Advertisement
০৭ মে ২০২৪

ক্ষমতার প্রলাপ

তাঁহাদের কথামৃত শুনিয়া সুস্থবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকদের কেবল বিস্ময় নহে, হৃৎকম্প হইতেছে।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:১০
Share: Save:

প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে নাকি কোনও এক রাষ্ট্রপ্রধান একান্তে প্রশ্ন করিয়াছিলেন, ‘স্বল্পবুদ্ধি, কাণ্ডজ্ঞানহীন ব্যক্তি তো আমাদের দেশেও কিছু কিছু আছে, কিন্তু আমরা তাহাদের রাষ্ট্রদূত করিয়া অন্য দেশে পাঠাই না। আপনি কাহাকে আমাদের এখানে পাঠাইয়াছেন?’ সত্য হউক অথবা নিছক লোকশ্রুতি, গল্পটি মনোহর। নরেন্দ্র মোদীর ভারতে বসিয়া যদি সেই কাহিনি কাহারও মনে পড়ে, দোষ দেওয়া কঠিন। কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী, শাসক দলের নেতা, লোকসভার স্পিকার প্রমুখ গণ্যমান্যরা সকলেই নিশ্চয়ই পরমপ্রাজ্ঞ, শ্রেষ্ঠ মনীষার অধিকারী। নতুবা তাঁহারা ওই সকল অত্যুচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হইবেন কেন? কিন্তু তাঁহাদের কথামৃত শুনিয়া সুস্থবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকদের কেবল বিস্ময় নহে, হৃৎকম্প হইতেছে। এক একটি উক্তি এক এক ধরনের মাণিক্যবিশেষ, কেহ কাহারও অপেক্ষা কম নহে। কেন্দ্রীয় শিল্পবাণিজ্য মন্ত্রী পীযূষ গয়াল জিডিপির অঙ্ক কষিতে বারণ করিয়া বলিয়াছেন, অঙ্ক কষিয়া আইনস্টাইন মাধ্যাকর্ষণ আবিষ্কার করেন নাই। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের প্রজ্ঞার বাণী: মিলেনিয়াল অর্থাৎ তরুণ প্রজন্মের ভারতবাসীরা গাড়ি কিনিয়া ইএমআই মিটাইতে চাহেন না, অ্যাপ-ক্যাবে যাতায়াত করিতেছেন, সেই কারণেই গাড়ির বাজারে এমন মন্দা। লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা টুইটযোগে ঘোষণা করিয়াছেন, ব্রাহ্মণরা সমাজের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত, তাঁহাদের নির্দেশনাতেই সমাজ চলে। এই দৃষ্টান্তগুলি গত এক সপ্তাহের সন্তান। সাম্প্রতিক সংবাদের সরণি ধরিয়া পিছনে হাঁটিলে এমন রত্নরাজি আরও বিস্তর মিলিবার সম্ভাবনা। এবং, প্রধানমন্ত্রী নেহরুর বর্তমান উত্তরসূরিকেও প্রশ্নটি করিবার উপায় নাই, কারণ কথাসরিৎসাগরে তাঁহার নিজেরও গণেশের প্লাস্টিক সার্জারি জাতীয় অবদান রহিয়াছে। অতি সম্প্রতিও ‘গরু’ বা ‘ওম’ শুনিলে কাহাদের শরীরে কী প্রতিক্রিয়া হয় সেই বিষয়ে ব্যঙ্গোক্তি নিক্ষেপে তিনি— ভারতের প্রধানমন্ত্রী— আমোদিত হইয়াছেন। রাজনীতির নায়কনায়িকাদের এই ব্যাধি ভারতে বিরল নহে, এই রাজ্যের ইতিহাসেও ‘ডহরবাবু’ ইত্যাদি নমুনা আছে। কিন্তু খাসদরবারের উচ্চতম মহলে বাজে কথা বলিবার এমন দৈনন্দিন বিচিত্রানুষ্ঠান, মহান ভারতভূমিতেও অ-পূর্ব।

লোকমুখে প্রকাশ, পীযূষ গয়াল মহাশয় নাকি আপন আইনস্টাইন-নিউটন বিভ্রম (বিস্তর বিলম্বে) টের পাইয়া মর্মাহত হইয়াছেন। সাধু। তিনি ভ্রম স্বীকারও করিয়াছেন। সাধু, সাধু। তবে জিডিপির অঙ্ক লইয়া মাথা না ঘামাইবার পরামর্শ হইতে তিনি নড়েন নাই। নির্মলা সীতারামনও মিলেনিয়াল-বিদূষণ প্রত্যাহার করেন নাই। ওম বিড়লার ব্রাহ্মণ-প্রীতি এবং নরেন্দ্র মোদীর গরু-ওম-প্রীতির অবিনশ্বরতার কথা বলাই বাহুল্য। উক্তিগুলি আপাতদৃষ্টিতে বিভিন্ন ধরনের। কোনওটি যুক্তি-তথ্যের প্রতি অশ্রদ্ধার পরিচায়ক; কোনওটি অতিপ্রাচীন সমাজভাবনার প্রমাণ— যে ভাবনা কেবল কুসংস্কারে আচ্ছন্ন নহে, সংবিধানের আদর্শের সম্পূর্ণ বিরোধী; কোনওটিতে বা নির্ভেজাল নিম্নরুচির করুণ প্রকাশ। সাম্প্রতিক সংবাদের স্মৃতিপট এমন বিচিত্র কুনজিরে আকীর্ণ। কিন্তু সকল বৈচিত্রের মধ্যে নিহিত আছে এক সাধারণ সত্য। স্পর্ধিত অহঙ্কারের সত্য। ক্ষমতার অহঙ্কার। ক্ষমতামত্ততা যে যথেচ্ছাচারের উৎস হইয়া উঠিয়া থাকে, তাহা বহুচর্চিত। যথেচ্ছকথনও সেই যথেচ্ছ আচরণের অঙ্গ। বিজ্ঞান, যুক্তি, তথ্য, অর্থনীতি, সভ্যতা, ভদ্রতা, সংবিধান, কিছুরই পরোয়া করিবার প্রয়োজন নাই, কারণ আমার ক্ষমতা আছে— অতি-ক্ষমতার এই অমিত উচ্চারণ নানা দেশে, নানা যুগে শোনা গিয়াছে। বর্তমান ভারতে তাহারই প্রবল পুনরাবৃত্তি ঘটিতেছে। কথাগুলিকে নিছক বাজে কথা বলিয়া উড়াইয়া দিলে ভুল হইবে। ক্ষমতার প্রলাপ অনেক সময়েই গভীর উদ্বেগের কারণ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE