Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

গোকুলে অসন্তোষ বাড়ছে

সে দিন ইজরায়েলের জাতীয় দিবসে তাজ প্যালেস হোটেলে আয়োজিত নৈশভোজে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল দেশের এক বিশিষ্ট শিল্পপতির সঙ্গে। অনেক দিন পর দেখা।

ব্যর্থকাম: ২০১৪ সালে দিল্লিতে একত্র তৃতীয় ফ্রন্ট-এর নেতারা, নীতীশ কুমার, দেবগৌড়া, প্রকাশ কারাট, শরদ যাদব, মুলায়ম সিংহ যাদব।

ব্যর্থকাম: ২০১৪ সালে দিল্লিতে একত্র তৃতীয় ফ্রন্ট-এর নেতারা, নীতীশ কুমার, দেবগৌড়া, প্রকাশ কারাট, শরদ যাদব, মুলায়ম সিংহ যাদব।

জয়ন্ত ঘোষাল
শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৭ ০০:১১
Share: Save:

সে দিন ইজরায়েলের জাতীয় দিবসে তাজ প্যালেস হোটেলে আয়োজিত নৈশভোজে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল দেশের এক বিশিষ্ট শিল্পপতির সঙ্গে। অনেক দিন পর দেখা। জিজ্ঞাসা করলাম, দেশের পরিস্থতি কী বুঝছেন? মুচকি হেসে তিনি বললেন, ‘এখন কোনও কথা হবে না। নো কোয়েশ্চন। উত্তরপ্রদেশের জয়লাভের পর এখন আমরাও চুপচাপ।’

বললাম, ‘প্রকৃতির একটা নিজস্ব আইন আছে। নদীর এ কূল গড়ে তো অন্য কূল ভাঙে। এখন দেখতে পাচ্ছেন না, কিন্তু নীরবে বিরোধীরা একজোট হচ্ছে। কচ্ছপ আর খরগোশের গল্প মনে আছে তো!’ এ বার ওই শিল্পপতি আমার কাঁধে একটা মৃদু চাপড় দিয়ে বললেন, ‘উই নিড এ স্ট্রং অপোজিশন। গুড ফর ডেমোক্র্যাসি।’

কংগ্রেসের একদলীয় আধিপত্যের অবসানের পর এ দেশে যখন জোট রাজনীতি শুরু হল, তখন তাও ক্রমশ এক দ্বি-দলীয় জোটের মেরুকরণে পর্যবসিত হল। হয় বিজেপি, নয় কংগ্রেস, এই দুটো ছাতার তলায় আসতে হল অন্য আঞ্চলিক দলগুলিকে। নেহরু যুগের বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেও ছিল কংগ্রেসের আধিপত্য। রজনী কোঠারির ভাষায়, ‘ওয়ান পার্টি ডমিন্যান্ট সিস্টেম’। কংগ্রেসের অবক্ষয়ের পর বহু আঞ্চলিক দল বিকশিত হয়। ধর্ম, জাতপাত ও আঞ্চলিক সত্তার ভিত্তিতে। জোট রাজনীতিতে যোগ দিয়ে বিজেপিরও শ্রীবৃদ্ধি হয়। বিজেপি কংগ্রেস বিরোধী রাজনীতির প্রধান চালিকা শক্তি হয়ে ওঠে। মোদীর মস্ত সাফল্য বিজেপিকে তার হিন্দুত্ব মতাদর্শের লাইনে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে আরও বড় দল হিসেবে গড়ে তোলা। আমাদের এক মাস্টারমশাই বলেছিলেন ইতিহাস অনেকটা ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো। এক বার কংগ্রেস বিরোধিতা, আর এক বার বিজেপি বিরোধিতা। সেই ট্র্যাডিশনই সমানে চলেছে।

নেহরু যখন প্রধানমন্ত্রী, তখন বিরোধী নেতারা এই একই কথা বলতেন। রসিকতার সুরে এক বার তিনি বলেছিলেন, বিরোধী দলগুলির শক্তিবৃদ্ধির দায়িত্ব কি আমাকে নিতে হবে? ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি স্বাভাবিক। ভারতবর্ষের রাজনীতিতে কংগ্রেসের পরিসর কেড়ে বিজেপি বেড়েছে। আবার বিজেপির পরিসর কেড়ে কংগ্রেসের বৃদ্ধি হয়েছে।
এ এক ‘জিরো সাম’ গেম।

এখন চলছে মোদী যুগ। প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার আবহ নেই। নরেন্দ্র মোদী যেন ধনী-বিরোধী এক নয়া অবতার। তিনি নতুন ভারত গড়বেন এই স্বপ্নেই বিভোর দেশের বহু সাধারণ মানুষ। কিন্তু সত্যিই কি বিরোধী দলের অস্তিত্ব অবলুপ্ত?

এ এক মস্ত ভ্রম। বিজেপির বিরুদ্ধে প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কংগ্রেস। যে কংগ্রেসের প্রধান কান্ডারি আজ রাহুল গাঁধী। গোটা দেশে আজ কংগ্রেসের বাহুবল এবং বাক্যবল কোনওটাই প্রকট নয়। তবু তাদের ভোটব্যাঙ্ক আজও অনেকটাই অটুট। স্বাধীনতার সত্তর বছর পর হিসেব মেলাতে গেলে দেখা যায়, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের এক চূড়ান্ত অবক্ষয় হয়েছে। হতে পারে হাতিশালে আর আজ অত হাতি নেই। ঘোড়াশালে নেই অত ঘোড়া। তবু মানুষের অসন্তোষ কি সত্যি নেই?

এই আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন না করে কারও পক্ষেই কোনও আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীদের লালবাতি ব্যবহার বন্ধ করে দিলেন। তােত কি দেশের আর্থিক শ্রেণিবৈষম্য মুছে গেল? প্রধানমন্ত্রী কত প্রকল্প ঘোষণা করেছেন। কৃষি ক্ষেত্রেও কত ঘোষণা। তবু কৃষি বৃদ্ধির শতকরা হারের এহেন করুণ দশা কেন? এখনও রাজ্যে রাজ্যে কৃষক আত্মহত্যা বাড়ছে কেন? সীমান্তে যুদ্ধ-পরিস্থিতি। কাশ্মীর সমস্যা তীব্র। কিন্তু আজ এই বাস্তব পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে কলকাতার যিশুরা কোথায়, যারা বলবে রাজা তোর কাপড় কোথায়?

আসলে তাঁরা আছেন। এই বিজয় গৌরব, প্রচারে নিয়নবাতির ঝলকানিতে দিশেহারা দর্শন ও শ্রবণেন্দ্রিয়। প্রকৃতির সূত্র অনুসারে মানুষ বুঝবেই ঘুণ ধরা দেওয়ালে চুনকামে স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক লাভ হয়, স্থায়ী সমাধান হয় না।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সর্বসম্মত প্রার্থী বাছাইকে কেন্দ্র করে এই বিরোধী রাজনীতির ইমারত বানানোর কাজ সবে শুরু হয়েছে। একটা একটা করে ইট জোগাড় হচ্ছে। সেই প্রার্থী বিজেপির প্রার্থীকে হারিয়ে দিলে সে তো আরও বড় অপ্রত্যাশিত সাফল্য। কিন্তু জয়-পরাজয় যা-ই হোক, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী শিবির যে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।

রাজ্যে রাজ্যে আজও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক দল আছে যারা অ-বিজেপি শুধু নয়, ঘোরতর বিজেপি-বিরোধী। যেমন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস। একদা মমতা সিপিএম বিরোধিতার অগ্রাধিকারে কংগ্রেস ছেড়ে নতুন দল গড়েছেন। সিপিএম-বিরোধিতার তাগিদে যোগ দিয়েছেন এনডিএ-তে। কিন্তু আজ অনেক জল-কাদা ঘেঁটে অনেক খানাখন্দ পেরিয়ে মমতা এক নতুন ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছেন। এখন সারদা-নারদা যত তদন্তই করুক কেন্দ্র, মমতার পক্ষে শতকরা ৩০ ভাগ সংখ্যালঘুর রাজ্যের প্রধান কান্ডারি হিসাবে বিজেপির খাতায় আর নাম লেখানো সম্ভব নয়। যেমন, মায়াবতী এবং অখিলেশ যাদব এঁদের দুটি দলের বিরুদ্ধেও অনেক রাজনৈতিক ব্ল্যাকমেলের চিত্রনাট্য তৈরি। তবু এই দুই দলকেই মোদীবিরোধী মঞ্চ গঠনের প্রয়াসেই সক্রিয় হয়ে উঠতে হবে। নান্যপন্থাঃ।

নবীন পট্টনায়ক? তিনি বহু দিন চুপ করে থেকেছেন। তিনি নোটবন্দি বিষয়েও মোদীর সমালোচনা করেননি। অতীতে দীর্ঘ দিন তিনি বাজপেয়ী জমানায় এনডিএ-র শরিক ছিলেন। তিনিও যখন দেখলেন তাঁর দল ভাঙার চেষ্টা হচ্ছে, এমনকী চিট ফান্ডের দুর্নীতির বিষয় নিয়ে বিজেপি এখন নবীনবাবুকেই ক্ষমতাচ্যুত করতে মরিয়া, তখন সেটা হজম করা বিজুবাবুর পুত্রের পক্ষেও বেশ কঠিন। ধীরে ধীরে মোদীবিরোধী রাজনীতির ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে। স্ব-স্ব দুর্গ বাঁচানোর তাগিদে।

মোদীর বিজেপি এখন ক্ষমতায়। মানুষের প্রত্যাশা সীমাহীন। মুচিরাম গুড়েদের সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান। এ-ও সত্য, সকলের অজান্তে গোকুলে অসন্তোষও বাড়ছে। মোরারজি দেশাই থেকে দেবগৌড়া-গুজরাল অনেক দেখেছি। কংগ্রেস ছাড়া এ দেশে তৃতীয় শক্তি ক্ষমতা দখল করতে পারে না কখনও। বিজেপির প্রতিপক্ষ পরিসর কংগ্রেসকেই দখল করতে হবে। স্বপ্নের মায়াজাল ছিন্ন করে সে-ও এক ইতিহাসের অমোঘ নিয়ম।

রাহুল গাঁধী চুপ করে আছেন। খুব বেশি প্রচারের ঢক্কানিনাদে তিনি নেই। এই প্রতিকূল ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যে সেটাই উচিত পদক্ষেপ। এখন চুপচাপ রাজ্যে রাজ্যে দলের সংগঠন মজবুত করা, মানুষের কাছে সরাসরি পৌঁছনো প্রয়োজন। সে সব জনসভার লাইভ টেলিকাস্ট না-ই বা হল। প্রতিপক্ষের ‘আনফোর্সড এরর’-এর জন্য অপেক্ষা করাটা কৌশলী রাজনীতি। ক্ষমতার দম্ভ, সমালোচনা না শোনার মানসিকতা যে কোনও দল, যে কোনও মানুষকে স্বাভাবিক ভাবেই বেশ কিছু ভুল করতে বাধ্য করে। সে সব ভুলের মাশুল দিতে হয় তখন সফল রাষ্ট্রনেতাকেও। ইন্দিরা-রাজীব থেকে রাও-বাজপেয়ী ব্যতিক্রম হননি। মোদী কি পারবেন রাজনৈতিক ব্যতিক্রম হতে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Narendra Modi political exception third front
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE