Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
India-China

ড্রাগনের সঙ্গে চাই আদানপ্রদান

পশ্চিমি আধুনিকতার প্রেরণায় ভারতে যে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল, তা অনেক প্রাচীনপন্থী চিনার ভাল লাগেনি।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

সাম্প্রতিক কালে চিন-ভারত সীমান্ত বিবাদ হলেই, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভারতের সমালোচনার বন্যা বইয়েছে চিনারা। সব মতাদর্শের চিনারাই জাত্যভিমান, ভারতীয়দের প্রতি জাতিবৈর ও বর্ণবিদ্বেষী শ্লেষ প্রকাশ করেছেন। তা বেশ উদ্বেগের।

১৯৬২-র যুদ্ধে ভারতের পরাজয়ের ফলে চিনের জাতীয় চেতনায় দম্ভ তৈরি হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ব্রিটিশ আমল থেকেই ভারতের প্রতি চিনাদের বিদ্বেষ বেশ স্পষ্ট। ব্রিটিশ শাসকের সঙ্গে বার বার তারা ভূ-রাজনৈতিক সঙ্ঘাতে জড়িয়েছে। সীমান্ত অদলবদল হয়েছে একাধিক বার। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে সেই অঙ্কেই সীমান্ত বিবাদের সূচনা।

উনিশ শতকে ভারতে আফিম চাষ করে চিনা বাজারে বেচত ব্রিটিশরা। এই ভয়ঙ্কর মাদক থেকে বাঁচতে চিন আফিম আমদানি বন্ধ করতে চাইলে ইংরেজদের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ বাধে। প্রথম ও দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধে ভারতীয় সেনার সাহায্যে ইংরেজরা চিনাদের পরাস্ত করে, ক্যান্টন ও শাংহাই-সহ কিছু বন্দর-শহরে বাণিজ্যিক আধিপত্য কায়েম করে। সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিযুক্ত হন ভারতীয়েরা। চিনাদের মনে বিদ্বেষ জমে। এই ভারতীয়দের ওরা বিদ্রুপ করে ‘স্যর’ বলত। শাংহাই-শহরের বাক্-রীতি অনুসারে এই শব্দের শুরুতে ‘আ’ যোগ করে দাঁড়াল ‘আস্যর’, যা ক্রমে ‘আসান’-এ পরিণত হয়। তাতে ভারতীয়দের রঙের প্রতি কটাক্ষ। ‘আসান’ অর্থাৎ নিকৃষ্ট কালো চামড়ার ক্রীতদাস। বক্সার বিদ্রোহে (১৮৯৯-১৯০১) ব্রিটিশ বাহিনীতে ভারতীয়দের উপস্থিতিতে চিনাদের ঘৃণা বাড়ে। ‘ওয়াংগুয়ো’ (হারিয়ে যাওয়া দেশ) আখ্যা পায় ভারত।

পশ্চিমি আধুনিকতার প্রেরণায় ভারতে যে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল, তা অনেক প্রাচীনপন্থী চিনার ভাল লাগেনি। ১৯৭০-এর দশক থেকে অবশ্য তারা পশ্চিমি আধুনিকতার প্রয়োজনীয়তা মেনে নেয়। কিন্তু আজও দু’দেশের সঙ্ঘাত হলে চিনা জনমানসে পুরনো জাতিবিদ্বেষ জেগে ওঠে। গত দুই দশকে চিনের অর্থনৈতিক উন্নতির হার ভারতের তুলনায় বহুলাংশে বেড়েছে। সেই অহঙ্কারও আছে। ভারতের দারিদ্র ও সমাজের অস্পৃশ্যতার ব্যাধিকে কটাক্ষ করে চিনা ট্রোলগুলি।

চিন ভারতীয় সাংস্কৃতিক পণ্যের কদর করে। সব শহরেই বলিউড জনপ্রিয়। পঞ্চাশের দশকে রাজ কপূরের ‘আওয়ারা’ বা হালে আমির খানের ‘দঙ্গল’-এর জনপ্রিয়তায় ভারতের প্রতি চিনা অনুরাগের প্রকাশ। চিনে ১,৪৫,৪৬৬ কোটি টাকারও বেশি ব্যবসা করেছে ‘দঙ্গল’! ওরা আদর করে আমিরকে ডাকে ‘মিশু’। আমিরের ‘মি’ আর চিনা ‘শু’ (অর্থাৎ কাকা)— আংকল আমির। শাহরুখ খান যখন বেজিং ফিল্ম ফেস্টিভালে গেলেন, এয়ারপোর্টেই ভিড় উপচে পড়েছিল। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দু’দেশের সম্পর্ক মজবুত করতে তৎপর ‘ইন্ডিয়া চায়না ফিল্ম সোসাইটি’। আসলে, মূল ধারার ভারতীয় ছবির বিষয়গুলি চিনা জীবনযাপনেও অপরিচিত নয়। ‘কুং ফু যোগ’-এর মতো ছবি দু’দেশের বোঝাপড়া তৈরির পক্ষে সদর্থক। চিনা তারকা জ্যাকি চ্যান এবং ভারতীয় তারকা সোনু সুদ ও দিশা পাটানি অভিনীত ইতিহাসাশ্রয়ী এই প্রযোজনা প্রাচীন তিব্বত, মগধ সাম্রাজ্য এবং ধ্রুপদী চিনা কৃষ্টির মিশ্রণে এক অনবদ্য সৃষ্টি। সত্তরের দশকে, আমাদের কৈশোরের আকর্ষণ ছিল ব্রুস লি-র ছবিগুলো। বড়দের ফাঁকি দিয়ে ‘দ্য ওয়ে অব দ্য ড্রাগন’, ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ দেখার উত্তেজনাই ছিল আলাদা। এখন বুঝি, ব্রুস লি আসলে পশ্চিমের চোখে পূর্বের পুরুষকার প্রতিষ্ঠার প্রয়াস। সীমান্ত সংঘাতের মধ্যেও এ সব ছবি দেখতে আমরা দ্বিধাগ্রস্ত হই না।

কথাটি সাহিত্যের ক্ষেত্রেও খাটে। হিউয়েন ৎসাঙের ভারত অভিযান ‘জার্নি টু দ্য ওয়েস্ট’ নামক চিনা উপন্যাসে জনপ্রিয় হয়েছে। গত দশকের শুরু থেকেই চিন-ভারত পূর্ণাঙ্গ আন্তঃসাংস্কৃতিক বিনিময়ের উদ্দেশ্যে চিনা মঞ্চও তৈরি হয়েছে। সমসাময়িক দেশি শিল্পের পসরা সাজিয়ে সে দেশে পাড়ি দিয়েছে ভারতীয় শিল্পীদল। চিনের নানা শহরে ভারতীয় তথ্যচিত্রের প্রদর্শনী, ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসর, বইমেলা আয়োজিত হয়েছে। ‘আইবিস ট্রিলজি’-র লেখক অমিতাভ ঘোষের চিনে মাসব্যাপী সাহিত্য-পরিক্রমা রীতিমতো হইচই ফেলেছিল।

দু’দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে চিন-ভারত সম্পর্ক নিয়ে লেখাপড়ার কেন্দ্র, বিভাগ, ফেলোশিপ, এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম আছে। ভারত থেকে যত ছাত্র চিনে পড়তে যায়, তত ছাত্র কি চিন থেকে আসে? অথচ সম্পর্কে ভারসাম্য আনতে, নতুন বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ তৈরি করতে দু’দেশকেই এগোতে হবে। যেমন, হিমালয় নিয়ে গবেষণা দু’দেশের ক্ষেত্রেই সমান প্রয়োজনীয়।

চিন-ভারত ক্লেদ এবং প্রচ্ছন্ন জাতিবৈর দূর করতে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সৌহার্দ্যের বাতাবরণ জরুরি। শুধু কূটনৈতিক ও সামরিক শক্তি প্রদর্শনে এই বিবাদের মীমাংসা হবে না। দুই রাষ্ট্রের উগ্র জাতীয়তাবাদের বরফ গলাতে পারে একমাত্র নানা ক্ষেত্রের নাগরিক আদানপ্রদান।

ইংরেজি বিভাগ, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

India-China India China Ladakh Galwan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE