Advertisement
E-Paper

ভ্যানিশের বোতাম

আত্মঘাতী হামলা দুনিয়ার নানা এলাকার নানা সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর প্রিয় খেলা। আর বিভিন্ন উগ্রপন্থী দল সেই খেলার বোড়ে নিযুক্ত করে নিজেদের পছন্দমতো। যেমন বোকো হারামের উগ্রপন্থীদের বেশি পছন্দ ছোট ছোট মেয়ে।

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৮ ০০:০০
ঐতিহ্য: আত্মঘাতী যোদ্ধার সাজে প্যালেস্তাইনি শরণার্থীরা, সঙ্গে এক শিশুর দেহে নকল বিস্ফোরক। লেবানন, ২০০১।ছবি:  গেটি ইমেজেস

ঐতিহ্য: আত্মঘাতী যোদ্ধার সাজে প্যালেস্তাইনি শরণার্থীরা, সঙ্গে এক শিশুর দেহে নকল বিস্ফোরক। লেবানন, ২০০১।ছবি: গেটি ইমেজেস

সকাল আটটায়, রাস্তায় একলা মেয়ে? দেখেছ না কি? শিগগির পালাও পথিক, ভাগ্য বঙ্কিম, আয়ুষ্কাল নিবুনিবু।— নাইজিরিয়ার উত্তর-পূর্বে মাইদিগুরি আর আশেপাশের এলাকার মানুষদের এখন ঠিক এ রকমটাই মনে হয়। বোকো হারাম উগ্রপন্থীদের জবরদস্তি দখল করা এলাকা। চলে জবরদস্ত ‘টেরর’। এই ‘টেরর’-এর একটা বড় অঙ্গ ঠিকঠাক আত্মঘাতী হামলা করানো।

আত্মঘাতী হামলা দুনিয়ার নানা এলাকার নানা সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর প্রিয় খেলা। আর বিভিন্ন উগ্রপন্থী দল সেই খেলার বোড়ে নিযুক্ত করে নিজেদের পছন্দমতো। যেমন বোকো হারামের উগ্রপন্থীদের বেশি পছন্দ ছোট ছোট মেয়ে। পাঁচ থেকে পনেরো কিংবা আঠারো। সকাল সকাল রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে আত্মঘাতিনীরা। আত্মা বিভ্রান্ত, বিষাদের মেঘ চোখে জমিয়ে উদ্‌ভ্রান্ত, শরীরে বোমা বেঁধে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তাদের ঝকঝকে সকালে, যাতে তরতাজা কিছু প্রাণ তারা নিশ্চিহ্ন করতে পারে।

অথচ, ষোলো বছরের হাদিজ়া বলেছিল, ‘‘আমি কিন্তু কাউকে মারতে চাইনি। কেবল জানতাম না কী করে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকা বোমার জ্যাকেটটা খুলতে হয়, কী করে বোমাটাকে বন্ধ করতে হয়!’’ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় হাদিজ়া তার পাশের বারো বছরের মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘‘তুমি কী করবে তোমার বোমাটা দিয়ে?’’ মেয়েটি হতাশায় ডুকরে উঠে বলেছিল, ‘‘কী আর করব, বোতাম টিপে নিজেকেই মেরে ফেলব।’’

আত্মঘাতী হামলার প্রস্তুতি চলে অনেক হিসেব করে। মেয়েদের অপহরণ করে আনা, তার পর তাদের ‘বিয়ে’র প্রস্তাব দেওয়া, না মানলে, বোকো হারামের বড় কর্তার দরবারে এক বার নিয়ে যাওয়া। সে নিদান শোনায়— তুমি দারুণ সুন্দর একটা জায়গায় যাবে। মেয়ে নেচে ওঠে, ভাবে বুঝি মা-বাবার কাছে। বড় কর্তা বলে, তুমি বেহেস্ত যাবে। সেখানে তো পবিত্র আত্মারা যায়, তাই তোমার ঠাঁই সেখানে। অল্পবয়েসি মেয়ে জানে না, স্বর্গে যেতে হলে গায়ে বোমা বেঁধে যেতে হয়। রাত্রি বেলায় জঙ্গিরা আসে। হাতে একটা বেল্ট। গায়ের সঙ্গে আঁট করে বেঁধে দেওয়া হয় সেটা। তার পর নিশুত রাতেই বার করে দেওয়া হয় পথে। নির্দেশ— যেখানে সেনা বা পুলিশের ছাউনি, কিংবা সাধারণ মানুষের ক্যাম্প, বোকো হারামের হাত থেকে পালিয়ে বেঁচেছে যারা, সে রকম একটা জায়গায় গিয়ে বোতাম টিপে নিজেকে ওড়াও, সঙ্গে ওড়াও কিছু মানুষকে। ২০১৬ সালের তুলনায় বোকো হারামের আত্মঘাতী হামলার সংখ্যা ২০১৭’য় দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণ। রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসেব অনুযায়ী গত বছরে ১১০ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ে আত্মঘাতী হামলা করেছে, যার মধ্যে ৭৬ জন মেয়ে। এক জন মেয়ে নিজেকে বোমায় যখন উড়িয়েছে তখন তার পিঠে ছোট্ট একটি শিশু বাঁধা ছিল।

হাদিজ়ার মতোই, এই মেয়েদের অনেকে শেষ মুহূর্তে বা তার একটু আগে আত্মসমর্পণ করে বেঁচে গিয়েছে, অন্যদেরও বাঁচিয়েছে। কেউ সেনা বা পুলিশ ছাউনির কাছে গিয়ে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দু’হাত তুলে বলেছে, ‘‘আমায় বাঁচাও, আমি বিস্ফোরণ ঘটাতে চাই না।’’ কেউ আবার সাধারণ মানুষের কাছে সাহায্য চেয়েছে। তবে সবাই নিজেকে বাঁচাতে পারেনি। চেকপোস্টে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করতে গিয়েছে বোমারু-মেয়ে, কিন্তু বোমা ফাটবে এই ভয়ে পুলিশই আগে তাকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। এমনকী সাধারণ একলা মেয়েরাও সন্দেহের শিকার হয়ে মরে গিয়েছে ভয়-পাওয়া পুলিশের গুলিতে।

ভয় পাচ্ছে সাধারণ মানুষও। কোনও একলা মেয়ে, বয়স যদি হয় বছর ষোলোর নীচে, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় ঋজু ভাবে, পোশাকটা নোংরা, তা হলে দাও ছুট, কারণ এ মেয়ে তো নির্ঘাত বিস্ফোরক। সাধারণত আত্মঘাতিনীদের জামাকাপড় হয় নোংরা, মাথায় স্কার্ফ। আর তাই ওখানে মেয়েরা এখন সব সময় সাফসুতরো পোশাকে পথে বেরোনোর চেষ্টা করে। অনেকেই আবার চেকপোস্টের কাছে এসে হামাগুড়ি দিয়ে বুকে হেঁটে এগোয়। বোমার বেল্ট বাঁধা থাকলে তো হামাগুড়ি দেওয়া যায় না। তাই ওই ভাবে চললে পুলিশকে বুঝিয়ে দেওয়া যাবে তারা জঙ্গি নয়। তবু একলা মেয়ে দেখলেই মাইদিগুরির মানুষ বলছে: তফাত যাও।

ছোটদের আত্মঘাতী সৈনিক বানানোর নজির নতুন নয়। ২০০০ সালে প্যালেস্তাইনে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা (বিদ্রোহ) শুরু হয়, জঙ্গি গোষ্ঠী হামাস শিশুদের ব্যবহার করে আত্মঘাতী সৈনিক হিসেবে। ইজ়রায়েলি সেনার হিসেবে ২০০০ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে ২৯ জন নাবালক সফল আত্মঘাতী হামলা করে। বয়স সবার আঠারোর নীচে। আর ৪০ জন ধরা পড়ে যায়। এর পর তালিবান আর আল কায়দা এসে শিশু আত্মঘাতী সৈনিকদের ব্যাপারটা একটা ‘নিয়মিত পরিকাঠামো’র মধ্যে এনে ফেলে। সন্ত্রাসের একটা আলাদা বিভাগ। আইএস কিংবা বোকো হারাম সেই ট্র্যাডিশনই সমানে চালিয়ে যায়, যাচ্ছে।

শিশু আত্মঘাতী জোগাড় করার নানা কৌশল। যেমন উত্তর আফগানিস্তানের গ্রামে গ্রামে যায় জঙ্গিগোষ্ঠীর লোকজন। বাড়ির একটা ছেলে, কয়েকটা ছাগল আর কিছু টাকা তাদের ভেট দিতে হয়। না হলে কেড়ে নেওয়ার ব্যবস্থা তো রয়েইছে। ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয় শিশুদের, তারা আর কোনও দিন মা-বাবাকে দেখতে পায় না। তার পর এক সময় তাদের দেহে বিস্ফোরক বেঁধে অ্যাকশনে পাঠানো হয়। যদি কেউ শেষ মুহূর্তে মত বদলায়, ভয় পেয়ে যায়, কান্নাকাটি করে, তাতেও নিস্তার নেই। অনেক সময়েই রিমোট থাকে অন্য এক জনের হাতে, সে থাকে আড়ালে। কোনও রকম বেগড়বাঁই দেখলে সে-ই বোতাম টিপে কাজ হাসিল করে।

অনেক শিশু ধরা পড়ে যায়, অনেকে ধরা দেয়। তাদের একাংশের মানসিক চিকিৎসা করানো হয়। এই চিকিৎসার সময় দেখা গিয়েছে, জঙ্গিরা প্রায় সবারই মগজধোলাই করে, বলে: যারা খারাপ লোক, তুমি তাদের মেরে বেহেস্ত যাবে, সেখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে সুন্দর জীবন। কিংবা দেখানো হয় ‘অন্য’ বাস্তব— মানুষ মারা, বিস্ফোরণ, আত্মঘাতী হামলা দেখিয়ে বলা হয় এ সবই ঠিক, পৃথিবীকে সুন্দর করতে এই সব করে যাওয়া প্রয়োজন। তাদের নানা রকম ওষুধও খাইয়ে যাওয়া হয়, যাতে তারা স্বাভাবিক অনুভূতিগুলোর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়। ছোট্ট মানুষ, তুলতুলে মন, পৃথিবীকে সুন্দর করবে বলে শহিদ হয়ে উঠতে চায়।

স্বাভাবিক অনুভূতির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গেলে মানুষ নিজেকে, নিজের প্রিয়জনকে শেষ করে দিতে পারে। যেমন ঘটল সম্প্রতি, যখন ইন্দোনেশিয়ার সুরাবায়া শহরে একই পরিবারের ছ’জন আত্মঘাতী হলেন। সবচেয়ে ছোট মেয়েটির বয়স মাত্র আট বছর। বাবা আইএস-এর অনুসারী জঙ্গি গোষ্ঠীর প্রধান। গত ১৩ মে এই পরিবারের ৬ জন মিলে শহরের তিন জায়গায় আত্মঘাতী হামলা চালায়। পরিবারের এক জন ফিরমান হালিম, ষোলো বছর বয়স, সে দিন সকাল বেলায় মসজিদে নমাজ পড়তে এসে খুব কাঁদছিল, তার বাবা মাথায়-পিঠে হাত বুলিয়ে তাকে বলছিলেন, ‘‘শান্ত হও।’’ এ দৃশ্য দেখেছিলেন মসজিদের রক্ষী, হাসিখুশি ফিরমােনের সঙ্গে প্রায় রোজই যাঁর কথা হত। সে দিন সকালে ছেলেটা এক বারও তাঁর দিকে ফিরে তাকায়নি! ওই সকালেই ফিরমান আর তার ছোট ভাই বাইকে চড়ে, তাদের বাবা ভ্যানে, আর তাদের মা দুই বোনকে নিয়ে আত্মঘাতী হামলা চালায় পর পর তিনটে চার্চে। পাঁচ মিনিটে তেরো জন মৃত, আহত চল্লিশের বেশি। সন্তানদের নিয়ে মা-বাবার আত্মঘাতী হানা নতুন বটে। একটু অন্য রকম স্বাদে সন্ত্রাসের উপস্থাপনা!

আত্মঘাতী হানার এই নানা রকম প্রস্তুতির মূলে একটা কথা প্রকট হয়ে উঠে আসে, যেমনটা উঠে থাকে বেয়াড়া গজাল, পা যাতে কাটবেই। তার নাম: আদর্শ। আদর্শ রক্ষা করার জন্যই তো এতগুলো প্রাণ হরির লুট দেওয়া যাচ্ছে। আদর্শ না থাকলে কিসের নামে এমন জঙ্গি-ব্যবসা চালানো যেত, এমন ভয়ের বাজার বসানো যেত বিশ্ব জুড়ে? এই আদর্শের সঙ্গে নৈতিকতার সম্পর্ক নেই। নীতির ঝঞ্ঝাট ঝেড়ে ফেলে আদর্শকে বিশেষ সুবিধা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এবং ‘ধর্মীয়’ আদর্শ হল সব আদর্শের সেরা, সবচেয়ে শক্তিমান। যে মা-বাবার কাজ সন্তানকে রক্ষা করা সব ঝড়ঝাপ্টা থেকে, ধর্মের নামে ভোলাতে পারলে সেই মা-বাবাই তাদের মৃত্যুর দিকে জোর করে ঠেলে দেয়!

আর মানবাধিকার? শিশুরাই যখন আত্মঘাতী হিংসা হয়ে আছড়ে পড়ছে, তখন মানবাধিকার কথাটাই অর্থহীন হয়ে পড়ে না কি? ওই শিশুরা তো ভালবেসেছিল জীবনকে। বাঁচতে চেয়েছিল। সূর্যের তাত, বৃষ্টির ঝাপট, বিশ্বাসঘাতকতা, আন্দোলন, খিদে, হাহাকার, আবিষ্কার— কিছুই তো আস্বাদ করা হয়নি কচিগুলোর। অথচ তাদের বাধ্য করা হল মানতে কঠোর নির্দেশ— জীবন শেষ করে দাও।

এর পরেও অবশ্যই সন্ত্রাসের রাজা-উজির ও তাদের পৃষ্ঠপোষকরা আদর্শের শাক দিয়েই হিংসার মাছ ঢাকার চেষ্টা করবে, আর উলুখাগড়ার দল ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে, প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলে, হাঁকপাঁক করে বাঁচতে চেয়েও, নিরুপায় হয়ে বোতাম টিপবে। ভ্যানিশের বোতাম।

Boko Haram Terrorist Crime Suicide Bomber
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy