ছবি: সংগৃহীত।
এক বার পাইলে আর হারাইবার ভয় নাই, একেবারে অবসরগ্রহণের দিন দফতরের সঙ্গে সম্পর্ক ঘুচিবে— সরকারি চাকুরির এই অনন্ত নিশ্চয়তার ফলে দেশের কর্মসংস্কৃতির কতখানি ক্ষতি হইয়াছে, সেই হিসাব ভবিষ্যতের গবেষকের জন্য তোলা থাক। নিরাপত্তার সেই স্থির পুকুরের জলে একটি জোরদার ঢিল ফেলিবার কৃতিত্ব নরেন্দ্র মোদীর সরকারের পাওনা। সিদ্ধান্ত হইয়াছে, প্রতি তিন মাস অন্তর পঞ্চাশোর্ধ্ব কর্মীদের কাজের মূল্যায়ন হইবে। যাঁহাদের কর্মকুশলতা প্রশ্নের মুখে পড়িবে, তাঁহাদের চাকুরির নটেগাছটিও মুড়াইবে। এ ক্ষণে প্রথম প্রশ্ন: পঞ্চাশের চৌকাঠটি পার হইবার পূর্বে প্রত্যেক কর্মীর কর্মকুশলতা ও সদিচ্ছা প্রশ্নাতীত, সরকার এই বিশ্বাসটিতে উপনীত হইল কোন যুক্তিতে? বয়স-নির্বিশেষে প্রত্যেক কর্মীর কাজের মূল্যায়ন হওয়া বিধেয়— এবং সেই মূল্যায়নের ভিত্তিতেই তাঁহাদের বেতনবৃদ্ধি হওয়া উচিত; এমনকি, চাকুরি আদৌ থাকিবে কি না, তাহা স্থির করিবার মাপকাঠিও এই মূল্যায়ন। শুধুমাত্র প্রবীণ কর্মীদের মূল্যায়নের ব্যবস্থা হইলে প্রশ্ন উঠিতে পারে, সরকার কি বয়সের কারণে বৈষম্যমূলক আচরণ করিতেছে? প্রবীণ কর্মীদের ছাঁটাই করাই কি মূল উদ্দেশ্য? সরকারি ক্ষেত্রে কর্মীদের মূল্যায়নের প্রক্রিয়াটির গুরুত্ব বৃদ্ধির ন্যায় অতি জরুরি কাজে এহেন প্রশ্নের অবকাশ না রাখাই বিধেয়।
কিন্তু, বৃহত্তর প্রশ্ন হইল, প্রতি তিন মাস অন্তর মূল্যায়ন করা কি সম্ভব? আদৌ কি তাহা করা উচিত? মূল্যায়নের প্রক্রিয়া সম্বন্ধে যাঁহাদের কিছুমাত্র ধারণা আছে, তাঁহারাই জানিবেন, প্রক্রিয়াটি অতি জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। ফলে, সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী দফতরের শীর্ষকর্তাকে যদি প্রতি তিন মাসে মূল্যায়ন করিতে হয়, ধরিয়াই লওয়া যায়, তাঁহার কর্মদিবসের অধিকাংশ সময় এই কাজেই ব্যয় হইবে। তাহাতে তাঁহার অপরাপর কর্তব্যগুলি কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হইবে, বোঝা সম্ভব? এবং তাহার পরও, প্রতি তিন মাসে মূল্যায়ন করা আদৌ সম্ভব হইবে কি না, সেই প্রশ্ন থাকিয়া যায়। কিন্তু, সরকারি নিয়ম মানিয়া যদি কর্তাকে মূল্যায়ন করিতেই হয়, তবে অবিচারের আশঙ্কা থাকিয়া যাইবে। অর্থাৎ, কাজের বিচারের বদলে কর্তার পছন্দ-অপছন্দের ন্যায় অন্যান্য বিষয় বিবেচিত হইতে পারে। তাহাতে কর্মদক্ষতা বাড়িবে না, বরং দুর্নীতির পরিসর গড়িয়া উঠিতে পারে। শিব গড়িতে বসিয়া বানর গড়িবার কু-অভ্যাস সরকারের চির কালই আছে। এই ক্ষেত্রেও তেমন ভুল না করাই বাঞ্ছনীয়।
প্রতি তিন মাসে মূল্যায়ন কর্মীদের পক্ষেও ন্যায্য হইতে পারে না। সেই অন্যায্যতার একটি দিক, সময়ের অভাবে মূল্যায়নের প্রক্রিয়াটি ব্যক্তিসাপেক্ষ হইয়া উঠা। কিন্তু, তাহাই একমাত্র নহে। মূল্যায়নের অন্যতম উদ্দেশ্য, যে কর্মীরা পিছাইয়া পড়িতেছেন, তাঁহাদের সংশোধনের সুযোগ করিয়া দেওয়া। কোথায় ভুল হইতেছে, এবং সেই ভুল শুধরাইবার উপায় কী, কর্মীদের তাহা স্পষ্ট ভাবে জানানো মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভুল শুধরাইবার জন্য সময় দেওয়াও জরুরি। তাহার জন্য তিন মাস অতি অল্প— এমনকি, ছয় মাসও যথেষ্ট কি না, সেই প্রশ্ন থাকিয়া যায়। কিছুতেই চাকুরি যাইবে না, এই নিশ্চয়তা যেমন কর্মকুশলতার পক্ষে ক্ষতিকর, সর্ব ক্ষণ চাকুরি হারাইবার আশঙ্কাও উপকারী নহে। ন্যূনতম ছয় মাস অন্তর মূল্যায়ন করা যাইতে পারে— কিন্তু কোনও একটি ছয় মাসের কাজকর্মের ভিত্তিতে কর্মী ছাঁটাই না করাই বিধেয়। পর পর দুইটি ষাণ্মাসিক মূল্যায়নে কেহ ব্যর্থ হইলে তবেই তাঁহাকে ছাঁটাই করিবার প্রশ্ন উঠিতে পারে। সরকারকে একটি কথা স্মরণ করাইয়া দেওয়া বিধেয়— মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার লক্ষ্য কর্মীদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, বয়স্ক কর্মীদের ছাঁটাই করা নহে। লক্ষ্য সম্বন্ধে সচেতন না হইলে গোটা প্রক্রিয়াটিই এক বৈষম্যমূলক কার্যক্রম হইয়া দাঁড়াইতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy