Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
অর্ধেককে পিছনে ফেলে আর এক অর্ধেক এগোলে গৌরবে বহুবচন?
Constitution

সংবিধানের সত্তর ও জাতবৈষম্য

বর্ণভেদবিশ্বাসী, ব্রাহ্মণ্যবাদী-সামন্ততন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হিন্দু সমাজব্যবস্থায় যদি চিরকালীন অন্তেবাসী মানুষের সাংবিধানিক রক্ষাকবচ না দেওয়া যায়, তবে গণতন্ত্রের বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী।

পশ্চাতে: আদিবাসী সংগঠনের অবস্থান বিক্ষোভ, কলকাতা। পশ্চিমবঙ্গ ১০.৭% দলিত মানুষের বাসস্থান হওয়ায় দরুন দেশে দ্বিতীয় স্থানে

পশ্চাতে: আদিবাসী সংগঠনের অবস্থান বিক্ষোভ, কলকাতা। পশ্চিমবঙ্গ ১০.৭% দলিত মানুষের বাসস্থান হওয়ায় দরুন দেশে দ্বিতীয় স্থানে

মেরুনা মুর্মু
শেষ আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০২
Share: Save:

২৫ নভেম্বর ১৯৪৯ গণপরিষদে বি আর অম্বেডকর তাঁর বক্তৃতায় নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ যে সংবিধান গৃহীত হবে, তাতে ভারতবর্ষে রাজনৈতিক সাম্য এলেও আর্থ-সামাজিক সাম্য অধরাই থেকে যাবে। এও বলেছিলেন যে, গণতন্ত্রে রাজনৈতিক সাম্যের ভিত যদি সামাজিক ন্যায়, স্বাধীনতা এবং ভ্রাতৃত্ববোধে নিহিত না থাকে তবে তার টিকে থাকা অসম্ভব। তিনি অনুভব করেছিলেন, বর্ণভেদবিশ্বাসী, ব্রাহ্মণ্যবাদী-সামন্ততন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হিন্দু সমাজব্যবস্থায় যদি চিরকালীন অন্তেবাসী মানুষের সাংবিধানিক রক্ষাকবচ না দেওয়া যায়, তবে গণতন্ত্রের বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। সংবিধানের প্রাণকেন্দ্রে যে 'we the people'-এর ধারণা, আদ্যোপান্ত অগণতান্ত্রিক চিন্তাধারায় জারিত জাতপাতভিত্তিক থাকবিন্যস্ত হিন্দু সমাজের বাস্তবতা তার অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। এটা জেনেই সাংবিধানিক নৈতিকতাকে আইনি হস্তক্ষেপে বৈধতা দান করতে চেয়েছিলেন অম্বেডকর।

সংবিধানের ১৫, ১৬ ও ১৯ নম্বর ধারা যদিও সামাজিক আদানপ্রদান, মেলামেশা আর পারস্পরিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সাম্য আনতে চেয়েছিল, এবং ১৭ নম্বর ধারা অস্পৃশ্যতাকে আইনত অপরাধ বলে ঘোষণা করেছিল, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষেরা পেশা, খাদ্য, পোশাক, ভাষা, আচার-ব্যবহারে বর্ণহিন্দুদের চেয়ে পৃথক হওয়ার ফলে তাঁদের চিরতরে অস্পৃশ্য অশুচি ঠাহরে সামাজিক বহিষ্করণের নিদান দিয়ে অসাম্যের বিধানগুলো জবরদস্ত ভাবে কায়েম রেখেছে ব্রাহ্মণ্যবাদ। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষেরা হিন্দুদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং ধর্মজনিত বহুমাত্রিক হিংসা ও বৈষম্যের শিকারই শুধু নন, নির্মম জাতপাত ভেদ-সংবলিত ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু সমাজে এঁরা আজীবন সম্মান, মৌলিক মানবাধিকার ও ক্ষমতার অধিকার থেকে বহিষ্কৃত। এও সত্যি যে ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপত্যের বিরুদ্ধে রণে ভঙ্গ দিয়ে স্বাতন্ত্র্যচেতনার অধিকারী প্রান্তবাসী সম্প্রদায়গুলি নিজেদের চলনবলন, আদবকায়দা, স্বকীয়তাকে বিসর্জন দিয়ে ক্রীতদাসমূলক সংস্কৃতায়ন প্রক্রিয়াকে আত্মীকরণ করে মূলস্রোতে মিশে আত্মঘাতী প্রয়াসে ব্রতী হলে ‘তুমি নিশ্চিত অবাঞ্ছিত অপর’ এমন নিদান দিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদ তাদের জাতিকাঠামোর তলার দিকে ক্ষমাঘেন্না করে হয়তো জায়গা করে দেয়। তবে ২৯ নম্বর ধারার দৌলতে অষ্টম তফসিলে কয়েকটা আদিবাসী ভাষা সরকারি ভাষার মান্যতা পাওয়ায় এই বহিষ্করণ ও কণ্ঠরোধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষাটুকু বেঁচে থাকবে আশা করা যায়।

ভরসার কথা যে, এক দিকে যেমন অরণ্যের অধিকার আইন (২০০৬) কেড়ে নিয়ে বনাঞ্চল থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র চলছে, তেমন যোগ্য জবাব দিতে আদিবাসীরা আজ কর্পোরেট বৃহৎ পুঁজির স্বার্থে জড়িত সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলে রুখে দিচ্ছেন সংবিধানের অবমাননা। সংবিধানে তফসিলি জনজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে তাঁদের পূর্ণ স্বশাসনের অধিকার আছে। তা ছাড়া পঞ্চায়েত আইন (১৯৯৬) অনুযায়ী এই সব অঞ্চলে আদিবাসী গ্রামসভা-ই সর্বোচ্চ প্রশাসনিক ক্ষমতার অধিকারী। তাঁদের অনুমোদন ও সিদ্ধান্ত ছাড়া সরকার ‘উন্নয়ন’-এর নামে কোনও অনাদিবাসীকে জমি বেচতে বা হস্তান্তর করতে পারে না। ২০১৩-১৪’য় আমরা দেখি ওড়িশার কালাহান্ডি জেলার লাঞ্জিগড়ে বেদান্ত অ্যালুমিনিয়াম লিমিটেড নিয়মগিরি পাহাড় খনন করে বক্সাইট উত্তোলন করার প্রস্তাবে সরকার রাজি হয়ে যাওয়ায় স্থানীয় ডোংরিয়া কোন্ধ জনজাতির মানুষেরা কি প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ২০১৬-১৭’য় ঝাড়খণ্ড সরকার যখন ছোটনাগপুর টেনান্সি অ্যাক্ট-এর সংশোধন এনে আদিবাসীদের জমিকে ব্যবসায়িক মুনাফার জন্য হস্তান্তর করতে চায় তখন খুনতি, গুমলা, সিংভূম, পশ্চিম সিমডেগার আদিবাসীরা জল, জঙ্গল, জমির লুট প্রতিরোধের জন্য অভিনব পাতালগড়ি আন্দোলন গড়ে তোলেন। তফসিল জনজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের জন্য সংবিধানের অংশবিশেষ পাথরের ওপর খোদাই করেন।

কেমন আছে পশ্চিমবঙ্গ, যেখান থেকে নির্বাচিত হয়ে অম্বেডকর গণপরিষদে গিয়েছিলেন? ২০১১ আদমশুমারি অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গ ১০.৭% দলিত মানুষের বাসস্থান হওয়ায় দরুন ভারতবর্ষে দ্বিতীয় স্থানে। এই রাজ্যের ৫.১% মানুষ আদিবাসীও বটে। দৈনিক সংবাদপত্রগুলিতে চোখ রাখলে দেখা যায় অন্তর্বিবাহবিরোধী ও জাতিভিত্তিক পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপন, বৈবাহিক আদানপ্রদানের রীতিনীতি। আর ৪৬, ২৪৩ডি, ২৪৩টি, ৩৩০, ৩৩২, ৩৩৪, ৩৩৫ সত্ত্বেও প্রাতিষ্ঠানিক হালহকিকত কী? পশ্চিমবঙ্গ একমাত্র রাজ্য যেখানে বিধানসভায় উচ্চবর্ণের সদস্য ১৯৭২-এ ৩৮% থেকে ১৯৯৬-এ বেড়ে দাঁড়ায় ৫০%। শুধুমাত্র পিছিয়ে পড়া/অনগ্রসর জাতিভুক্ত বলেই কত প্রান্তিক মানুষদের জীবনকে নিজের খাতে বইতে দেওয়া হয় না এখানে। মনে পড়ে ১৬ অগস্ট ১৯৯২ সালে লোধাশবর জনজাতির প্রথম স্নাতক চুনি কোটালের লাগাতার জাতভিত্তিক নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেতে আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া? তফসিলি জাতি ও জনজাতি (নির্যাতন নিরোধ), ১৯৮৯ আইন অনুযায়ী অপরাধীর শাস্তি কিন্তু সে দিনও মেলেনি।

শুধুমাত্র ২০১৭ সালেই রাজ্যের নানা জেলায় ২৩ জন আদিবাসী কিশোরী-তরুণীকে ধর্ষণের মামলা দায়ের হয়েছে। তাও ২০১৮ সালে এই অপরাধপ্রবণতা কমানোর রক্ষাকবচকে আইনি ভাবে লঘু করা হয়েছে। ১৬ অক্টোবর ২০১৭-র খবরে জানা যায় যে, তফসিলি জাতি-জনজাতি সংক্রান্ত জাতীয় কমিশন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে যে, দলিত ও আদিবাসীদের উপর অপরাধের নিরিখে এই রাজ্য দ্বিতীয়, এবং সরকার সে ব্যাপারে শুধু উদাসীনই নয়, দায়িত্বজ্ঞানহীনও বটে।

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে জাতিবৈষম্যের প্রভাব নজর কাড়ার মতো। ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৪-১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকেরা সংখ্যায় ছিলেন ৪৯,২১৭। তার মধ্যে তফসিলি জাতিভুক্ত অধ্যাপকের সংখ্যা ৩,০৩৭ (৬.১৬%) আর তফসিল জনজাতিভুক্ত অধ্যাপকের সংখ্যা ৪৫১ (০.৯১%)। মেধার নামে সামাজিক বহিষ্করণ তো হামেশা ঘটে। মেধাতালিকা বা গবেষণা প্রকল্পে সংরক্ষিত আসনে উচ্চবর্ণের নামের ছড়াছড়ি। কারণ হিসেবে বলা হয় যোগ্য বা মেধাবী দলিত বা আদিবাসী এবং অনগ্রসর জাতভুক্ত পড়ুয়া পাওয়া যায়নি। কলকাতার নিকটবর্তী কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে আজও উচ্চবর্ণের অধ্যাপকেরা নিচু জাতের গবেষকদের গবেষণা করান না, এটাই অলিখিত নিয়ম।

১৬ নম্বর ধারা বলবৎ থাকা সত্ত্বেও বংশগরিমাহীন দলিত বা আদিবাসী যাকে সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক অবমাননার যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়নি, তেমন দৃষ্টান্ত এ রাজ্যে বিরল। বর্ণভেদভিত্তিক ব্রাহ্মণ্যবাদের একচ্ছত্র শাসনতন্ত্র সরকারি অফিসে সুদৃঢ় ভাবে ‘সংরক্ষিত’। আমার পরিচিত বেশ কিছু আদিবাসী সরকারি আধিকারিকদের মতামত এই যে, যত সুদক্ষ ভাবেই দায়িত্ব পালন করুন না কেন, আদিবাসী হওয়ার দরুন তাঁদের ভাগ্যে ভদ্রলোক আধিকারিকদের দিক থেকে অনাস্থা বাঁধা। চাকরি জীবনে বেশির ভাগ সময়ে সেই সব দফতরেই পোস্টিং হয়ে থাকে, যেগুলো সরকার চালানোর নিরিখে গুরুত্বপূর্ণ নয়। ঊর্ধ্বতন অফিসারদের মধ্যে যেমন অন্তর্নিহিত সংশয় যে আদিবাসী হলেই কর্মদক্ষতাহীন, অধস্তন কর্মচারীদের মধ্যেও তাচ্ছিল্য ভাব, এই ভ্রান্ত ধারণা থাকে যে এঁরা আদতে কিছুই জানেন না। তাই কর্মদক্ষতার অগ্নিপরীক্ষায় নিরন্তর নিজেদের প্রমাণ করতেই চাকরিজীবন চলে যায়।

সংখ্যাতত্ত্বে এটা স্পষ্ট যে পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসী গোষ্ঠী শিক্ষা, জীবিকা, আর্থিক অবস্থা, জীবনধারণের মানের নিরিখে অবহেলিত গোষ্ঠী এবং তাদের অবস্থান অধিকাংশ ক্ষেত্রে সর্বভারতীয় গড়ের নীচে। জাতির অর্ধেক মানুষকে পিছনে ফেলে এবং অনেক ক্ষেত্রেই পদদলিত করে জাতির আর এক অর্ধেক এগিয়ে গেলে গৌরবে বহুবচন হতেই পারে— কিন্তু সার্বিক উন্নয়ন হওয়া অসম্ভব।

মানুষের চিন্তনে ও মননে ব্রাহ্মণ্য সাম্রাজ্যবাদকে সমূলে উৎপাটিত করার বিপ্লব না ঘটলে সাংবিধানিক সংরক্ষণের শতবার্ষিকী উদ্‌যাপনেও আদিবাসীদের হাজার হাজার বছরের বঞ্চনা, অবহেলা, শোষণ ও শাসন যন্ত্রণার ইতিহাস পাল্টাবে না। মগজে কার্ফুর দরুন জাতপাত ও জাতিবৈষম্য ব্যবস্থার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অচলায়তন ভেঙে জনজাতিদের

প্রাপ্য সামাজিক মর্যাদা ফিরিয়ে দিয়ে সমাজে সমানাধিকার ও সমদর্শিতার উন্মেষ কি তা হলে সত্যিই এ দেশে কল্পনাতীত? আমি তো সেই স্বপ্নই আজীবন দেখে যাব যে এক দিন সাম্যবাদী সমাজ গড়ে উঠবে, যেখানে সবাই শুধুই ‘মানুষ’ পরিচয়ে বাঁচবে। আপনারা আমার পাশে থাকছেন তো?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE