলিয়াছে। লিঙ্গায়ত জাতগোষ্ঠীটি প্রধানত বিজেপি প্রভাববলয়ের অন্তর্গত হইলেও কংগ্রেস তাহাতে খাবল বসাইতে পারিয়াছে। সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকিলেও তাহা পূর্বতন বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পা জমানার স্মৃতির তুলনায় নেহাত ফিকা। বিপরীতে, বিজেপির প্রচারের আপাত-রমরমার বাহিরেই ছিল নানান সঙ্কট। প্রধান সঙ্কট— দলের অভ্যন্তরীণ ঐক্যের অভাব। গোষ্ঠী প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বিশেষত ইয়েদুরাপ্পা-বিরোধিতার হাওয়া সে রাজ্যে বিজেপিকে বিব্রত রাখিয়াছিল। লিঙ্গায়তদের যে কংগ্রেস কিয়দংশে টানিতে পারিয়াছিল, তাহার সহিত এই ইয়েদুরাপ্পা-বিরোধিতার ঘনিষ্ঠ যোগ। সুতরাং, অমিত শাহ এবং নরেন্দ্র মোদীর ‘ম্যাজিক’ স্মরণে রাখিয়াও বলিতে হয় বিজেপির সাফল্য সহজ ছিল না।
অর্থাৎ, গুজরাতের মতোই, কর্নাটকও প্রমাণ যে, কঠিন পরিস্থিতিতে হিসাব ও প্রচার-কৌশল দিয়া বিজেপি খেলাটি জিতিয়া লইতে জানে। অন্যদের তুলনায় বিজেপি এই বিষয়ে অনেকখানি আগাইয়া। কর্নাটকের যে অঞ্চলগুলিতে বিজেপি কম প্রভাবশালী, সেখানে এই সংখ্যাতত্ত্ব-কৌশলেই বিজেপি ভাল ফল করিয়াছে। এইটিই তাহার ভোট-লড়াইয়ের রহস্য— যেখানে তাহারা দুর্বল, দুর্বলতা ভাঙিয়া সেখানেই ডেরা তৈরি করিতে দলের নেতারা (গৌরবে বহুবচন সরাইলে যাহার অর্থ, অমিত শাহ) জানেন। মনঃসংযোগের পরিমাণটিও লক্ষণীয়। অমিত শাহ নভেম্বর হইতে সে রাজ্যে ঘাঁটি গাড়িয়া থাকিয়া বসিয়া আছেন। নরেন্দ্র মোদী ২১টি জনসভা করিয়াছেন, অন্তত কয়েক লক্ষ নাগরিকের সঙ্গে ‘অ্যাপ’-সংযোগ করিয়াছেন। রাহুল গাঁধী-সহ বিরোধী নেতাদের কাছে এই লাগাতার অধ্যবসায় ও কৌশলের সমন্বয়মাত্রাটি এখনও অধরা। সর্বশেষে উল্লেখ্য অর্থব্যয়ের পরিমাণ। যে বিপুল অর্থ ভোটের পিছনে গেল, তাহাতে কেন্দ্রীয় সরকারের অপার সৌজন্য অবশ্য-স্বীকার্য। ততোধিক স্বীকার্য অর্থ সংগ্রহের অতুলনীয় সামর্থ্য। আর, আশঙ্কামতোই, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ-বিষ বিজেপির শেষবেলার তুরুপের তাস। বিশেষত উপকূল অঞ্চলে মেরুকরণের পরিচিত বিদ্বেষ-রাজনীতি অনেকখানি সহায়তা করিয়াছে।
কৌশলগত শিক্ষা ছাড়াও কর্নাটক আর একটি শিক্ষা দিতেছে। অনেক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বিজেপি কিন্তু ভোটের অঙ্গনে কোনও সঙ্গী পায় নাই, একাই লড়িয়াছে। অর্থাৎ বিজেপি ছাড়া অন্য দলগুলির মধ্যে জোট বাঁধিলে বিজেপির কৌশলের পাল্টা উত্তর দেওয়া সম্ভব হইতেও পারে। ভোটের পর জেডি(এস)-এর সহিত জোট বাঁধার বদলে কংগ্রেস যদি ভোটের আগে জোট-বোঝাপড়া করিতে পারিত, তাহা হইলে এত কৌশল ফন্দি ম্যাজিক সত্ত্বেও কিন্তু অনুমান করা যায়, কর্নাটক বিজেপির পরাভব দেখিত— ভোটের ফলাফল প্রবল ভাবে সেই সঙ্কেত দিতেছে। কর্নাটক-সূত্রে বিজেপির দাক্ষিণাত্য-বিজয় সত্যই শুরু হইল কি না, সরকার-গঠনের অলীক কুনাট্য শেষ না হইলে তাহা বলা কঠিন। কিন্তু একটি কথা পরিষ্কার। বিজেপি-বিজয়কৌশলের পাল্টা মালমশলা কর্নাটকের অভিজ্ঞতার মধ্যেই সুপ্ত। বিরোধীরা তাহা দেখিতেছেন কি? দেখিলেও, শিখিতেছেন কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy