স্বাস্থ্যখাতে অবশ্য বরাদ্দ বেড়েছে ১৩৭ শতাংশ।
বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের ২০২১-’২২ অর্থবর্ষের বাজেট পেশ হল কয়েকদিন আগে। বাজেট ঘিরে বড় প্রত্যাশা কখনওই ছিল না। কিন্তু আশা-নিরাশার একটা হাল্কা দোলাচল ছিল। মনে হয়েছিল, এ বছর হয়ত মানসিক স্বাস্থ্যখাতে অন্তত কিছু অর্থ বরাদ্দ হবে। অথচ দীর্ঘ বাজেট বক্তৃতায় মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। শেষ পর্যন্ত আমাদের হাতে যা রইল তাকে পেনসিলও বলা যায়। অথবা শ্মশানের নৈঃশব্দ্য!
স্বাস্থ্যখাতে অবশ্য বরাদ্দ বেড়েছে ১৩৭ শতাংশ। প্রধানমন্ত্রী আত্মনির্ভর স্বাস্থ্য ভারত যোজনার অধীনে ছ' বছরে ৬৪ হাজার কোটি টাকা খরচ করার কথা ঘোষণা করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। কিন্তু জানানো হয়েছে, ওই অর্থ সরকারি চিকিৎসার পরিকাঠামোগত উন্নতির জন্য খরচ করা হবে। প্রসঙ্গত, মানসিক স্বাস্থ্য কিন্তু প্রাইমারি হেল্থ কেয়ার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে পড়ে না। বহুবার দাবি জানানো হয়েছে, মানসিক স্বাস্থ্যকেও প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অন্তর্ভূক্ত করা হোক। কিন্তু কর্ণপাত করেননি কেউ। স্বাভাবিক ভাবেই এ বছরের বাজেটেও মানসিক স্বাস্থ্য উপেক্ষিতই থেকে গিয়েছে।
অবশ্য প্রতি বছরই একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি চলে। স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ কমতে থাকে আর ধুলোয় গড়াগড়ি খায় মানসিক স্বাস্থ্য। টাকা বরাদ্দ করার ধারার দিকে লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, টাকার পরিমাণ প্রতি বছরই কমেছে। ২০১৮-’১৯ সালের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। তা থেকে খরচ করা হয়েছিল মাত্র সাড়ে পাঁচ কোটি! পরের বছর, ২০১৯-’২০ সালে বরাদ্দের পরিমাণ কমে হয় ৪০ কোটি টাকা। খরচ? মাত্র পাঁচ কোটি। আবার! গত অর্থবর্ষ এবং এ বছর স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ আর বাড়েনি। ৪০ কোটিতেই আটকে রয়েছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য প্রকল্পে সরকারের ‘ফ্ল্যাগশিপ প্রোগ্রাম’, যেখানে সাধারণ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখা হয়, সেখানে বরাদ্দ মাত্র ৭ শতাংশ! বাকিটা চলে গিয়েছে দু’টি ‘সেন্টার অফ একসেলেন্স’ মানসিক হাসপাতাল— বেঙ্গালুরুর ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেল্থ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্সেস’ এবং অসমের তেজপুরের ‘লোকপ্রিয় গোপীনাথ বরদোলই রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেল্থ’-এ। অর্থাৎ প্রায় পুরো বরাদ্দটাই পরিকাঠামো খাতে। সাধারণ মনোরোগীদের কথা ভাবাই হয়নি।
তা হলে এর অর্থ আমরা কী বুঝব? বুঝব যে, সরকার মনে করছে আসলে মনোরোগীদের চিকিৎসা হাসপাতালে, বলা ভাল, পাগলাগারদে রেখেই করা উচিত। কিন্তু আমরা যারা মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে গত ২০ বছর ধরে কাজ করছি, তারা জানি মানসিক স্বাস্থ্যরক্ষার বিষয়টি কোনওমতেই হাসপাতাল-কেন্দ্রিক হতে পারে না! আমাদের যে মূলগত লক্ষ্য— সুস্থ হয়ে ওঠার পর একজন মানসিক রোগী সমাজে থেকেই চিকিৎসিত হবেন, সামাজিক জীবনযাপন করবেন— উপেক্ষিত হয়েছে সেই বিষয়টাই। যে কোনও উন্নত দেশের বাজেটে সাধারণত আয়ব্যয়ের হিসাব পেশ করা হয়। কোন খাতে কত খরচ হবে, তার একটা দিকনির্দেশ দেওয়া হয়। অথচ আমাদের দেশে সাম্প্রতিককালে বাজেটের সঙ্গে একগুচ্ছ প্রকল্প ঘোষণা করে দেওয়া হচ্ছে। প্রকল্প শুনে আমরা করব কী! এগুলো তো কার্যনীতি! এ সব প্রকল্প আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে, রাষ্ট্র বা সরকারের অগ্রাধিকার আসলে কী। সেই অগ্রাধিকারের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য যে নেই, তা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট!
মনে রাখতে হবে, এটি কোভিড-পরবর্তী সময়ের প্রথম বাজেট। গোটা করোনাকাল এবং সেই সঙ্গে লকডাউনের দীর্ঘ সময় জুড়ে মানুষের মনের উপর নানা কারণে অকথ্য চাপ পড়েছে। টান পড়েছে কর্মসংস্থানে, রুজিরুটিতে। হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক পায়ে হেঁটে নিজেদের রাজ্যে ফেরার চেষ্টা করেছেন, রাস্তায় বসে কেঁদেছেন হাউহাউ করে! রেললাইনে ছড়িয়ে থাকা রুটি বা ট্রলির ওপরে ঘুমন্ত শিশুর ছবিগুলো এখনও আমাদের মনে দগদগে। কোভিডের এই সময়টা যেন মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টাকে মনোযোগের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছিল। আতঙ্ক, উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, আত্মহত্যার মতো সমস্যাগুলো নিয়ে সারা বিশ্বে তথা দেশে আলোচনা শুরু হল। কিন্তু আমরা যখন বাজেট দেখলাম, তখন সেখানে মানুষের দুর্দশা, মানসিক সমস্যা সমাধানের কোনও চেষ্টা বা প্রতিফলন সেখানে খুঁজে পেলাম না। অর্থাৎ মানুষের দুর্দশা থেকে রাষ্ট্র কোনও শিক্ষা নিল না, উলটে মনোরোগী বা মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে বাকি জগতের যেন একটা সামাজিক দূরত্ব তৈরি করে দিল!
এবং তার সঙ্গে রাজনীতির খেলা। ইদানীং দেশে তথা রাজ্যে যে রাজনীতি চলছে, তার সিংহভাগে শুধুই গালাগাল আর কুকথা। কোনও রাজনৈতিক দলই তার বাইরে নয়। ‘চড়াম চড়াম’ থেকে শুরু করে ‘খেলা হবে’, ‘প্রতিশোধের রাজনীতি’, ‘এঁটো মাল’, গুলি করে মারার হুমকি— কোনও কিছুতেই আর মুখের কোনও আগল নেই! যত দিন যাচ্ছে, তত এই পারস্পরিক কুকথা আর হুমকির স্রোত বেড়ে চলেছে! থেকে থেকেই যেন রাজনৈতিক দলগুলো হুঙ্কার ছাড়ছে আর তার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই তৈরি হচ্ছে একটা প্রবল ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশ!
খুব সচেতনভাবেই এই ভয়ের পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে শুধুমাত্র ক্ষমতাদখলের জন্য! এই পরিবেশে থাকতে হলে যে কোনও সাধারণ নাগরিকের মানসিক স্বাস্থ্য শান্তি বিঘ্নিত হওয়ারই কথা! একদিক থেকে রাষ্ট্র এই ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করে সাধারণ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য টালমাটাল করে তুলছে। তাকে মনোরোগের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অন্যদিকে মনোরোগীদের জন্য তার ভাঁড়ারে বিরাট শূন্য ছাড়া আর কিছুই নেই! এই দ্বিচারিতাই এখন হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রের মুখ!
(লেখক মানসিক স্বাস্থ্য আন্দোলনের পরিচিত কর্মী। মতামত নিজস্ব)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy