২৫ নভেম্বর ১৯৪৯ গণপরিষদে বি আর অম্বেডকর তাঁর বক্তৃতায় নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ যে সংবিধান গৃহীত হবে, তাতে ভারতবর্ষে রাজনৈতিক সাম্য এলেও আর্থ-সামাজিক সাম্য অধরাই থেকে যাবে। এও বলেছিলেন যে, গণতন্ত্রে রাজনৈতিক সাম্যের ভিত যদি সামাজিক ন্যায়, স্বাধীনতা এবং ভ্রাতৃত্ববোধে নিহিত না থাকে তবে তার টিকে থাকা অসম্ভব। তিনি অনুভব করেছিলেন, বর্ণভেদবিশ্বাসী, ব্রাহ্মণ্যবাদী-সামন্ততন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হিন্দু সমাজব্যবস্থায় যদি চিরকালীন অন্তেবাসী মানুষের সাংবিধানিক রক্ষাকবচ না দেওয়া যায়, তবে গণতন্ত্রের বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। সংবিধানের প্রাণকেন্দ্রে যে 'we the people'-এর ধারণা, আদ্যোপান্ত অগণতান্ত্রিক চিন্তাধারায় জারিত জাতপাতভিত্তিক থাকবিন্যস্ত হিন্দু সমাজের বাস্তবতা তার অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। এটা জেনেই সাংবিধানিক নৈতিকতাকে আইনি হস্তক্ষেপে বৈধতা দান করতে চেয়েছিলেন অম্বেডকর।
সংবিধানের ১৫, ১৬ ও ১৯ নম্বর ধারা যদিও সামাজিক আদানপ্রদান, মেলামেশা আর পারস্পরিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সাম্য আনতে চেয়েছিল, এবং ১৭ নম্বর ধারা অস্পৃশ্যতাকে আইনত অপরাধ বলে ঘোষণা করেছিল, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষেরা পেশা, খাদ্য, পোশাক, ভাষা, আচার-ব্যবহারে বর্ণহিন্দুদের চেয়ে পৃথক হওয়ার ফলে তাঁদের চিরতরে অস্পৃশ্য অশুচি ঠাহরে সামাজিক বহিষ্করণের নিদান দিয়ে অসাম্যের বিধানগুলো জবরদস্ত ভাবে কায়েম রেখেছে ব্রাহ্মণ্যবাদ। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষেরা হিন্দুদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং ধর্মজনিত বহুমাত্রিক হিংসা ও বৈষম্যের শিকারই শুধু নন, নির্মম জাতপাত ভেদ-সংবলিত ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু সমাজে এঁরা আজীবন সম্মান, মৌলিক মানবাধিকার ও ক্ষমতার অধিকার থেকে বহিষ্কৃত। এও সত্যি যে ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপত্যের বিরুদ্ধে রণে ভঙ্গ দিয়ে স্বাতন্ত্র্যচেতনার অধিকারী প্রান্তবাসী সম্প্রদায়গুলি নিজেদের চলনবলন, আদবকায়দা, স্বকীয়তাকে বিসর্জন দিয়ে ক্রীতদাসমূলক সংস্কৃতায়ন প্রক্রিয়াকে আত্মীকরণ করে মূলস্রোতে মিশে আত্মঘাতী প্রয়াসে ব্রতী হলে ‘তুমি নিশ্চিত অবাঞ্ছিত অপর’ এমন নিদান দিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদ তাদের জাতিকাঠামোর তলার দিকে ক্ষমাঘেন্না করে হয়তো জায়গা করে দেয়। তবে ২৯ নম্বর ধারার দৌলতে অষ্টম তফসিলে কয়েকটা আদিবাসী ভাষা সরকারি ভাষার মান্যতা পাওয়ায় এই বহিষ্করণ ও কণ্ঠরোধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষাটুকু বেঁচে থাকবে আশা করা যায়।
ভরসার কথা যে, এক দিকে যেমন অরণ্যের অধিকার আইন (২০০৬) কেড়ে নিয়ে বনাঞ্চল থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র চলছে, তেমন যোগ্য জবাব দিতে আদিবাসীরা আজ কর্পোরেট বৃহৎ পুঁজির স্বার্থে জড়িত সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলে রুখে দিচ্ছেন সংবিধানের অবমাননা। সংবিধানে তফসিলি জনজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে তাঁদের পূর্ণ স্বশাসনের অধিকার আছে। তা ছাড়া পঞ্চায়েত আইন (১৯৯৬) অনুযায়ী এই সব অঞ্চলে আদিবাসী গ্রামসভা-ই সর্বোচ্চ প্রশাসনিক ক্ষমতার অধিকারী। তাঁদের অনুমোদন ও সিদ্ধান্ত ছাড়া সরকার ‘উন্নয়ন’-এর নামে কোনও অনাদিবাসীকে জমি বেচতে বা হস্তান্তর করতে পারে না। ২০১৩-১৪’য় আমরা দেখি ওড়িশার কালাহান্ডি জেলার লাঞ্জিগড়ে বেদান্ত অ্যালুমিনিয়াম লিমিটেড নিয়মগিরি পাহাড় খনন করে বক্সাইট উত্তোলন করার প্রস্তাবে সরকার রাজি হয়ে যাওয়ায় স্থানীয় ডোংরিয়া কোন্ধ জনজাতির মানুষেরা কি প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ২০১৬-১৭’য় ঝাড়খণ্ড সরকার যখন ছোটনাগপুর টেনান্সি অ্যাক্ট-এর সংশোধন এনে আদিবাসীদের জমিকে ব্যবসায়িক মুনাফার জন্য হস্তান্তর করতে চায় তখন খুনতি, গুমলা, সিংভূম, পশ্চিম সিমডেগার আদিবাসীরা জল, জঙ্গল, জমির লুট প্রতিরোধের জন্য অভিনব পাতালগড়ি আন্দোলন গড়ে তোলেন। তফসিল জনজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের জন্য সংবিধানের অংশবিশেষ পাথরের ওপর খোদাই করেন।